ফরিদ আহমেদ : “তোমার হাতে ওটা কী লেখা?” অর্ণবকে জিজ্ঞেস করি আমি।
অর্ণবের হাতের ভিতরের দিকে কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত ট্যাটু করা। মনে হচ্ছে কিছু একটা লিখেছে সে।
“আমার মায়ের নাম।” হাত ঘুরিয়ে সবাইকে দেখায় সে। অক্ষরগুলো অনেকটা বাংলার মতো।
“কোন ভাষায় লেখা? হিন্দি?”
“না, পাঞ্জাবিতে লেখা।”

“দাঁড়াও দেখি আমি প্রথম অক্ষরটা কী সেটা বলতে পারি কিনা।”
প্রথম অক্ষরটা অনেকটা আমাদের ‘ম’ এর মতো। সেটাই বললাম আমি।
অর্ণব আর তালবিন্দর হেসে ফেললো আমার কথা শুনে। ওটা নাকি ‘স’। ‘ম’ আর ‘স’ যে আসলে কাছাকাছি দেখতে, এই প্রথম মাথায় এলো আমার। দু’টোর উচ্চারণ এতো ভিন্ন যে এই মিলটা চোখে পড়ে না।
আমার পাশেই বসে ছিলো তালিয়া, চাইনিজ মেয়ে।
‘তুমি কোন ভাষায় কথা বলো?” সে জিজ্ঞাসা করলো।
‘বাংলা।’ আমি উত্তর দেই।
“তুমি হিন্দি জানো না।’
না সূচক মাথা নাড়ি আমি।

“আমি যে সব বাংলাদেশিদের চিনি, তারা সবাই হিন্দি জানে। তুমি জানো না কেনো?” তালিয়ার কণ্ঠে বিস্ময়।
আমি নিজেও তখন খানিকটা বিস্মিত। সাধারণত পাকিস্তানিরা এই রকম বিস্ময় দেখায় আমি উর্দু জানি না বললে। একই ধরনের যুক্তি নিয়ে আসে যে তাদের পরিচিত সব বাংলাদেশিই উর্দু পারে।
পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য মূলত খারাপ থাকে। বাংলাদেশিদের দিয়ে উর্দু বলাতে পারলে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি পায় তারা। চাইনিজ মেয়েটার সেই ধরনের আত্মতৃপ্তি পাবার কথা না আমি হিন্দি বলতে পারলে। সে কেনো আমাকে এই কথা বলছে কে জানে?

“বেশিরভাগ বাংলাদেশিই হিন্দি শেখে হিন্দি সিনেমা দেখে। আমি হিন্দি সিনেমা দেখি না। তাই হিন্দি পারি না।”
“একটুও বোঝো না তুমি?”
“খুব সামান্য। সহজ কথাবার্তা হলে বুঝি। জটিল কিছু হলে বুঝতে সমস্যা হয়।”
“আপ ক্যায়সা হু।” ধরনের কিছু একটা বলে সে আমাকে। জানতে চায় এটার অর্থ আমি জানি কিনা।
হেসে দিয়ে বললাম যে এটার অর্থ আমি বুঝেছি। তালিয়াও হাসে আমার সাথে সাথে।
আমাদের ভাষা নিয়ে আলোচনা শুনেই ইরানি মেয়ে ফারহা কে কয়টা ভাষা জানে সেটা জানতে চায় সবার কাছে।
অর্ণব বলে যে সে ইংরেজি আর পাঞ্জাবি জানে শুধু।
“তুমি হিন্দি জানো না?” আশ্চর্য হয়ে আমি বলি।
“না, জানি না। আমার জন্ম ক্যানাডায়।”

কেভিন জানালো সেও দ্বিভাষিক, ইংরেজি আর স্প্যানিশ জানে। এটা শুনে ফারহা বললো যে তার ধারণা ছিলো কেভিন ইটালিয়ান জানে। ওর কথা শুনে আমারও মনে হলো যে ফারহার অনুমানের যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। কেভিনের কিউপিডের মতো চেহারার রোমান সৌন্দর্যের সাথেই বেশি মানানসই।
আমি কয়টা ভাষা জানি এটা জানতে চাওয়ায় আমি বললাম যে দেড়টা ভাষা জানি।
দেড়টা ভাষা কী রকম সেটা বোঝার জন্য সবাই উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকালো।
“আমি বাংলাটা মোটামুটি জানি। ইংরেজিটা আধো আধো। যে কারণে দেড়টা ভাষা।”
আমার পরে তালিয়ার পালা পড়লো। সে জানালো তিনটা ভাষা জানে সে। ইংরেজি, চাইনিজ আর হিন্দি।
“তুমি হিন্দি শিখিলে কোথা থেকে? হিন্দি সিনেমা দেখে?” বিস্ময়ের সাথে আমি বলি।
তালিয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসে।
“আই ওয়াজ বর্ন ইন ইন্ডিয়া।”
“ইন্ডিয়ার কোথায়?”
“লক্ষ্ণৌতে।”

বিশ্বায়ন যে কোন দিকে যাচ্ছে বোঝা মুশকিল। ইন্ডিয়ান ছেলে হিন্দি জানে না, অন্যদিকে চাইনিজ মেয়ে হিন্দিতে খই ফোটাচ্ছে।
“তুমি ভারতীয় হয়ে হিন্দি জানো না, আর ও চাইনিজ হয়ে হিন্দি জানে।” অর্ণবকে মৃদু খোঁচা মারি আমি।
“আমি অল্প-বিস্তর বাংলাও জানি।” আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে তালিয়া।
“তাই নাকি?” এই মেয়ে একের পর এক বিস্ময় উপহার দিয়ে চলেছে।
“কোনটার মানে কী, সেটা ঠিকঠাক জানি না বলে বলি না অবশ্য।”
বাংলা কীভাবে শিখেছে সেটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। তালিয়া দেখি আমার দিকে তাকিয়ে বলছে,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

ওর হিন্দি উচ্চারণের বাংলা শুনে হেসে ফেলি আমি।
“ভাগ্যিস আমার বউ পাশে নেই। নইলে তোমার খবর হয়ে যেতো এই কথা বললে।” রসিকতা করি আমি।
“বলেছিলাম না আমি বাংলাটা ভালো জানি না। কী বলতে কী বলে ফেলি। এইজন্য বলতে চাই না।” বিব্রতভাবে হাসে তালিয়া।
“আমি শুনেছি কোলকাতায় নাকি বেশ কিছু চাইনিজ বসবাস করে।

তারা বাংলাটা খুব ভালো জানে।” ওকে বিব্রত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য আমি বলি।
“মাই হাজব্যান্ড ইজ ওয়ান অব দেম। আমি এ্যাম লার্নিং বেঙ্গলি ফ্রম হিম।” তালিয়ার হাসিটা চওড়া হয়।
মায়ের কাছে মাসির গল্প বলতে গিয়েছিলাম আমি।