স্বপন কুমার সিকদার : মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা বা সমাজের প্রতিটি সদস্যের স্বার্থের প্রতি গভীর অনুরাগই হলো মানবতা। এটি সাধারণ মানুষের প্রয়োজন ও সমস্যাবলি যৌক্তিকভাবে সমাধানে কাজ করে। পরোপকার, দয়া, ক্ষমা প্রভৃতি মনুষ্যোচিত গুণাবলি মানবতা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ। হীনতা, লালসা ও সংকীর্ণতাকে পরিত্যাগ করে চরিত্রকে সুষমামণ্ডিত করতে পারলে মানবতার উৎকর্ষ সাধিত হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ মূলত মানুষকে কেন্দ্র করে। সকল ধর্মের মূল শিক্ষা হল মানবতা। মানুষের সুখদুঃখ, হাসিকান্নায় ধর্ম তার আবেদনময়ী হাত প্রসারিত করেছে। একটি সুন্দর সমাজ গড়তে হলে প্রয়োজন মানবতা। তিনিই ধর্মের প্রকৃত অনুসারী, যিনি মানবতার শিখা জ্বালান। সমাজে সেই ব্যক্তির মর্যাদা উচ্চ, যিনি সর্বদা মানবতার উন্নতির জন্য কাজ করেন।

মানবতাবাদী মানুষের লক্ষ্য মানবকল্যান।মানবতাবাদ হচ্ছে এমন একটি পার্থিব জীবনদর্শন যা যুক্তিতর্ক, নৈতিকতা ও সুবিচারকে ধারণ করে। ‘যে দর্শন মানুষের চিত্তে মনুষ্যত্ববোধের জাগরণ ঘটায়, মানবিকতাবোধের উন্মেষ করে, মানুষের মর্যাদার প্রতি আস্থাশীল হয়, মানুষের সুখ-শান্তি-কল্যাণ ও সর্বাঙ্গীন উন্নতি-অগ্রগতির জন্য নিবেদিত থাকে তাই মানবতাবাদী দর্শন’। মানবতাবাদ মানব প্রজাতির নিজস্ব চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে গঠিত জীবনতত্ত¡, যা মানবীয় প্রবৃত্তির সাথে যতোটা সম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ ও যার লক্ষ্য মানুষের সুখশান্তি বর্ধিতকরণ। মানবতাবাদ দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষনা করে, “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস ও কর্মকাজের উর্দ্ধে একজন মানুষের পরিচয় তিনি মানুষ।

মানবতার প্রধান শিক্ষা এটিই যে দানের মাধ্যমে মানুষ কখনোই ফকির হয়ে যায় না। কোন ব্যক্তি যদি সম্মানিত হয়, তবে তা মানবিক হওয়ার জন্য প্রতিদান হিসেবে পেয়েছে। টলস্টয় বলেছেন, “জীবনের মূল মানেটা হলো নিজের সব কিছু দিয়ে মানবতার সেবা করা”। মাদার তেরেসা বলেন, “যে জীবন অন্যের জন্য নয়, সেটি কোন জীবন না। আমরা কতটা দান করেছি, তার চাইতেও মুখ্য বিষয় হলো, সেখানে কতটা ভালবাসা ছিল”। রোনাল্ড রিয়াগান বলেন, “আমরা হয়তো সকলকেই সাহায্য করতে পারব না, তবে আমরা কাউকে না কাউকে সাহায্য করতে পারব। আর এটাই হলো মানবতা”। মনুষ্যত্ব ছাড়া মানুষ মূল্যহীন। মানুষের মনুষ্যত্বের মূল উপাদান ক্ষমা, ভালোবাসা, উদারতা, সহমর্মিতা, সততা, সহনশীলতা ইত্যাদি। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেন, “জীবনের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হল: আপনি অন্যদের জন্য কি করছেন?” মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হ’ল সেবা, সহানুভ‚তি এবং অন্যকে সাহায্য করার ইচ্ছা প্রদর্শন করা। থিওডোর রোজভেল্ট বলেন, “আপনি যেখানে আছেন সেখান থেকেই, আপনার যা আছে তা দিয়ে, আপনি যা পারেন তাই করুন”। আধুনিক মানবতাবাদ বলে, “কোন ধর্ম যদি মানুষের উন্নতি সাধন করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই যুগের সাথে তাল মেলাতে হবে।”। মানবতাবাদী কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হল, এই জীবন সুন্দরভাবে যাপন করা ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য, মনোরম পরিবেশ রেখে যাওয়া।

