মণিজিঞ্জির সান্যাল: আমরা সাধারণত অল্পতেই হতাশ হয়ে যাই। এই ‘হতাশা’ কিন্তু একটা ব্যাধি। তবে সবাই এই হতাশার শিকার হয়ে চুপচাপ বসে থাকে না। জীবনের আর এক নাম হওয়া উচিত মনের জোর। অনেকেই মনের জোর নামক অদম্য সাহস নিয়ে দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে চলে সব ধরণের বাধা-বিপত্তি ভেদ করে। একজনের জীবনে যত কালো অতীত কিংবা খুঁতই থাকুক না কেনো, বাধা ডিঙ্গিয়ে যারা চলতে থাকে তারা সফলতার দ্বারে পৌঁছুবেই।

আজকে এমনই একজন মানুষের জীবনের গল্প শোনাবো, যিনি আমাদের মত স্বাভাবিক হাত-পা নিয়ে জন্মাননি। তিনি পৃথিবীতে এসেছেন হাত এবং পা ছাড়াই। কি অবাক ঘটনা তাই তো? দুটো হাত নেই, দুটো পা নেই, তাহলে আর জীবন কি! জীবনে বেঁচে থাকার স্বার্থকতাই বা কোথায়? কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা বিশ্বের দরবারে এক অনন্য উদাহরণ। তেমনি এমন কিছু রোগ আছে যার ফলে জন্ম নেওয়াটাই যেন এক বিস্ময়।
‘টেট্রা এনিমেলিয়া সিনড্রোম’ এর ফলে মানুষ কোনো হাত-পা ছাড়াই জন্ম নেয়। ডঘঞ৩ জিনের কারণে মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। ভ্রুণ অবস্থায় যখন মানুষের হাত, পা সৃষ্টি হতে থাকে তখন WNT3 জিনের কারণে হাত, পা সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে অন্যান্য বিভিন্ন অঙ্গও স্বাভাবিক গঠনে বাধাগ্রস্ত হয়। তবে নিক ভুজিসিক এর ক্ষেত্রে শুধু হাত-পা সৃষ্টিতেই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অন্য সব কিছু রয়েছে স্বাভাবিক।

১৯৮২ সালের ৪ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে নিক জন্ম নেয়। নিক ভুজিসিক এর পুরো নাম নিকোলাস জেমস ভুজিসিক। বেরিস ভুজিসিক ও ডুসকা ভুজিসিক এর ঘরে যখন নিকের জন্ম হয়, সন্তানের এরূপ আকৃতি দেখে নিক এর মা তাকে কোলে নিতে অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে অবশ্য স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তাকে ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ হিসেবে বিবেচনা করে মেনে নেন।

নিক জীবনকে সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। তবে শুরুতে এমন ছিল না। স্কুল জীবনে? মাত্র ১০ বছর বয়সে নিক আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। সে যাত্রায় বাঁচার পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, “পালিয়ে যাওয়া নয়, ইতিবাচক দৃষ্টিতে জীবনকে দেখে লড়াই করতে হবে”। এর পরের গল্পটা একেবারেই ভিন্নরকম।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাঁর হাইস্কুলের এক দারোয়ান তাকে জনসম্মুখে বক্তৃতা দেয়ার জন্য উত্সাহিত করেন। ৫৩ বার প্রত্যাখিত হওয়ার পর, নিক যখন প্রথমবার মঞ্চে উঠলেন বক্তব্য দিতে, তখন দর্শক সারি প্রায় পুরোটাই খালি হয়ে গিয়েছিল।
নিক কিন্তু তাতেও হতাশ হননি। অভাবনীয়ভাবে খুব তাড়াতাড়িই তিনি অভূতপূর্ব সাড়া পান। নিকের সম্পর্কে তাঁর বন্ধুরা বলেন, তিনি এমন একজন মানুষ যিনি আনন্দের জন্য রোমাঞ্চ অভিযান খুঁজে বেড়ান।

