রবার্ট ইগার : (দা ওয়াল্ট ডিজনী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসাবে রবার্ট ইগারের পনের বছরে অর্জিত শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা। ২০০৫ সালে রবার্ট ইগার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন যখন কোম্পানি এ যাবত কালে সর্বাধিক সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিবাহিত করছে। তিনটি মূলনীতির উপর ভর করে তিনি এগুলেন এক. গুণগত মানের শ্রেষ্ঠতা বজায় রাখা, দুই. নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে প্রতিযোগিতা না করে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং তিন. গন্ডির বাইরে বিশ্বব্যাপী নিজেদের চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটানো। চৌদ্দ বছরে তিনি ডিজনিকে পৃথিবীর সর্ববৃহত মর্যাদাসম্পন্ন মিডিয়া কোম্পানিতে রূপান্তর করলেন। এখন পিক্সার, মার্ভেল, লুকাসফিল্ম, টুয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরি ফক্স প্রভৃতি স্বনামধন্য কোম্পানির মালিক দা ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি। রবার্ট ইগারের লেখা “দা রাইড অফ এ লাইফ টাইম” সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী)

পঞ্চদশ.
চতূর্থ অধ্যায়
ডিজনির সান্নিধ্য
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ১৯৯৬ এর এপ্রিলে মাইকেল আইজনার নিউ ইয়র্ক আসলেন আমার অফিসে আমার সাথে দেখা করতে। তিনি আমার অফিসে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, ‘আমি জানি মাইকেলকেলকে দিয়ে কাজ হচ্ছে না। তাঁকে নিয়োগ দিয়ে আমরা একটা দুর্যোগ ডেকে এনেছি।’ তিনি জানতেন অন্যান্য নির্বাহীবৃন্দ, যেমন জো রথ, ডিজনি স্টুডিওর প্রধান চাকুরী ছেড়ে দেবার কথা বলছেন। করাণ ওভিজের সাথে কাজ করতে যেয়ে তাঁরা ভীষণ রকমের হতাশ। তিনি আমাকে অনুরোধ করছেন আমি যেন তেমন কিছু না করি। আমার চাকুরী ছেড়ে যাবার পরিকল্পনা নেই। ডিজনিতে যোগদানের প্রথম ছয় মাস আমি হতাশায় ডুবে আছি, উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু করতে পারেনি। আমার পেশাগত জীবনে ইতিপূর্বে এমন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ডিজনিতে আমি এখনও নতুন। আর আমি যেহেতু নিউ ইয়র্কে বসি অন্যদের মতো আমাকে যন্ত্রনাও ভোগ করতে হয়নি। আমি ভেবেছিলাম মাইকেলের জন্য এটি একটা জটিল সমস্যা। আমি নিজে তাঁর জন্য গোদের উপর বিষফোড়া হতে চাইনি।

মাইকেল বললেন ’আমি জানি না ঠিক কখন আমি করতে সক্ষম হবো। কিন্তু তাঁর চাকরিচ্যুতি সময়ের ব্যাপার মাত্র।’ তিনি আমাকে এ বিষয়ে কারও সাথে আলোচনা না করার জন্য বললেন। আমি তাঁকে কথা দিলাম, আমার কাছ থেকে কারও কানে যাবে না। আমি কখনও নিশ্চিত হতে চাইনি আর কাকে তিনি এ কথা বলেছিলেন। মাসের পর মাস কেটে গেল, দুশ্চিন্তা আর কর্মহীনতা কঠিন আকার ধারণ করল। তাঁরা দুজন, প্রত্যেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ওভিজের নেতৃত্বে যাঁরা কাজ করতেন সকলেই মন্দ সময় পার করতে লাগলেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার এখনই সময়।

আমাকে বলার আট মাসেরও বেশি হবে, ডিসেম্বারে মাইকেল আইজনার মাইকেল ওভিজকে চাকুরিচ্যুত করলেন। কোম্পানির ইতিহাসে এক বেদনাদ্বায়ক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল (ডিজনিকে একটা বড় মূল্য পরিষোধ করতে হল, এটি শেয়ার হোল্ডার মামলায় গড়াল, ফলস্বরূপ মাইকেল ওভিজ ১০০ মিলিয়ন ডলারের উপরে পেলেন তার সাথে চাকুরিচ্যুত হবার জন্য ক্ষতিপূরণ)। এখন মাইকেল ওভিজের সাথে আমার আন্তরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। আমার প্রধান নির্বাহী থাকাকালীন ডিজনিতে যে প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে সে বিষয়ে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এখন আমি যখন পিছন ফিরে চাই, তখন মনে হয় তিনি এতটায় খারাপ মানুষ নন যতোটা আমরা ভেবেছিলাম। সে একটা ভুল সিদ্ধান্তের একজন অংশীদার মাত্র। হঠাত সম্পূর্ণ অপরিচিত সংস্কৃতির মধ্যে এসে পড়ায় তাঁকে এক ধরনের হতাশা পেয়ে বসেছিল।