মানবতাকে ধ্বংস করে কোনো ধর্মই টিকে থাকতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘যত্র জীব, তত্র শিব’। জীবপ্রেমের দর্শন প্রকাশ পেয়েছে উনার এই দুটি পঙ্ক্তিতে: ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবপ্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’। তিনি ঘোষণা করলেন : ‘মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমরা সবাই ভাই।’ স্বামী বিবেকানন্দ বলেন : “প্রত্যেক ধর্মই অপর অপর ধর্মপথের শ্রেষ্ঠ তত্ত¡গুলো নিজের মধ্যে গ্রহণ করে শক্তিলাভ করবে – নিজের বিশেষত্ব বর্জন না করে আপন আপন প্রকৃতি অনুযায়ী বিকশিত হয়ে উঠবে”। মহামানবগনের কথার প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেন, ‘সমস্ত জগতের মানুষ একই ঈশ্বরের সন্তান’। তিনি মনে করেন, মানুষের অভিজ্ঞতা ও সভ্যতাকে বিকশিত করা, জীবনযাপনের ধরন, শান্তি-সমৃদ্ধি, এবং মানবতার বিকাশের জন্য বিশ্বের সকল ধর্মের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

পবিত্র হিন্দুধর্মের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো ফলের প্রত্যাশা না করে কাজ করা। ব্যক্তিক লাভালাভের প্রত্যাশা না করে কোনো কাজ করা হলে তা সমাজের হিত লাভের কারণে পরিণত হয়। মানুষ তখন আর ব্যক্তিগত লোভ-লালসা বা পুরস্কারের প্রত্যাশায় আবদ্ধ থাকে না, তখন সে বিশ্বের সকলের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখতে শেখে। এই ধর্মমতে মানুষ কেবল মৃত্যুর পরেই স্বর্গলাভ করে না, পৃথিবীতে থেকেও সে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে বাস করে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখে স্বর্গসুখ লাভ করতে পারে। মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে, যা ইহলোকে উন্নতি এবং পরলোকে মোক্ষলাভ করায় তাই ধর্ম। ভারতীয় জনগোষ্ঠীর এক বৃহদংশ পুনর্জন্ম এবং তার ওপর কর্মের প্রভাব সম্পর্কে আস্থাশীল। উক্ত কর্মবাদ বিশ্বাস করে, পূর্বজন্মের কর্মের ওপর পরবর্তী জন্মের সুখদুঃখ নির্ভরশীল। এই জন্য মানুষ স্বভাবতই নিজেকে নৈতিক স্খলন এবং সামাজিক অনাচার থেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হয়। তাদের বিশ্বাস, খারাপ কিছু করলে পরবর্তী জীবনে তার ফল ভোগ করতে হবে। পুনর্জন্ম বিশ্বাস ইহজীবনের ভোগলালসা থেকে বিরত রেখে তাদের আরও ত্যাগী ও মানবিক করে তোলে। উপনিষদে বর্ণিত নিরাকার ব্রহ্ম সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও সময়ের পরিবর্তনে উক্ত ধারণার পরিবর্তন ঘটে এবং বর্তমানে হিন্দুরা নিরাকার ব্রহ্মের বিভিন্ন ক্ষমতাকে সাকার কল্পনায় দেবতা হিসেবে পূজা করে। তারা মনে করে, নিরাকার ঈশ্বরের চেয়ে সাকার ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধার্পণ অনেক সহজ। নিরাকার ঈশ্বর সম্পর্কে উপনিষদীয় মতবাদের সাথে বিভিন্ন দেবতার প্রতি ভক্তিযুক্ত পূজার্চনার মিশ্রণ একটি নতুন ধর্মীয় চেতনার জন্ম দেয়, যা ধর্মীয় চিন্তাচেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে ও তাদের বিশ্বমানবতায় উদ্বুদ্ধ হতে অনুপ্রানিত করে।

