সিনহা মনসুর : এক.
অতি স¤প্রতি একটি বই পড়েছি। বইটির নাম: ‘The Story of My Experiments with Truth’! বইটির লেখক মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী। আমাদের কাছে তিনি গান্ধীজী নামে পরিচিত। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাকে রাষ্ট্রপিতা বলে সম্বোধন করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা’কে মহাত্মা উপাধি দিয়েছিলেন। উইনসটোন চার্চিল তাকে ‘ফকির’ বলে সম্বোধন করতেন। ‘Half Naked Saint’ বা ‘অর্ধনগ্ন সাধু’ বলতেন ফ্র্যানক মোরস।

মহামতি শেক্সপিয়র বলেছিলেন:
‘What’s in a name? That which we call a rose by any other name would smell as sweet’! অর্থ্যাত ‘নামে কি আসে যায়? গোলাপকে অন্য নামে ডাকলেও গোলাপ সৌরভ ছড়াবেই’!

রাষ্ট্রপিতা, মহাত্মা বা অর্ধনগ্ন সাধু নামের আড়ালে যে মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী- তিনি সেই সুবাস ছডিয়েছেন। ছডিয়েছেন বলেই ১৯৩১ সালে পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন গান্ধীজীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন! ঐ চিঠিতে মহাজ্ঞানী আইনস্টাইন গান্ধীজীকে বলেছিলেন:
‘A role model for the generations to come’!
‘The Story of My Experiments with Trut’ বইটি গান্ধিজীর জীবন কাহিনী। মূল বইটি গুজরাটি ভাষায়। এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মহাদেব দেশাই।
বইটিতে কিছু জীবন সত্যের কথা আছে!
আছে দর্শন!

ঐ বইতে গান্ধিজী বলেছেন:
‘যদি আমি খ্রিস্টান ধর্মকে নিখুঁত এবং শ্রেষ্ঠতম ধর্ম হিসেবে মেনে নিতে না পারি, তবে হিন্দু ধর্মকেও সেভাবে মেনে নিতে পারি না। হিন্দু ধর্মের ত্রুটিগুলি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যদি অস্পৃশ্যতা হিন্দু ধর্মের অংশ হয় তবে, এটি একটি পচা অংশ বা আঁচিল।
বেদ বাক্যগুলোকে ঈশ্বরের অনুপ্রাণিত উক্তি বলার কারণ কি? যদি এগুলো অনুপ্রাণিত হয় তবে বাইবেল বা কোরআন কেন নয়!

যখনি আমরা নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলি, আমরা ধার্মিক হওয়া থেকে ক্ষান্ত হই। নৈতিকতা হারিয়ে ধার্মিক হওয়া বলতে কিছু নেই। উদাহরণস্বরুপ, মানুষ মিথ্যাবাদী, নির্মম এবং আত্মসংযমহীন হয়ে দাবি করতে পারে না যে ঈশ্বর তার সাথে আছেন’!
গান্ধিজীর এই উক্তি আমাদেরকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে!
এর বহু পরের কথা। গান্ধিজীর তখন বয়স হয়েছে। একদিন তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো তিনি হিন্দু কি না?

গান্ধিজী বললেন:
‘হ্যাঁ, আমি তাই। এ ছাড়াও আমি একজন খ্রিস্টান, একজন মুসলিম, একজন বৌদ্ধ এবং একজন ইহুদি’!
তার মানে তিনি ছিলেন মানবতাবাদী!
গান্ধীজী শুধু ভারতে নয়, পুরো বিশ্বেই মহাত্মা বা মহান আত্মা নামে পরিচিত ছিলেন! তার অহিংস মতবাদ প্রভাবিত করেছে মার্কিন বর্নবাদী নেতা মার্টিন লুথার কিং ও জেসম লওসনকে। প্রভাবিত করেছে নেলসন মেন্ডেলাকেও!
দুই.
গান্ধিজী শুধু বড় নেতাই ছিলেন না! ছিলেন বড় মানুষও! মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৮৮৮ সালে উনি ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে পাড়ি জমান। লন্ডনে যাওয়ার আগে গান্ধিজীর মাতা তাকে বললেন ওখানে যেয়ে মাংস, মদ আর মেয়ে মানুষ ছোঁয়া যাবে না!
জৈন সন্ন্যাসি বেচার্জীর সামনে গান্ধিজী তার মায়ের কাছে শপথ করেছিলেন যে তিনি মাংস, মদ এবং মেয়ে মানুষ ছোবেন না! দীর্ঘ পরবাসে তিনি মায়ের নিষেধ মেনে চলেছেন। অনৈতিকতা ত্যাগ করে হিন্দু নৈতিকতা মেনে চলেছেন। ভোজন করেছেন নিরামিষ! এটি সেকালে যেমন দেখা যায়নি, দেখা যায় না একালেও!