সে এবং মাইকেল দুজনই চাচ্ছিলেন মানিয়ে নিতে। কিন্তু দুজনই ছিলেন প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি। মাইকেল চাচ্ছিলেন ওভিজ তাঁর কাছে আসুক, এসে জিজ্ঞেস করুক এখানে কিভাবে কাজ করতে হয়। আর ওভিজের কোন ধরণায় ছিল না এত বড় একটা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলার জন্য কি করা দরকার।

তাঁদের দুজনেরই জানা উচিত ছিল যে এভাবে চলবে না। বরং তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে কঠিন প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেছেন। কারণ দুজনই তাঁদের নিজের প্রয়োজনগুলোকে বেশি প্রাধন্য দিয়েছেন। এ ধরণের জটিল অবস্থার সুরাহা করা আসলেই কঠিন। যে মুহূর্তে আপনি এ ধরণের সমস্যাই নিমজ্জিত রয়েছেন সে সময়ে একটা সমাধানে আসা আরও কঠিন। আপনি অপেক্ষা করতে থাকবেন স্বয়ংকৃয়ভাবে এমন কিছু ঘটবে যা একটা সমাধানে গিয়ে পৌঁছাবে। আপনি কিছুতেই চিন্তা করবেন না কি করলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। ধীরে ধীরে সমস্যা নাগালের বেইরে চলে যাবে। কিচ্ছু করার থাকবে না। আসলে সে সময়ে আপনার নিজেকে খোলাসা করার জন্য কিছু প্রশ্ন করা জরুরী। প্রশ্নগুলো হচ্ছে – কোন সমস্যাটি আমার সমাধান করার জন্য জরুরী পদক্ষেপ নেয়া দরকার? অনেকগুলো সমাধানের মধ্যে কোনটি বেশি কার্যকর? আমি তাকে সন্দেহ করছি, কিন্তু কেন? আমি যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি সেটা কি যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত? আমি কি কোন ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ পদক্ষেপটি নিতে যাচ্ছি?

পঞ্চম অধ্যায়
ডিজনিতে দ্বিতীয় অবস্থান
দ্বিতীয় ব্যক্তি ছাড়াই মাইকেল পরবর্তী তিন বছর কোম্পানি পরিচালনা করলেন। ওভিজের চলে যাবার পর আমাদের দুজনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হল। কিন্তু আমি সময় সময় টের পাচ্ছিলাম মাইকেল আমার সাথে কাজ করার সময় বেশ সতর্ক। কারণ তিনি টের পেয়েছিলেন যে ডিজনির এক নম্বর পদের উপর আমার দৃষ্টি আছে। তিনি কখনও আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন না। এভাবেই চলতে লাগল আমার প্রতি তাঁর সন্দেহ আর যাঁচাই বাছাই প্রক্রিয়া। প্রায়ই আমাকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ডেকে পাঠাতেন। এভাবেই আমি তাঁর আস্থাভাজন হয়ে উঠলাম। হঠাত্ই তাঁর নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত হলাম। আমাকে সবসময় তাঁর পাশাপাশি রাখা শুরু করলেন।

এটি সত্য যে আমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার একটা অংশ ছিলাম এই ভেবে যে আমাকে হয়তো একদিন এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে হতে পারে। তার মানে এই নয় যে আমি মাইকেলকে সরিয়ে তাঁর পদ দখল করবো। আমি আমার নিজের দ্বায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর ছিলাম এবং পাশাপাশি যতদূর সম্ভব কোম্পানির সমস্ত বিষয় সম্পর্কে শিখতে আগ্রহী ছিলাম। আমার সমস্ত পেশাগত জীবনে এমনটাই ঘটেছে। যদি কখনও এমন সময় আসে যখন মাইকেল প্রস্তুত হচ্ছেন পদ ছেড়ে দেবার তখন আমিও যেন সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার করতে পারি, শক্ত হাতে হাল ধরার জন্য প্রস্তুত থাকি।

উচ্চাভিলাষ লালন করার উত্কৃষ্ট উপায় কি? আমার কাছে গত কয়েক বছর ধরে বহুবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে। হতে পারে সেটি ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ অথবা হতে পারে একজন নেতা হিসেবে আপনি যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদের উচ্চাভিলাষ। একজন নেতা হিসেবে আপনি যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মনে উচ্চভিলাষ জাগিয়ে তুলতে হবে, তাঁদেরকে বেশি বেশি দ্বায়িত্ব পালনে আগ্রহী করে তুলতে হবে যতক্ষণ না তাঁদের স্বপ্নের চাকুরী পাবার আকাঙ্খা বর্তমান চাকুরী থেকে পূর্ণমনোযোগ সরিয়ে নেবে। আপনার উচ্চাভিলাষকে কখনই সুযোগের অনেক উপরে যেতে দেবেন না। আমি অনেক মানুষকে দেখেছি একটা বিশেষ ধরনের চাকুরিতে বা প্রকল্পে তাঁদের লক্ষ্য নির্ধারণ করেন, যেখানে চাকুরী হবার সুযোগ অনেক ক্ষীণ। দূরের ছোট্ট একটা বিষয়কে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করা, অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি করে। তাঁরা বর্তমানে যাকিছু করছেন সেখানে লেগে থাকার ধৈর্য হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাঁরা বর্তমানে যে কাজ করছেন সেটিতে যথেষ্ট মনোযোগী হতে পারছেন না কারণ তাঁরা অন্য একটা কাজের জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে তাঁদের উচ্চাকাংখা ব্যার্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। কিভাবে আপনার বর্তমান চাকুরি আর আপনার উচ্চাকাঙ্খার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবেন এটি জানা একটা গুরিুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনি যে চাকুরী করছেন সেটি নিষ্ঠার সাথে করেন। ধৈর্যশীল হন। সম্ভাব্য সুযোগগুলো চিহ্নিত করুন।