পবিত্র ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী একজন মুসলমানের ধর্মীয় জীবন অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায় যদি তিনি মানবকল্যাণে অংশ গ্রহণ না করেন। পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে : “আত্মীয়ের সাথে সর্ম্পক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না”।[১৫]
প্রতিবেশীর ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক না কেন, ইসলাম ধর্মে মুসলমানদের প্রতিবেশীর সাথে যথাসাধ্য বিনয় আচরণ প্রদর্শন করতে এবং তাদের অসুবিধা হতে পারে এমন কোন কাজ সৃষ্টি না করার কথা বলা হয়েছে। [১৬] [১৭]
পবিত্র হাদিস শরীফে মুহাম্মাদ (দঃ) এরশাদ করেন, সেই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট ভরে খায়, আর পাশেই তার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে [১৮]। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপধবোধ করেনা সে ব্যক্তি ঈমানদার নয়”। [১৯] মুহাম্মাদ (দঃ) উনার বিদায় হজ্বের ভাষণে জাতিগত বৈষম্যকে বর্জনের নির্দেশ দেন।

মহামতি বুদ্ধ, বুদ্ধত্ব লাভ করার পর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখ ও মঙ্গলের জন্য এমন ধর্ম প্রচার করো, যে ধর্মের আদি, মধ্য এবং অন্তে কল্যাণ’।পবিত্র বৌদ্ধধর্মের অন্যতম মূল বাণী হচ্ছে অহিংসা,শান্তি, মৈত্রী ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সহাবস্থান করা। ভগবান বুদ্ধ চেয়েছেন মধ্যম পন্থার মাধ্যমে ‘সকলের জন্য অধিক সুখ প্রতিষ্ঠা’।তিনি বলেছেন, অসাধুকে সাধুতার দ্বারা, মিথ্যাকে সত্যের দ্বারা, কৃপণতাকে ত্যাগের দ্বারা জয় করতে হয়। উনার কালজয়ী আহ্বান হলো ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক’। তাঁর মতে, মানুষকে চিন্তা ও কর্ম উভয়েই সৎ হতে হবে। তিনি বলেন, অপরের উন্নতিতে আমার উন্নতি, অপরের কল্যানে আমার কল্যাণ, অপরের শান্তিতে আমার শান্তি এই মনোবৃত্তি জাগ্রত করতে হবে সবার হৃদয়ে। মানুষ যদি জীবনাচরনে,কর্মে, চিন্তায়, জ্ঞান ও মননশীলতায় বড় না হয়, তাহলে শ্রেষ্টত্ব অর্জন করতে পারেনা। তাঁর মতে, প্রার্থনায় কখনও মুক্তি আসে না, যদি সৎচিন্তা ও সৎ কর্ম করা না হয়। মানবতার মুক্তিই ছিল ভগবান বুদ্ধের নিরন্তর সাধনা।
পবিত্র বাইবেল বলে, “Each life is truly a gift from God. We can honor His gift by cherishing our own lives as well as respecting and valuing the lives of others.”

