ঋতু মীর : “The beauty of the world lies in the diversity of its people”
১।
ছিপছিপে গঠনের উজ্জ্বল শ্যামলা ছেলেটাকে ক্লাশে ঢুকতে দেখে সত্যবতী। একমাথা ঘন কালো কোঁকড়া চুল. বুদ্ধিদীপ্ত চোখে দুরন্ত পাখির ডানার ছটফটে ভাব। রুমে ঢুকেই রোমিও স্টাইলে হেলেদুলে চারদিকে এক চক্কর খেয়ে সত্যবতীর সামনে এসে দাঁড়ায়- Can I go to washroom please? সেকি! লাঞ্চের পরে এইতো ক্লাশের ঘণ্টা পড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সাথে সাথেই ওয়াশরুম ব্রেক এ যাওয়ার অনুমতি দেয়া যায়না। আবার বাথরুমের মত ব্যাপারে যাওয়া যাবেনা তা বলারও উপায় নেই। আর একবার ক্লাশের বাইরে যাওয়া মানে অনর্থক ঘোরাফেরা শেষে কাজে একপ্রকার অনিচ্ছার চেহারা নিয়ে ক্লাশে ঢোকা। স্কুলে বয়সন্ধিকালের শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকতার কাজে প্রতিনিয়তই এইসবের মুখোমুখি হতে হয়। কথা বলার জন্য প্রশ্নবোধক চোখে তাকায় সত্যবতী- সারা মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসির অনুপম এক আভা ছড়িয়ে হাসছে ছেলেটা- ভীষণ ইমারজেন্সি ম্যাম! যেতেই হবে! গেলাম তবেৃআচ্ছা! দুর্বৃত্তের ছলের অভাব নেই। ছেলেটাকে ছাড় দিয়ে তারুণ্যের ছেলেমানুষি বাঁদরামিটা উপভোগ করে সত্যবতী। মুখের হাসি পেটে চালান দিয়ে মানানসই গম্ভীরতা মুখে এঁটে বলে- পাঁচ মিনিটের বেশি হলে কিন্তু হল মনিটর পাঠাবো ধরে আনতে! বুঝেছো তো? দুষ্টুমির হাসি আকর্ণ টেনে ইঁচড়েপাকা মুখভঙ্গিতে ছেলেটা বলে-তোমার গার্লরা যখন ওয়াশ রুমে যায় তাদের কি পাঁচ মিনিটে হয়? ওরা কমপক্ষে পনের মিনিট পার করে ক্লাশে আসে। আর জানো! ওরা কিন্তু আস্ত ড্রেসিং টেবিল ব্যাগে ভরে নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। নেভার মাইন্ড! আমি ওনলি দশ মিনিট নেবো।

সত্যবতীর অনুমতির তোয়াক্কা না করে ছেলেটা যেন হাওয়ায় ভর করে উড়ে বের হয়ে যায় ক্লাস থেকে। ভাবগতিক দেখে চিন্তিত হয় সত্যবতী। কতক্ষণে ফিরবে কে জানে? স্কুলে এই পিরিয়ডে রিসোর্স রুমে হেল্পিং টিচারের দায়িত্বে থাকে সত্যবতী। বিভিন্ন ক্লাশ থেকে বিষয়ভিত্তিক এসাইনমেণ্ট নির্ধারিত সময়ে শেষ করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পরা শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার লক্ষ্যেই রিসোর্স টিচার নিয়োজিত। একটু পরপরই ইন্টারকমে অন্য শিক্ষকদের কল রিসিভ করা এবং তাঁদের পাঠানো বিভিন্ন ছাত্র-ছাত্রীর অসমাপ্ত এসাইনমেন্ট শেষ করিয়ে উদ্ধারের কাজটা সবসময় সহজ হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীর behavioral সমস্যা তাৎক্ষণিক হ্যান্ডেল এবং স্কুলে safe learning environment নিশ্চিত করে কাজ চালিয়ে নেয়া প্রায়শই এক চ্যালেঞ্জ মনে হয় সত্যবতীর। উপরন্তু যে শিক্ষার্থীর জন্য IEP বা Individual Educational Plan আছে তাদের অনেকেই ADHD (attention deficiency high per disorder) , Learning disability, slow learner, mild-intellectual disability (MID) অথবা Autism-এর মত সীমাবদ্ধতায় সীমাবদ্ধ। ‘শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর ‘বাক্যের কঠিন মর্যাদার মর্মটা এখন হাড়ে মজ্জায় উপলব্ধি করে সত্যবতী। প্রযুক্তির উন্মেষের সাথে সাথে শিক্ষাদানের গোটা প্রক্রিয়া এখন বিজ্ঞানের গতির অবাধ বেগে ক্রমধাবমান। ভালো না মন্দ, গ্রহনীয় না বর্জনীয়, যৌক্তিক না অযৌক্তিক-এই সব প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। শিক্ষার্থীর মনের অলি গলিতে প্রতিনিয়ত যে দ্ব›দ্ব বা যুদ্ধ চলে তাকে চিহ্নিত করে ‘মানসিক কাউন্সিলিং’ বিষয়টাই যেন এখন শিক্ষকতার সবচেয়ে জরুরী ধাপ বলে মনে হয় সত্যবতীর।

