মণিজিঞ্জির সান্যাল : জীবনকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শরীরের পাশাপাশি আমাদের এই মনটাকেও সুস্থ সুন্দর ও সজীব রাখতে হবে। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমাদের এই মনটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেকেই নিশ্চয় চমকে যাচ্ছেন? নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করছেন তো, মনের আবার অসুখ! কিন্তু হ্যাঁ শরীরের মতো মনেরও অসুখ হয়, তাকেও যত্ন নিতে হয়, ভালোবাসতে হয়। প্রতিদিন আমরা যেমন শরীরকে স্নান করাই, নোংরা হলে সাবান দিয়ে ঘষে পরিস্কার করি, মাথায় নিয়মিত তেল, শ্যাম্পু মাখি, ত্বককে কতোরকমভাবে যত্নে ভরে তুলি; তেমনি মনের জন্যেও তেল, সাবান, শ্যাম্পু দিয়ে পরিচর্যা করতে হয় এবং প্রয়োজনে তাকেও সঠিক চিকিৎসা করাতে হয়। আবারও নিশ্চয়ই চমকে উঠলেন? মনকে কিভাবে তেল, সাবান, শ্যাম্পু দিয়ে পরিস্কার করবেন! কিন্তু সত্যিই আছে এমন কিছু উপকরণ। একটু অন্য রূপে আর অন্য রঙে এসেছে তারা আমাদের মনের শুদ্ধিকরণের জন্যে।

আচ্ছা একবারও ভেবে দেখেছেন, আমরা এই যে নিজেদের এতো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করি তার সবটাই কিন্তু বাহ্যিক অর্থাৎ আমাদের এই চামড়া নামক আবরণটির জন্যেই এতো আয়োজন। কিন্তু মনের মলিনতা, মনের জমে থাকা নোংরাগুলোকে কিভাবে পরিস্কার করব?

নিশ্চয়ই ভাবছেন মনের আবার নোংরা কি? মনের আবার আবর্জনা কি? মনের নোংরাগুলো হলো আমাদের মনের মধ্যে জমে থাকা হিংসা, রাগ, পরশ্রীকাতর, বিষাক্ত প্রতিযোগিতা আর লোভ। এই রোগগুলো দিনের পর দিন বাড়তে থাকলে আমাদের মধ্যে একসময় হতাশার জন্ম নেবেই। তারপর নিজেদের অজান্তেই আমরা সেই গভীর অন্ধকারের খাদে ডুবে যাব, আর তখনই জীবন থেকে একে একে সব রং নিভে যাবে। জীবনের সব সৌন্দর্য,জীবনের প্রতি ভালোবাসা সব মুছে গিয়ে ধীরে ধীরে অবসাদের করাল ছায়া গ্রাস করবে। ফলস্বরূপ নিজেদের অজান্তেই আমরা ডিপ্রেশনের শিকার হবো। মনকে তাই সুন্দর করে সাজাতে হবে।
আর একটা কথা শরীরের মতো মনেরও বিশ্রাম প্রয়োজন।

মনকে অনুশীলন করতে হবে নিয়মিত, কিভাবে? তার জন্যে প্রয়োজন ‘ধ্যান’ অর্থাৎ মেডিটেশন যা মনকে সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়।
এই মনের অসুখ এক একজনের ক্ষেত্রে এক একরকম। মন খারাপ সামান্য হলে একরকম, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যদি এই মন খারাপ বাড়তেই থাকে তাহলে কিন্তু চিন্তার বিষয়। তখন তাকেই বলে গভীর মন খারাপের অসুখ বা বিষন্নতা কিম্বা অবসাদ। তবে প্রচলিত শব্দে ‘ডিপ্রেশন।’
এবারে বিস্তারিত ভাবে জানতে হবে এই অবসাদ বা ডিপ্রেশন ঠিক কি? কাকে বলে এই ডিপ্রেশন, জীবনে কেনই বা আসে ডিপ্রেসন? কেন হঠাৎ করে আমাদের মনটা খারাপ হয়ে যায়? এই মন খারাপ মানেই কি ডিপ্রেশন? মন খারাপ আর ডিপ্রেশন কি একই বিষয়? এই ডিপ্রেশনের শিকার হয়েই কি অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়? সেই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে প্রথমে আমাদের জীবনের সূ²াতিসূ² মুহূর্তগুলোকে নিয়ে ভাবা যাক।