সারা বিশ্বে এখন নিজ নিজ ধর্মরক্ষার দোহাই দিয়ে অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো এক ধরনের অলিখিত প্রবণতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বঞ্চনা-শোষণের বিরুদ্ধে ঘৃণা, সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাচেতনার বিরোধিতা, অন্যায় থেকে মুক্তি ইত্যাদির পক্ষে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যদর্শন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মহিমামন্ডিত। তিনি বলেছেন, মানুষের হৃদয় হচ্ছে উত্তম জায়গা, যেখান থেকে ধর্মচর্চার বিষয়টি নির্ধারিত হয়। তিনি বলেন : “এই রণ-ভ‚মে বাঁশির কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,/এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা। …মিথ্যা শুনিনি ভাই,/এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই”।তাঁর রচিত সাহিত্যের প্রধান উপাদান মানবতাবাদ, সাম্যবাদ আর অসা¤প্রদায়িক চেতনা। কবি নজরুল মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনন্য। তিনি বিশ্বমানবতার কবি। তিনি বলেছেন, “আজ চারদিক হতে ধনিক বণিক শোষণকারীর জাত, ও ভাই জোঁকের মতো শুষছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত”। এই চিত্র মানবতার জন্য নিদারুণ লজ্জা ও অপমানের। কবি বলেছেন -“চাষা বলে কর ঘৃণা! তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে রবে চিরকাল।”। তিনি ছিলেন শোষিতের বন্ধু। তিনি দিয়ে গেছেন শোষিত, নির্যাতিতের কন্ঠে প্রতিবাদের ভাষা। তিনি পূঁজিবাদী শ্রেণীর হাত থেকে সর্বহারাদের রক্ষা করতে চেয়েছেন। মানবতাবাদী কবি নজরুল সকল ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রবিধি অপেক্ষা মানুষকে বড় করে দেখেছেন – “তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে নিজ প্রাণ”। মানবতাবোধের কারণেই তিনি বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষকে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের পতাকা তলে আহবান জানিয়েছেন – “সকল কালের সকল দেশের মানুষ আসি, এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুনো এক মিলনের বাঁশী”। কবি তাঁর হৃদয়বীণায় মানবজাতির ঐক্যের জয়গান করে মানবতার পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। নজরুলের উদাত্ত আহŸান, মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে মানুষের মর্যাদায়, গ্রহণ করতে হবে মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে। মানবতার কবি নজরুলের বলিষ্ঠ উচ্চারণ: “ভেদ বিভেদের কথা বলে যারা, তারা শয়তানের চেলা”। তিনি ছিলেন সমাজ, রাষ্ট্র তথা একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকারের উদ্দীপ্ত কবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এদেশ স্বাধীন করার পেছনে নজরুলের বিদ্রোহী, অসা¤প্রদায়িক ও সাম্যবাদী চেতনার প্রতিফলন অত্যন্ত গভীর। কবি বলেছেন : “হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, মানবতার এই মহান যুগে একবার গন্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি ব্রাহ্মন নও, শুদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমানও নও, তুমি মানুষ”। তিনি বলেন, “ও কারা কোরাণ বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি, … যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে, পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মুর্খরা সব শোন, মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনও”। উনার মতে মানুষের জন্যই ধর্মগ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ অপেক্ষা মানুষ অনেক মহীয়ান।মানবতাবাদী কবি নারী জাতির মর্য্যাদা রক্ষায় সোচ্চার হয়ে বলেন, “সেদিন সুদুরে নয়, যেদিন ধরনী পুরুষের সাথে গাইবে নারীরও জয়”। পথ-প্রদর্শক কবি নজরুল লিখেছেন, ‘মম এক হাতে – বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য’। কবি বুঝাতে চেয়েছেন, সুন্দর সমাজ বিনির্মানে ভালবাসা ও কঠোরতা দুটোরই প্রয়োজন এবং বৈপরীত্য তথা রণ-তূর্যকে বাঁশিতে পরিণত করাই নেতৃত্বের কাজ।

রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদের মূলে রয়েছে মানবিকতা ও মানবকল্যান। তিনি বলেন, ‘মনুষ্যত্ব শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন’। তাঁর মতে, মানুষকে বাদ দিয়ে বিশ্বজগৎ, পারলৌকিক জগৎ, ধর্ম কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। তিনি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হৃদয়গহীনে লালন করেছেন মানবমুক্তির দর্শন। তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্বমানবতায়। তিনি বলেছেন, ‘মানুষের ধর্ম মানুষের পরিপূর্ণতা।’ তাঁর চিন্তাচেতনায় ছিল শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ ও মুক্তচিন্তা। উনার ভাষায়, ‘মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে, সে মানুষ’। রবীন্দ্রনাথ আমাদের অন্ধকার দূর করে আলোর পথে, জ্ঞানের পথে; ক‚পমণ্ডুকতা ও সংকীর্ণতা দূর করে স¤প্রীতির পথে চলার উৎসাহ দেন। তিনি বলেন, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। তিনি সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে অভিসারী হয়ে ওঠার প্রেরণা জুগিয়ে বাঙালি মননকে বিশ্বমানে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী অসা¤প্রদায়িক চেতনার কবি। তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমাদের প্ররোচিত করেছিল ভাষা-সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্যের ঐক্যের ভিত্তিতে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের মানুষের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগের মূলমন্ত্র রূপে গেয়ে উঠেছিলেন- “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”। বিশ্বমানবতার মোহে উদ্দীপিত রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন মনের মধ্যে মানবতার প্রদীপ জ্বেলে মানবযাত্রী এগিয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে সত্যের খোঁজে।এই মানবের কাছেই তিনি তাদের আপন মানুষ হিসেবে অবস্থানের ঘোষণা দিয়ে বলেন – “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।”। স্বাধিকার আন্দোলনে বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও মানুষের অধিকার উন্মোচনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কিংবদন্তীর সমতুল্য – এক মহীরুহ। মানব সভ্যতার ইতিহাস মানেই ধর্মের ইতিহাস। তিনি প্রথাগত ধর্মকে না বুজিয়ে ধর্ম হিসাবে বিশেষ করে মানবতাবাদের বিষয়টিকে সুচিত করেছেন।

