ঋতু মীর : “Self care is how you take your power back”
১।
জানো! তোমার পরামর্শ মত গতকাল রাতে আমি খুব তাড়াতাড়ি ঘুমাতে গেছি। প্রায় সাত ঘণ্টা একটানা ঘুমিয়ে সকালে উঠে শরীরটা যে কি ঝরঝরে মনে হোল! ভোরবেলা বিছানা ছাড়ার পর দেখি মাথাটা পাখীর পালকের মত হাল্কা। মেঝেতে পা নামিয়ে অন্য দিনের মত টলমলে হইনি একবারও। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে ব্যাক বা নেক পেইন যা প্রতিদিন জ্বালায় সেই মুহূর্তে তাও যেন উধাও! কি ভালো ব্যাপার তাইনা! Monday মানেই Blue, অথচ আজ সকাল শুরুর অবসাদ বা স্ট্রেস বিষয়টা শরীর মনের ধারে কাছেই ছিলোনা। কাজে বের হওয়ার জন্য একফোঁটা তাড়াহুড়া লাগেনি, আমার হাতে যথেষ্ট সময়ও যেন মজুত ছিল। তাছাড়া আবহাওয়ার চেহারা দেখে খিস্তি আর মুখ ব্যাজার করাও কিন্তু ছিল না। সবচেয়ে ভালো কি জানো? আকাশের মেঘলা থমথমে ভাব দেখেও আমার মনটা ভোরের স্নিগ্ধ তাজা হাওয়ায় কি দারুন ফুরফুরে হয়েছিল। চারদিকে সুনসান নীরবতায় পাখীর ক‚জন কানে এলো। চট করে দরজা খুলে উঠানে এসে দাড়াতেই একরাশ ভেজা ভেজা শিরশিরে হাওয়া এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আহা! নিদারুণ এই শীতের বরফ, স্নোর মহাবিপর্যয় শেষে প্রকৃতিতে বসন্ত আসছে ধীরে ধীরে। গাছে নতুন পাতা, সবুজ কুঁড়ি আর পাখি যে তাই জানান দিচ্ছে! তুমি বলেছিলে- mother nature তার নিজের নিয়মেই চলছে, চলবে। তার দিকে বিরক্তির আঙ্গুল তুলে নিজে কেন অযথা মেজাজ খারাপের রাস্তায় হাঁটার প্রস্তুতিতে সকাল শুরু কর? একদম ঠিক বলেছ প্রিয়! চোখ মুখ খুশির ঝলমলে হাসিতে ভাসিয়ে কাঁধ ঝাঁকায় সত্যবতী। বিশ্বাস কর বন্ধু! I am feeling such a huge positive differences in my mind and bodz today! Unbelievable! স্কুলের স্টাফ রুমের কাউচে আয়েশে হেলান দিয়ে বসা হল মনিটর ছেলেটার দিকে আগ্রহে এগিয়ে যায় সত্যবতী। তার চেয়ে বয়সে কয়েকগুন ছোট ছেলেটার ঠোঁটে স্মিত হাসি। শ্যামবর্ণ আর কোমল চেহারার আদলে তাকে সবসময় নিজ দেশী আর খুব আপন বলে মনে হয় সত্যবতীর। দিঘির স্বচ্ছ টলটলে পানির গভীর স্থিরতায় সে তাকায় সত্যবতীর দিকে। চোখাচোখি হতেই এক নির্ভরতার স্বস্তি সত্যবতীকে কাছে টানে। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরবর্তী কাজ এবং স্কুলে আসার আগ পর্যন্ত শরীর মনের অনুভুতি একান্ত আপনজনের মত অদম্য উচ্ছাসে তাকে সবিস্তারে বর্ণনা করে সত্যবতী। মানুষটা অখণ্ড মনোযোগে সত্যবতীর কথা শোনে। এক গুহাবাসী সন্যাসীর শান্ত ধীর ভাব ওর সর্বাঙ্গে। কি এক মন্ত্র মুগ্ধতায় চেয়ার টেনে ওর মুখোমুখি বসে পড়ে সত্যবতী।

২।
তোমার সুস্থ, সুন্দর শান্ত চেহারা আর ভালো থাকার রহস্যটা বলতো? উৎসাহের আতিশয্যে চেয়ারটা টেনে আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসে সত্যবতী। অদম্য আগ্রহে অন্যের ব্যাক্তিগত সীমানাটা অতিক্রম করার অভব্যতাটা সেই মুহূর্তে উপেক্ষা করে সত্যবতী। স্কুল হলওয়ে, রাস্তা, সামনে, পিছনে ইয়ার্ড, বাথরুম, ক্লাশ, জিম, ল্যাব সব মিলিয়ে গোটা স্কুলই যে কড়া নজরদারীতে রাখতে হয় তোমাকে। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীর ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে যত্রতত্র করিডোরে ঘুরাঘুরি, বাথরুমে যাওয়ার নাম করে ধুম করে ইস্কুল থেকে পালানো, পাবিøক প্লেসে বিহেভিয়ার ম্যনেজসহ তাদের নিয়ন্ত্রণ, সর্বোপরি নিরাপত্তা ব্যাপারটা প্রতি ঘণ্টায়, প্রতি মুহূর্তে সারাদিন ধরে ম্যানেজ করাতো চাট্টিখানি কথা নয়। প্রায়ই তোমাকে দেখি আর মুগ্ধ হই। এত কিছু মাথায় নিয়ে কি অদ্ভুত এক শক্তিশালী ক্ষমতায় এই গুরু দায়িত্ব পালন করছ। আচ্ছা! এই যে সারাক্ষন অতন্দ্র প্রহরীর মত সজাগ সতর্ক সময়- তাতে কি দিন শেষে ক্লান্ত লাগে না তোমার? স্কুলের কাজের শেষে প্রতিদিন নিজে কতোটা