প্রথম আসছে মানব জীবনের সম্পর্কের কথা। আমরা কেউই মেনে নিতে পারি না কোনো ভাঙনকে। আমরা সবাই চাই ভালোবাসা ভরা এক পৃথিবী। অথচ সম্পর্কগুলো কিভাবে যে ভাঙতে শুরু করে নিজেদের অজান্তেই।
একের পর এক সম্পর্কের ভাঙন থেকেও ডিপ্রেশন আসতে বাধ্য। কিন্তু এই ভাঙনের জন্যে নিজেরা কতটা দায়ি তা একবারও আমরা ভেবে দেখেছি কি? যে বা যারা সম্পর্কের মূল্য দিতে জানেন না, তাদের কোনো সম্পর্কে না জড়ানোই উচিত। সম্পর্ক নিয়ে কখনো ছেলেখেলা করতে নেই। আপনার মুহূর্তের আবেগে অন্য একজনের জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে।

আসলে প্রতিটি সম্পর্কেই থাকে দায়বদ্ধতা। আর সেই দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলতে শুরু করলেই সমস্যার শুরু। আর বর্তমানে কর্মব্যস্ত জীবনে এই সম্পর্ক নিয়ে সমস্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দিনের পর দিন ছোটখাটো বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করেই এই সমস্যা। একটা সমস্যা কাটিয়ে ওঠার দুদিনের মধ্যে শুরু হয় অরেকটি নতুন সমস্যা। যে কোনও একটি সম্পর্ক শুরুতে ভালো থাকলেও, কয়েকদিন পর থেকেই শুরু হয়ে যায় সমস্যা। আগে যে বিষয়গুলি হাসির ছলেই মিটে যেত পরবর্তীতে সেই একই বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করেই তৈরি হচ্ছে ঝামেলা, অশান্তি। কিন্তু কেন?

আসলে মানুষের চাহিদার শেষ নেই, আর এই সুন্দর জীবনটাকে কোনোমতেই অন্যের সঙ্গে মেলাতে যাওয়া ঠিক নয়। কোন পরিবার কোথায় বেড়াতে গেল, কারা প্রতিদিন দামি রেস্তোরাঁয় যাচ্ছে, কারা প্রতিদিন শপিং মলে গিয়ে ভিড় করছে এসব নিয়ে আলোচনা হাস্যকর। আর এই তুচ্ছ বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে যদি দুজনের এতোদিনের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে জীবনের মূল্য, ভালোবাসার মূল্য, বন্ধুত্বের মূল্য বা সম্পর্কের কোনো মূল্যই থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা নিজের কাছেই নিজেকেই সবচেয়ে মূল্যহীন মনে হয়। ভালোবাসার জন্যে,একটা সুন্দর সম্পর্কের জন্যে বাহ্যিক এই জগতকে কখনোই দায়ী করতে নেই।
এই পৃথিবী অনেক সুন্দর, আমাদের এই মনটা অনেক সুন্দর। এই সুন্দর মনটার মূল্য বাইরের মানুষের বাহ্যিক জীবনের চাইতে অনেক অনেক মূল্যবান। তাকে কোনো মূল্যেই নষ্ট করত নেই।

সম্পর্কে যোগাযোগের গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম। অনেক দম্পতি যখন রেগে যান বা কোনও কারণে তাদের মধ্যে অশান্তি হয় তখন ধীরে ধীরে অনুভূতিগুলি নষ্ট হতে শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই কথা বলা বন্ধ করে দেন। এটি একেবারেই ভুল সিদ্ধান্ত। কেউ রেগে গিয়ে মুখের ভাষা খারাপ করে ফেলেন। এক্ষেত্রে এমনটা না করে বরং সমস্যাগুলি নিয়ে পরস্পরের কথা বলা উচিত। যোগাযোগই হলো একটি সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি প্রস্তর।

একে অপরের সঙ্গে যত বেশি যোগাযোগ থাকবে, একে অপরকে যত বেশি করে বুঝতে পারবে, সম্পর্কের উষ্ণতাও তত উন্নত হবে। কাছের মানুষটির সঙ্গে নিজের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিগুলি যত বেশি করে ভাগ করে নেওয়া যাবে অর্থাৎ যতো নিজেদের সবকিছু পরস্পর শেয়ার করবে ততই ভুল বোঝাবুঝি কমতে থাকবে। যোগাযোগ একটি সুখী সম্পর্কের মূল চাবিকাঠি। যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন যে কোনো সম্পর্ককে মজবুত করতে সাহায্য করে।