২।
ইন্টারকম বেজে উঠতে দ্রুত ফোনের দিকে এগিয়ে যায় সত্যবতী। রিসোর্স রুমে আজ বড্ড ভিড়। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা শিক্ষার্থীদের দিকে একঝলক তাকায় সত্যবতী। সামনে বসা মেয়েটার চোখ হাতের সেলফোনে মগ্ন। ব্যাপারটা একরকম ইগনোর করেই ইন্টারকম কল রিসিভ করে সত্যবতী। অন্যপাশে শিক্ষকের উদ্বেগ ঘন কণ্ঠ-আমি যে এক বুদ্ধিমান ‘রোমিও’ পাঠালাম তোমার কাছে তার খবর কি? ফাইনাল Culminating assignmentসহ ওভার ডিউ তিন তিনটা কাজ বাকি পরে আছে। এই সেমিস্টার তো প্রায় শেষ। Oh Boy! পাশ করাবো কিভাবে? অজানা উৎকণ্ঠায় ভিতরটা ধক ধক করে সত্যবতীর। ছাত্রের অসমাপ্ত কাজের দায়িত্বভার বুঝি এই মুহূর্তে ষোলআনা তারই উপর! ফোনের অন্য প্রান্তে ‘পাশ করাবো কিভাবে’ কথাটা ‘পাশ করবে কিভাবে’ হলে যেন কানে শুনতে আরাম হত সত্যবতীর। ‘আমি এখুনি দেখছি প্রিয়’ বলে ফোন রাখে সত্যবতী। আরে! শ্রীমান যে সেই বাথরুমে গ্যাছে ফিরেছে কি? সত্যবতীর হতাশ মন ক্লাশের চারপাশ ঘুরে বেড়ায়। দেরীর জন্য শাসন বার্তা শিকেয় তুলে ছেলেটাকে একপ্রকার ধরে বেন্ধে ডেস্কে বসায় সত্যবতী। রিসোর্স টিচার হিসেবে তার উদ্দেশ্য যে কোন উপায়ে শিক্ষার্থীর কাজ আদায়। ‘হেলথ’ বিষয়ক এসাইনমেন্ট প্রবন্ধের বিশয়বস্তুতে একটু ভ্যাবাচেকা খায় সত্যবতী। Alcohol, Cannabis এবং Birth control বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যুগুলো খুব টেকনিক্যাল এবং সেনসিটিভ মনে হয়। মনোযোগ না দিলে Assessment Rubric এর চাহিদা মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে এসাইনমেন্ট শেষ করা অসম্ভব। প্রবন্ধে এলকোহল, ক্যানাবিস ড্রাগের ব্যবহার স্বাস্থ্য প্রশ্নে কতোটা ক্ষতিকারক সেই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হাইলাইট করে ছেলেটার কাজ এগিয়ে দেয় সত্যবতী। Birth Control বিষয়ে কুইজ, শর্ট, লং প্রশ্নগুলো চোখে স্ক্যান করতে করতে ছাত্রের প্রশ্নে থমকায় সত্যবতী। আচ্ছা! কোন ড্রাগে relaxing and calming ভাবটা বেশি হয় বলতো? ক্যানাবিসে তোমার এক্সপিরিয়েন্স কেমন? বলে কি? ‘ক্যানাবিস’ নামটাই যে এই প্রথম শুনল সত্যবতী! শোন ডিয়ার! আমি স্বাস্থ্য সচেতন। তাই এলকোহল বা কোন নেশার ড্রাগে একেবারে অভ্যস্ত নই। ওকে ফাইন! ছেলেটি ঝটপট গুগল সার্চ করে উত্তর কপি, পেস্টের কাজ দ্রুত শেষ করে। দ্যাখো! উত্তর কিন্তু গুগলে দেয়া নেই- আর্টিকেলটা পড় তারপর তোমার নিজের মত উত্তর লিখো কেমন! একটু জোর খাটিয়েই বলে সত্যবতী। সত্যবতীকে বিস্মিত করে ছেলেটা বলে- কয়েকটা ‘case studz’ দেখে আমার মতামতটা যাচাই করে নিলাম।

