নাদিরা তাবাস্সুম : হাসপাতালের বেডে ব্যথা যন্ত্রণায় লোকটি অস্থির হয়ে হাত পা ছুঁড়ছে। তমিজা সান্তনা দিয়ে চলেছে ‘ধৈর্য ধরো, ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছে। এইতো এখনি চলে আসবে’। এর মধ্যেই ডাক্তার কয়েকজন নার্সসহ এসে লোকটিকে ইঞ্জেকশন দিলো এবং সেলাইন লাগিয়ে বললো “ঘুমান, এক্ষনি ব্যাথা কমে যাবে; আর তমিজার দিকে তাকিয়ে বলে ‘আপনি উনার দিকে খেয়াল রাখবেন”; এই বলে সবাই চলে গেলো। কিছু সময়ের মধ্যে অসুস্থ মীরাজ ঘুমিয়ে পড়েছে আর তমিজা পাশে থাকা চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছে। এই কি সেই মীরন যার রাগ, অহংকার আর দম্ভের কাছে তমিজা মুখ তুলে বা গলা বাড়িয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। স্ত্রী হয়েও কখনও নিজের সুবিধা অসুবিধার কথা বলতে পারেনি । মীরাজ যখন চোখের সামনে বন্ধুদের এবং অন্য মহিলাদের নিয়ে বাইরে গিয়ে রাত কাটিয়ে বাসায় ফিরতো, তখন অপমান, লজ্জা ও ঘৃণায় তমিজা নিজের মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করেছে তবু কাউকে কিছু বলেনি শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের নিরাপদ ভবিষ্যত চিন্তা করে। আজ ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, যে যার মতো নিজের সংসার করছে। মাঝে মাঝে হাসপাতালে বাবাকে এসে খাবার-দাবার, ফল-ফলাদি দিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তমিজার বুকভরা কষ্ট ও কান্না কেউ বুঝতে পারে না। সারাটা জীবন কান্না চেপে কষ্ট করে সংসার চালিয়ে গেছে, বিনিময়ে পেয়েছে স্বামীর অবহেলা, উপেক্ষা আর নির্যাতন। কত দিন কত কান্নাকাটি করেছে এবং কত অনুরোধ করেছে “মীরাজ তুমি অন্তত ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে সকল অন্যায় অবৈধ কাজ ছেড়ে দাও। চলো আমরা অন্য কোথাও গিয়ে বসবাস করি”। মীরাজ ততই ক্ষিপ্ত ও জেদি হয়ে উঠেছে এবং আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে। সংস্কৃত ভাষায় প্রায়ই বন্ধুদের সাথে উচ্চস্বরে হাসাহাসি করে বলতো “যাবত জীবেত, সুখং জীবেত; ঋনং ক্রিতং, ঘৃতং পীবেত অর্থাত যতদিন বাঁচবে সুখে বাঁচবে, ঋণ করে হলেও ঘি খাবে”।

তমিজার বড় বোন মুর্শিদা বাসায় এসে একবার মীরাজকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো এবং বলেছিল “ভাই মীরাজ, সংসার, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কারো প্রতি তুমি কোন দায়িত্ব পালন করছো না, আল্লাহর কাছে মৃত্যুর পর কী জবাব দিবে”? মীরাজ উত্তরে বলেছিল, “সেটা তখন দেখা যাবে”।

সেদিন মীরাজ রাগ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে যায় এবং রাতে বাসায় ফিরে আসে না। বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় বোঝার শক্তি নেই যে, এতদিন যাদের জন্য অর্থ ব্যয় করেছে এবং যাদের সংগে আনন্দ করে বেড়িয়েছে; আজ তারা দূরে সরে পড়েছে। ভীষণ দুঃখ যন্ত্রণা তমিজার বুকের এপিঠ ওপিঠ ভেদ করে যেতে চায়। মনে হয় চীত্কার করে সকলকে সব কিছু জানিয়ে দেবে। যে মানুষ এতদিন তমিজাকে ইচ্ছা করে অবহেলা করেছে দূরে ঠেলে দিয়েছে, এখন কেন তার দেখাশুনা করতে হবে ও সেবা করতে হবে? এখন তমিজা ছাড়া মীরাজকে দেখা শুনা করার কেউ নেই। তমিজা ইচ্ছা করলে ছেড়ে চলে যেতে পারে কিন্তু তার চেতনা, তার মানবিক মূল্যবোধ বার বার ফিরিয়ে আনে। তমিজা চিন্তা করে হয়তো মহান সৃষ্টিকর্তার কোন এক অজানা উদ্দেশ্য রয়েছে। তাকে হয়তো এমন পরিস্থিতিতে ফেলে পরীক্ষা করছেন। বোনের পরামর্শ শুনে দূরে চলে গেলে হয়তো এখন মীরাজের এমন অবস্থা কাছে থেকে দেখতে হতো না।

একদিন তমিজার বান্ধবী রিহানা মীরাজকে হাসপাতালে দেখতে এসে মীরাজের জীর্ণ শীর্ণ ও রুগ্ন অবস্থা দেখে বলেছিলো “হায়রে সভ্যযুগের জড়বাদী ও ভোগবাদী মানুষ! যখন সুস্থ থাকে, শরীরে শক্তি থাকে তখন রোগ, শোক ও মৃত্যুর কথা একেবরেই ভুলে যায়। সদর্পে ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের অর্থ, সম্পদ ভোগ করে এবং ক্ষমতার অহংকার করে বেড়ায় মীরাজ ভাইয়ের কি এখনও কোন অনুশোচনা হয়েছে? জানো তো যে, সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালা দাম্ভিক, গর্বিত ও ঔদ্ধত মানুষকে কখনই ভালোবাসেন না। তিনি পবিত্র কোরআনে সূরা লোকমানের ১৮ নং আয়াতে বলেছেন, “আর তুমি অহংকারের বশবর্তী হয়ে মানুষের প্রতি অবজ্ঞা করো না, আর যমীনে দম্ভভরে চলো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক ও কোন অহংকারীকে ভালোবাসেন না”। তিনি সূরা হাদীদ-এর ২০নং আয়াতে আরও বলেছেন, “তোমরা ভালভাবে জেনে রাখ, পার্থিব জীবন তো কেবল খেল-তামাশা, এটা বাহ্যিক সৌন্দর্য, পরস্পর দম্ভ এবং ধন ও সন্তানের প্রতিযোগিতা মাত্র। যেমন বৃষ্টি, যার দ্বারা উত্পাদিত ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ প্রদান করে, অতঃপর তা শুকিয়ে যায় এবং হ্রদ হয়ে গিয়ে তা পরিণত হয় খড়ে। ——–আর পার্থিব জীবন তো নিছক ছলনাময় ও ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়”। তমিজা, তুমি জীবনে অনেক কষ্ট করেছো, বিপদআপদে ধৈর্য ধারণ করে থেকেছ এজন্য তুমি নিশ্চয়ই প্রতিদান পাবে। সূরা নাহল-এর আয়াত ৯৬-এ আল্লাহ বলেছেন, “তোমাদের নিকট যা আছে তা শেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে তা কখনও শেষ হবে না। আর যারা ধৈর্যশীল তাদেরকে কাজের চেয়ে উত্তম পুরষ্কার দিব”।