গণমানুষের কবি সুকান্ত মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তিনি নতুন প্রজন্মের জন্যে সুন্দর পৃথিবী রেখে যাওয়ার দৃঢ় শপথ নিয়ে বলেন, “এসেছে নতুন শিশু, … প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল অবশেষে সব কাজ সেরে, আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে করে যাব আশীর্বাদ, তারপর হব ইতিহাস”।
কবি জীবনানন্দ দাশ বিশ্বচেতনার সঙ্গে নিজের চেতনাকে যুক্ত করে বলেন- ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া”। তিনি শুধু বিস্ময়েরই কবি নন, অসা¤প্রদায়িক চেতনারও প্রতিনিধি। ‘ঝরা পালক’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন-‘মহামৈত্রীর বরদ তীর্থে পুণ্য ভারত পুরে/ পূজার ঘণ্টা মিশিছে হরষে নামাজের সুরে সুরে”। তিনি মানুষে মানুষে শ্রেণীবৈষম্য ও ভৌগোলিক সীমান্ত অতিক্রম করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের মাধ্যমে মানবতার জয়গান গেয়েছেন।

ক্ষুধা-পীড়িত মানুষের হাহাকার-আর্তনাদ, জরাগ্রস্ত বাস্তবতা, সা¤প্রদায়িকতায় ব্যথিত কবি ফররুখ আহমদ আমাদের মানবতার পথে আহ্বান জানান। তিনি বলেন – “জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি; দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরী, কত দেরী”।

যত দিন যায় ধনী আরো ধনী হয়, গরীব আরো নিঃস্ব হয় – মরে অনাহারে, অপুষ্টিতে, অচিকিৎসায়।যুদ্ধের ময়দানে প্রধানত সাধারণ ঘরের মানুষগুলো পরষ্পরকে মারে, মরে।‘সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোণার বাড়া’- সেই প্রিয় ভিটেমাটি ছেড়ে মানুষ উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের কারণে দ্রব্যমুল্য যদি আকাশচুম্বী হয়, সাধারণ মানুষ খেতে পায়না। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষ যখন প্রতিবাদী হয়, তখন অনেক সময় রাষ্ট্র প্রতিবাদী মানুষদের নির্মমভাবে দমন করে। সউদী আরবের রাষ্ট্রীয় তেল ও গ্যাস কোম্পানী আরামকো জানায়, তাদের ২০২২ সনে ১৬১.০ বিলিয়ন ডলার প্রোফিট হয়েছে যা এই পর্য্যন্ত বার্ষিক রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ প্রোফিট। ওয়াশিংটন (রয়টার) জানায়, ২০২২ সনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জাম খাতে বিগত বৎসরের তুলনায় লাভ ৪৯% বৃদ্ধি পেয়ে ২০৫.৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হলেও অর্থর্নৈতিকভাবে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। আমাদের প্রত্যাশা, বিশেষ করে ধনী, শক্তিধর ও তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট সমূহ পৃথিবীর নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত মানুষের কথা তথা মানবতা, বিশ্বশান্তি ও অগ্রগতির কথা আরও বিবেচনায় নেবেন। ‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’।কবির এই কথাগুলো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভ‚মিকা রেখেছে সুপ্রাচীনকাল থেকে। “মানুষ মানুষের জন্য; জীবন জীবনের জন্য”। প্রার্থনা “তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দিও শকতি”। এই লিখার বিভিন্ন ধর্মীয় উদ্ধৃতিতে কোন ভুলত্রæটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি কামনা করচ্ছি। ছবিটি সংগৃহীত। আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

প্রকৌশলী, ‘ইনস্টিউশন অব ইজ্ঞিনিয়ার্স, বাংলাদেশ’-এর সদস্য, কোয়ালিটি এসুরেন্স এন্ড ম্যানেজমেন্টে অনার্স সহ স্নাতক (অন্টারিও), ও সমাজ হৈতষী কর্মী।