আরো একটা বিষয় হচ্ছে সম্পর্কে স্বচ্ছতা বা সৎ থাকা খুব প্রয়োজন। এই সু² জায়গায় চিড় ধরলে সহজেই একটি সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। একান্ত কাছের মানুষটির প্রতি একটু মনোনিবেশ করতে হবে এবং তার মনের কথা শুনে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করাটা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ, এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার মনোযোগ আপনার কাছের মানুষটির উপর বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি করবে। তার মনের মধ্যে কী চলছে এবং প্রতিদিন তার জীবনে কী ঘটছে তা আপনি যখন শুনবেন তখন আপনি তাকে আরও ভালভাবে জানতে পারবেন।
এর ফলে একটি সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হবে। আপনাকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে। এটি তাকে সম্পর্কে সুরক্ষার অনুভূতিও দেবে কারণ সে আশ্বস্ত হবে যে তার কথা শোনার জন্য এবং তার অনুভূতিগুলি বোঝার জন্য আপনি সবসময়ই উপস্থিত।
আর একটা ব্যাপার যে কোনও সম্পর্কের গুরুত্ব তখনই বাড়ে যখন আপনি নিজেকে ভালোবাসতে পারবেন। যে মানুষ নিজেকে ভালোবাসতে জানে না, সে কখনই অপরকেও ভালবাসতে পারবে না। আর পাশাপাশি প্রয়োজন আত্মমর্যাদা বোধ। আত্মমর্যাদা আর অহং অর্থাৎ ইগো কখনোই এক নয়। একটা সুন্দর সম্পর্কে এই বিষয়টি না থাকাই শ্রেয়। আসলে কি জানেন মনের মধ্যে থাকা ছোটখাটো দ্ব›দ্ব ও জিজ্ঞাসা বা চাহিদার থেকেই সমস্যাগুলির শুরু হয়। তাই আত্মমর্যাদা বোধ থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয়।

একজন প্রেমিক বা প্রেমিকা অনেক সময়ই বলেন আমার কাছের মানুষটি আমাকে সময় দেয় না, বা আমাকে গুরুত্ব দেয় না কিম্বা আমাকে ছেড়ে ও চলে গেল। দেখুন জোর করে আপনি কাউকে আটকে রাখতে পারবেন না। যে চলে যায় তাকে যেতে দিন। ফেরার হলে সে নিজেই ফিরে আসবে। সম্ভব হলে মুখোমুখি বসে দুজনে আলোচনা করতে পারেন। যদি সে কোনো অবস্থাতেই এই সম্পর্ককে ধরে রাখতে না চায়, তা হলে মনে করবেন সে আপনাকে ভালোইবাসেনি, কিম্বা সে আপনার যোগ্যই নয়। তাছাড়া আরো একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, সেটি হলো সম্পর্কের বাইরেও কিন্তু আপনার নিজস্ব একটি জগৎ আছে। নিজেকে বেশি করে সময় দিন আর সঙ্গীকেও তার নিজের মত করে সময় কাটাতে দিন। জীবনে চলার পথে সব সময় দুটো মানুষের আলাদা আলাদা জগৎ থাকে। সম্পর্কে আছে বলে সব সময় আপনাকেই সময় দিতে হবে এই দাবী করাও কিন্তু ঠিক নয়। এতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সঙ্গীর মতামত গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন। আপনার মতামতটিও সঙ্গীকে বোঝান, এভাবেই একটি বিষয়ে মিলেমিশে দুজনে জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তগুলি নেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে সম্পর্কও ভালো থাকবে, দুজনের গুরুত্ব দুজনের কাছে সমান থাকবে।
আচ্ছা আপনি আপনার কাছের মানুষটিকে সম্মান করেন তো? একটা সুন্দর সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই আছেন যারা তাদের কাছের মানুষটিকে নিয়ে সবসময়ই সমালোচনা করেন, নেগেটিভ মন্তব্য করেন। এটি খুবই খারাপ। অন্যের কাছে নিজের মানুষটিকে নিয়ে সমালোচনার করার চাইতে, তার সঙ্গেই তার ভুল ত্রুটিগুলো নিয়ে সুন্দর করে বিশ্লেষণ করুন। নইলে একটা সময় পর সম্পর্কে ফাটলের সৃষ্টি হতে বাধ্য।

একটি স্বাস্থ্যকর এবং সুখী সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য, অবশ্যই আপনার কাছের মানুষটির মতামত নিন এবং তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে শিখুন। আপনার সব ভাবনা বা সিদ্ধান্তই সঠিক আর তার সবকিছুই ভুল এটা হলে কোনও সম্পর্কই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দীর্ঘদিনের একটা সম্পর্ক ভেঙে গেলে অবসাদ ধীরে ধীরে আপনাকে গ্রাস করতে পারে, এক্ষেত্রে নিজেকে এবং কাছের মানুষটিকে ভাল রাখতে এবং ডিপ্রেশনের হাত থেকে বাঁচাতে পারস্পরিক সহযোগিতা ভীষণরকম প্রয়োজন।

পরিশেষে বলি, কোনো কিছু ভেঙে তো ফেলাই যায়, তার জন্যে একটি মুহূর্তই যথেষ্ট কিন্তু তাকে ভালোবেসে যতেœ লালন করতে পারাটাই তো জীবন, একেই তো বলে ভালোবাসা।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