মহাত্মা গান্ধী ব্যারিস্টারী পাশ করার পর বেশ কিছুদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন। ওখানেই তিনি প্রথম সোচ্চার হন ভারতীয় নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে।

তবে তার পথ ছিল ‘অহিংসার’ পথ! ভারতে ফিরে আসার পরে কয়েকজন দুঃস্থ কৃষক এবং দিনমজুরকে সাথে নিয়ে বৈষম্যমূলক কর আদায় ব্যবস্থা এবং বহু বিস্তৃত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসার পর গান্ধী সমগ্র ভারতব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণ, জাতির অর্থনৈতিক সচ্ছলতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার শুরু করেন। এর সবগুলোই ছিল স্বরাজ অর্থাত ভারতকে বিদেশী শাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে।

১৯৩০ সালে গান্ধী ভারতীয়দের লবণ করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। এই প্রতিবাদের নাম ছিল ‘লবণ সত্যাগ্রহ বা ডান্ডি পদযাত্রা’। ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ ডান্ডি পদযাত্রা বা লবণ সত্যাগ্রহ শুরু হয়। মহাত্মা গান্ধী ঐদিন আমেদাবাদের কাছে তাঁর আশ্রম থেকে ডান্ডি পদযাত্রা শুরু করেন। ২৪ দিনে ২৪০ মাইল পথ পায়ে হেঁটে তিনি পৌঁছেন ডান্ডি গ্রামের সাগর পাড়ে। হাজার হাজার ভারতীয় তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ১৯৩০ সালের ৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৬টার সময় গান্ধীজি ব্রিটিশ সরকারের লবণ আইন ভেঙে প্রথম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন, ডান্ডির ঐ সমুদ্রসৈকতে!
সেই সঙ্গে তাঁর লক্ষাধিক অনুগামীও লবণ আইন ভেঙে ভারতে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করলেন। এই আন্দোলনের ফলে ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ব্রিটিশদের মনোভাব অনেকটাই বদলে যায়।

তিন.
গান্ধীজী একবার বেড়াতে গিয়েছিলেন রবী ঠাকুরের শান্তি নিকেতনে। রবীঠাকুর তখন শান্তি নিকেতনের বাইরে ছিলেন। বেড়াতে এসে গান্ধীজী শান্তি নিকেতনের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের মধ্যে একটি নূতন রেওয়াজ চালু করলেন। আর এই রেওয়াজটি হচ্ছে: কারো ওপর নির্ভর না করে নিজেদের রান্না বান্না নিজেদেরই করতে হবে, নিজেদের ঘরদোর নিজেদেরই পরিষ্কার করতে হবে। বাসন মাজার জন্য বাইবের কারো সাহায্য নেওয়া চলবে না।
শুধু তা নয়, যা খুশি তাই রান্না করলেই হবে না। এমন খাবার খেতে হবে যার যথেষ্ট খাদ্যগুণ আছে। শান্তি নিকেতনে বেশ একটা আলোড়ন পড়ে গেল। তাই বলে পাচকদের কিন্তু চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হল না। একদল তরকারি কুটছে, একদল চাল-ডাল ধুচ্ছে। একদল রান্না করছে, একদল বাসন মাজছে। যারা বাসন মাজছে, যারা ধুয়ে পরিষ্কার করছে বড় বড় পাত্র, তাদের তো বিরাট পরিশ্রম হচ্ছে! তাই তাদের ক্লান্তি দূর করার জন্য একদল আবার তাদের কাছে বসে বাজাতে শুরু করেছে সেতার!