ক্লান্ত, বিমর্ষ হয়ে পড়ে সেই তুলনামুলক ব্যাখায় যায়না সত্যবতী। স্ট্রেস এড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সামাল দিয়ে চলার কৌশল, ব্যাক্তি অভিজ্ঞতা শোনাটাই খুব প্রয়োজনীয় মনে হয়। শোন সত্য! যেসব প্রসঙ্গ টেনে তুমি উৎকণ্ঠিত হচ্ছ আমি সেগুলোকে জীবনের অংশ বলে মনে করি। কাজের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই। সেক্ষেত্রে নিজেকে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে প্রস্তুত করতে হবে। আমি বেশ কড়া নিয়ম মেনে চলা মানুষ। হাল্কা হাসিতে কথায় একটা যতি টেনে আবার শুরু করে সে- বিশেষ করে self care বা নিজের যত্নের প্রশ্নে আমি কোন কিছুর সাথে compromise করি না বলা চলে। নিজের যত্ন? কিভাবে সম্ভব হয় বলতো? সত্যবতীর চোখে ঔৎসুক, কণ্ঠে একরাশ উৎকণ্ঠা। চাকরী, ঘর, সংসার, বন্ধ্তুা, সামাজিকতা, আত্মীয়তা- সব মিলে যে এত্ত এত্ত কাজ চারপাশে। ‘নিজের সময়’ বলে যে আর কিছুই থাকেনা। অবশিষ্ট থাকে শুধু ক্লান্তি! ক্লান্তি! ক্লান্তি! হতাশায় কান্নার মত শোনায় সত্যবতীর কণ্ঠ। তুমি চাইলেই সেটা সম্ভব সত্য! ভেবে দ্যাখ! নিজের জন্য মাত্র আধ ঘণ্টাও ব্যয় করছোনা বলে তুমি প্রকারান্তরে কত ঘণ্টা পিছিয়ে যাচ্ছ। সেই পিছিয়ে যাওয়া হয়তো আপাত চোখে পড়ছে না, কিন্তু সেটা একটু একটু করে তোমাকে রাহুর মত গ্রাস করছে। নিজের জন্য সময় বরাদ্দ করা, নিজের যত্ন নেয়া অন্ত্যন্ত জরুরী জেনেও কিন্তু আমরা বোধহীন ব্যস্ত জীবন টেনে চলি। উদাহরণ টেনে বলে- আমার দিন শুরু হয় অনেক ভোরে। ছাত্র জীবন থেকেই আমার অভ্যাস রাত নয়টার মধ্যে বিছানায় যাওয়া। শুধু ‘বিছানায় ঘুমাতে যাওয়া’ শব্দটা ক্যাচ করোনা সত্য! জেনো! ঠিক সেই সময় থেকেই আমি নিজের জন্য, নিজের সময়কে নিয়ে নিজের ‘বাউন্ডারী’ তে ঢুকে পড়ি। সেলফোন, টিভি থেকে শুরু করে খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া, সামাজিক আদান প্রদান সব কিছু থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেই আমি ঘুমের জন্য প্রস্তুত হই। টানা আট ঘণ্টা একনাগাড়ে ঘুমিয়ে ওঠার পর যে সকাল শুরু হয় তার সুন্দর অনুভূতি তুমি নিজেও ইতিমধ্যে কিছুটা টের পেয়েছ। এছাড়াও সাস্থ্য রক্ষা করে খাদ্য নির্বাচন, ব্যায়াম, মেডিটেশন- এ সব কিছুই আমার নিজস্ব রুটিন মাফিক চলে। শোন সত্য! স্বর্গীয় হাসিতে পবিত্র দেখায় মানুষটার মুখ। ভালো এবং সুস্থ থাকা, পসিটিভ এনার্জিতে নিজেকে বুস্ট-আপ করার কৌশলই হল-self care, self love, self respect, self reflection! শরীর এক যন্ত্র, মন হোল তার ইঞ্জিন। শরীর ঠিক রাখতে হলে মনের স্বাস্থ্যটাও কিন্তু ঠিক রাখতে হবে। আচ্ছা! কেবল নিজেকে নিয়ে, নিজের জন্য বাঁচার ব্যাপারটা কি একধরণের ‘স্বার্থপরতা’ বলে মনে হয় না তোমার? প্রশ্নবোধক চোখে তাকায় সত্যবতী। জেনে রাখো সত্য! “You yourself, as much as anybodz in the entire universe deserve your love and affection. এখন সময় যেন কেবল ঊর্ধ্বশ্বাস আর ছোটা। সোনার হরিণ জয় যেন আমাদের অন্তিম লক্ষ্য। সমস্ত কিছুর মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে আমরা যেন নিজেই নিজের সময়কেই ধ্বংস করছি। যে মানুষ নিজেকে জানে না, নিজেকে শ্রদ্ধা বা ভালবাসেনা বা নিজের জন্য সময় রাখেনা বা নিজেকে বিশ্লেষণে প্রতিফলিত করেনা সে আসলে নিজেই নিজেকে ঠকায়। মনে রেখো! If you take care of your mind, take care of yourself, you take care of the world। হাতে রাখা কাগজপত্র, ব্যাগ গুছিয়ে ক্লাশের দিকে পা বাড়ায় সত্যবতী। দিনশেষে একটা সার্থক পাঠদানের তৃপ্তি অসাধারন এক দৃপ্ত প্রজ্ঞার আলো ফেলে সত্যবতীর মুখে। আশ্চর্যজনক ভাবেই অন্যদিনের মত আজ নিজেকে ততটা ক্লান্ত লাগে না তাঁর। এবার বাড়ি ফিরবে সে! (চলবে)
Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com