নিজের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তুলুন। মননে মানসিকতায় বড় হয়ে উঠুন। দৃষ্টিভঙ্গি, কর্মক্ষমতা আর মনোযোগ বিবেচনায় নিজেকে তাঁদেরই একজন হিসেবে গড়ে তুলুন। যাতে করে আপনার বস মনে করেন কোন সুযোগ আসলে আপনাকে টেনে তুলা তাঁর কর্তব্য। অপরপক্ষে আপনি যদি বস হন তবে কাদের প্রতি যত্নশীল হবেন? যারা পদোন্নতির জন্য দাবী করছেন এবং অভিযোগ করছেন যে তাদের মেধা আর যোগ্যতাকে কাজে লাগান হচ্ছে না, নাকি তাঁদের প্রতি যত্নশীল হবেন যিনি প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছেন তিনি অনিবার্য।

এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় অনেকগুলো, টন ও ড্যান এ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ মডেল। তাঁরা আমার বড় হয়ে উঠার পেছনে বিনিয়োগ করেছেন। আমাকে কতটুকু সফল হতে হবে তাঁরা নির্দিষ্ট করে বলেছেন। তাঁরা আমার সামনে একটা পথ খুলে দিয়েছেন যাতে করে আমি উপরে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগুলো গ্রহণ করতে পারি। সর্বোপরি একটা কোম্পানি পরিচলনার সমস্ত কলাকৌশল শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রত্যেকটি স্তরে সম্ভাব্য সমস্ত কিছু আয়ত্ত করার জন্য আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি। কারণ আমি জানতাম যদি আমি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারি তবে তাঁরা আমাকে নিয়ে আরও উচ্চতর পরিকল্পনা করবেন। ফলস্বরূপ তাঁদের প্রতি আমার যে অকৃত্তিম আনুগত্য তা আমি গর্বের সাথে স্মরণ করি।

প্রধান নির্বাহী এবং কোম্পানির দ্বিতীয় অবস্থানে যিনি অধিষ্ঠিত তাঁদের মধ্যেকার সম্পর্কের যে গতিশীলতা তা পরাস্পরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হয়। দুজনই মনে করেন একজন ছাড়া অন্যজন চলতে পারবে না। কৌশলটি হচ্ছে আপনাকে যথেষ্ট মাত্রায় আত্মসচেতন হতে হবে। ‘আমিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই কাজটি করতে পারে’ এই সমস্ত বদ্ধমূল ধারণা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। সংক্ষেপে বললে, ভাল নেতৃত্ব কখনই নিজেকে অপরিহার্য মনে করেন না। ভাল নেতৃত্ব সবসময় অন্যকে প্রস্তুত হবার জন্য সহযোগিতা করেন, যাতে তাঁর অনুপস্থিতিতে সেই ব্যক্তি তাঁর মতই কাজ করতে পারেন। নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন, নতুন নতুন দক্ষতাগুলো রপ্ত করতে সহযোগিতা করেন, দক্ষতার উন্নয় ঘটাতে সহযোগিতা করেন। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তাঁদের সততার সাথে অবহিত করেন, প্রস্তুত করে তোলেন।

মাইকেলের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ জটিলভাবে শুরু হয়েছিল। কোন কোন সময় আমার মনে হয়েছে তিনি আমার যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। বাকী সময়ে মনে হোত তিনি আমার প্রতি উদার, উত্সাহ দাতা আর আমার উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল যাতে করে আমি তাঁর ভাগের কাজগুলো করে দেই। ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে আমাদের সম্পর্কের মহামহিম সময় এসে হাজির। মাইকেল একদিন নিউ ইয়র্কে আমার অফিসে আসলেন। তিনি আমাকে বললেন আমি চাই আপনি ডিজনির নতুন আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তুলবেন এবং সেটি পরিচালনা করবেন। সে সময়ে আমি এবিসি গ্রুপের চেয়ারম্যান। অর্থাত সে সময়ে আমি একহাতে এবিসি নেটওয়ার্ক, ইএসপিএন এবং ডিজনি টিভি পরিচালনা করছি। এতদসত্যেও ডিজনির আন্তর্জাতিক অফিস খোলার দায়িত্ব আমার সামনে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিল। আমি মাইকেলের প্রতি কৃতজ্ঞ তিনি অবশেষে আমার দিকে মূখ তুলে চেয়েছেন। আমি কাজটি করার জন্য ভীষণভাবে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। (চলবে)