সে কি অভিনব দৃশ্য!
সে কি আনন্দ দৃশ্য!
একসময় রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন শান্তিনিকেতনে। তিনি ছাত্র-শিক্ষকদের এই সব কান্ডকারখানা দেখলেন খুব কাছ থেকে। কোন কথা বললেন না।
কিন্তু তাঁর মুখে ছিল তৃপ্তির মৃদু হাসি!

চার.
মহাত্মা গান্ধী সব পরিস্থিতিতেই অহিংস মতবাদ এবং সত্যের ব্যাপারে অটল থেকেছেন। তিনি বড় সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার নিজের পরিধেয় কাপড় ছিল ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় ধুতি এবং শাল যা তিনি নিজেই চরকায় বুনতেন।

তিনি সাধারণ নিরামিষ খাবার খেতেন। শেষ জীবনে ফলমূলই বেশি খেতেন। আত্মশুদ্ধি এবং প্রতিবাদের কারণে দীর্ঘ সময়ের তিনি জন্য উপবাস থাকতেন।
মৌলবাদীরা এই গান্ধীকেও ছাড় দেয়নি! ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় তিনি নতুন দিল্লীর বিরলা ভবনের মাঝে রাত্রিকালীন পথসভা করছিলেন। তার হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিলেন একজন হিন্দু মৌলবাদী যার সাথে চরমপন্থী হিন্দু মহাসভার যোগাযোগ ছিল।

ইতিহাসবিদ সোহেল হাশমীর ভাষ্যমতে, গুলি ছোড়ার আগে গডসে, গান্ধীজীর দিকে ঝুঁকে প্রণাম করেন। গান্ধীজির মুখ থেকে নিঃসৃত শেষ কথাটি ছিল ‘হে রাম’!

তার মৃত্যুতে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন:
‘বন্ধু ও সহযোদ্ধারা আমাদের জীবন থেকে আলো হারিয়ে গেছে এবং সেখানে শুধুই অন্ধকার এবং আমি জানি না আপনাদের কি বলব কেমন করে বলব। আমাদের প্রেমময় নেতা যাকে আমরা বাপু বলে থাকি, আমাদের জাতীর পিতা আর নেই। হয়ত এভাবে বলায় আমার ভুল হচ্ছে। তবে আমরা আর তাকে দেখতে পাব না যাকে আমরা বহুদিন ধরে দেখেছি, আমরা আর উপদেশ কিংবা স্বান্ত¡নার জন্য তার কাছে ছুটে যাব না, এবং এটি এক ভয়াবহ আঘাত, শুধু আমার জন্যই নয়, এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য’!

পাঁচ.
গান্ধীজী’র ইচ্ছানুযায়ী,তার দেহভস্ম বিশ্বের বেশ কয়েকটি প্রধান নদী যেমন: নীলনদ, ভোলগা এবং টেমস ছডিয়ে দেয়া হয়!
কিছু অংশ পুণের একজন সাংবাদিক ও প্রকাশক ডঃ ভি এম নোলের পক্ষ থেকে পরমহংস যোগানন্দকে পৌঁছে দেয়া হয়।
দিল্লি রাজকোটে গান্ধীজিকে সমাধিস্থ করা হয়েছে।
এছাডাও গান্ধীজী’র দেহভস্মের কিছু অংশ সেলফ রিয়ালাইজেশন ফেলোশিপ, লেক স্রাইনের মহাত্মা গান্ধী বিশ্ব শান্তি সৌধের একটি পাত্রে সংরক্ষিত আছে! ওই চৈনিক পাথরের পাত্রটি হাজার বছরের পুরনো!
হাজার বছরের পুরনো পাত্রে ঘুমিয়ে আছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান গান্ধীজী!
একজন মানবতাবাদী! সিনহা মনসুর।