এখন আমি ‘birth- control এসাইনমেণ্টটা শুরু করছি এবং তোমার সাথে বসে এক্ষুনি তা শেষ করে জমাও দিতে চাচ্ছি। তোমার ক্ষেত্রে birth control method এর কোনটা বেশি কার্যকর এবং সাস্থ্যসম্মত সেই অভিজ্ঞতা আমাকে সেয়ার কর। আমি আশা করছি এই বিষয়ে তুমি অলরেডি এক্সপিরিয়েন্সড! ছেলেটার কণ্ঠ জড়তাহীন। আগের সেই চঞ্চলতা এখন অনেক স্থির সংযত। কাজ শেষ করার লক্ষ্যে অবিচল সৈনিকের দৃঢ়তা চোখে মুখে। বিস্ময়াভিভূত সত্যবতীর যেন বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাও লোপ পায়।

সংস্কৃতির ভিন্নতার প্রশ্নে অনেক সময়েই এই জীবনে ‘কালচারাল সকড’ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আজ যেন অন্যরকম এক পরিস্থিতির মুখোমুখি সত্যবতী। তিন তিনটা আর্টিকেল ইস্যু ধুমধাম শেষ করে কিভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয় তাই যেন শিখিয়ে দিল ছেলেটা। এই সময়, এই প্রজন্ম, এই ক্লাশ, এই শিক্ষা ব্যবস্থা, কারিকুলাম সবটাই কেমন ভিন্ন! কেমন আলাদা বৈশিষ্টে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত! সত্যবতীর কাছে এই মুহূর্তে তা যেন আশ্চর্যময় মুল্যবান এক স্বর্ণ খনি ভাণ্ডার আবিস্কারের মত। জোনাকি! জীবনের এই লম্বা পথটা পাড়ি দিতে গিয়ে কত শত প্রশ্নের উত্তর আজ অবধি অজানাই রয়ে গেছে। শঙ্কায়, ভয়ে, দ্বিধায় শিক্ষক বা বড় কাউকে প্রশ্ন করার সাহসটাই ছিলোনা। শেখাটা, জানাটাও তাই উদার, উন্মুক্ত ছিলোনা, ছিল সীমাবদ্ধ, গণ্ডীবদ্ধ। দ্যাখো জোনাকি! Cultural shocked ব্যাপারটা কিন্তু এক মানুষের সাথে আরেক মানুষের, এক সমাজের সাথে অন্য সমাজের অনাকাঙ্খিত এক বিভেদ তৈরি করে দেয়। “It is not our differences that divide us. It is our inability to recognize, accept, and celebrate those differences”।

শোন জোনাকি! সংস্কৃতির ক‚পমণ্ডুকতা অগ্রাহ্য করার মানসিকতা অর্জনই বোধহয় এই মুহূর্তে সফল শিক্ষকতার শর্ত- আমার জন্য! তোমারও! (চলবে)।
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com