ধীরে ধীরে মানুষের কাছে তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন যে, ঘণ্টায় এক হাজার আটশত লোককে বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য ‘গিনেজ বুক’ এ তাঁর নাম উঠেছে।
মাত্র দুটো আঙ্গুল দিয়ে তিনি যতো দ্রুত টাইপ করতে পারেন যা অনেক স্বাভাবিক মানুষও পারে না। মিনিটে তিনি ৪৭টি শব্দ টাইপ করতে পারেন। তিনি নিজেই বলেছেন “আমি উঠে দাঁড়াবার জন্য শতবার চেষ্টা করব, যদি শতবারই ব্যর্থ হই তবুও ব্যর্থতা মেনে নিয়ে সেটা ছেড়ে উঠব না। আমি আবার চেষ্টা করব এবং বলব, এটাই শেষ নয়”।
নিক জন্মের পর থেকেই ‘স্বাভাবিক’ স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর কোনো পূর্ণাঙ্গ হাত-পা না থাকলেও বাম কোমরে দুই আঙুল বিশিষ্ট অপরিণত একটি পা রয়েছে। এই পা দিয়েই তিনি ভারসাম্য রক্ষা করে চলাফেরা করেন।

নিক ভুজিসিক দুই আঙুল দিয়েই ২১ বছর বয়সে ফিন্যান্সিয়াল প্ল্যানিং ও অ্যাকাউন্টিং এর মত বিষয় নিয়ে দুইবার স্নাতক সম্পন্ন করেছেন ‘গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে।
নিক ভুজিসিক ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জনের পর অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি পাঁচ উপমহাদেশের ষাটটি দেশে ঘুরে প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষের কাছে নিজের বক্তব্য পৌঁছে দেন।

নিক নিজের কাজ টিভি শো এবং নিজের লেখার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেন। ২০১০ সালে তাঁর রচিত প্রথম বই “Life Without Limits: Inspiration for a Ridiculously Good Life” প্রকাশিত হয়। এটি প্রায় ৩০ টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে বেস্ট সেলার খেতাব অর্জন করেছে। এটি ছাড়াও এখন পর্যন্ত তিনি আরও পাঁচটি বই লিখেছেন। যেগুলোও প্রায় সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া, লস এঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় নিক ‘Life Without Limbs’ নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এর প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি।

এছাড়া Attitude is Altitude নামে তাঁর আরও একটি সংগঠন রয়েছে। দুর্বলদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করার জন্য প্রচারণা চালান তিনি। এছাড়াও যুব সমাজকে লক্ষ্য করে “No Arms, No Legs, No Worries!” নামের একটি ডিভিডি প্রকাশ করেন।
“দ্যা বাটারফ্লাই সার্কাস” চলচ্চিত্রটিতে “উইল” চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করার জন্য ২০১০ সালে নিক ভুজিসিক “Method Fest Independent Film Festival” এ সেরা অভিনেতা পদক লাভ করেন। চলচ্চিত্রটি ২০০৯ সালে “Doorpost Film Project’s” এ প্রথম পুরস্কার অর্জন করে।

২০০৫ সালে যুব ‘অস্ট্রেলিয়ান অব দ্যা ইয়ার’ পুরস্কারের জন্য তিনি মনোনয়ন লাভ করেন।
২০১২ সালে নিক ভুজিসিক বিবাহ ইন্ধনে আবদ্ধ হন কানাই মিয়াহারার সাথে। মিয়াহারাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো আপনার সন্তান যদি নিক এর মত হয় তাহলে আপনি কী করবেন? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, “আমি তাকে আরেকজন নিক ভুজিসিক হিসেবে তৈরি করবো।”

বর্তমানে তাদের দুটি ছেলেও রয়েছে। ২০১৩ সালে তাদের প্রথম পুত্র কিয়োশি ও ২০১৫ সালে তাদের দ্বিতীয় পুত্র দিজান এর জন্ম হয়। স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিক বর্তমানে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া তে বসবাস করছেন ।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