ভজন সরকার: ভাবছিলাম, রবীন্দ্রনাথ আর একটু নৈর্ব্যক্তিক হলেই পারতেন। জীবনের অনেকবার তথাকথিত ঈশ্বর বা স্রষ্টা থেকে যতটুকু বের হয়েছিলেন বিশেষকরে তাঁর চিঠিপত্রে কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতিতে, এমনকি গল্প-উপন্যাসেও; কিন্তু তাঁর গানে থেকেছেন ঠিক বিপরীত।

পূজা পর্যায়ের অনেক গানে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এক মূর্তিমান ঈশ্বরকে সম্বোধন করেছেন। অথচ এই ঈশ্বর কার ঈশ্বর? কেননা, ঈশ্বর বিশ্বাসের ব্যাপারটা এসেছে প্রচলিত ধর্মগুলো থেকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই যে, কোনো ধর্মেই এক ও অভিন্ন ঈশ্বরের বর্ণনা নেই। সব প্রচলিত ধর্মেই ঈশ্বরের রূপ-স্বরূপ সেই ধর্মের মতো করে ব্যাখা করা হয়েছে। হিন্দু বা সনাতন ধর্মের ঈশ্বরের সাথে বৌদ্ধ-এমনকি জৈন বা শিখ ধর্মের ঈশ্বরের মিল নেই। আর আব্রাহামিক ধর্মবিশ্বাসীদের ( মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি) ঈশ্বরের সাথে অন্য ধর্মের ঈশ্বরের মিল তো নেই-ই এমনকি নিজেদের ঈশ্বরও ভিন্ন ভিন্ন।

তা হলে রবীন্দ্রনাথ যে নৈর্ব্যক্তিক বা সাধারণ (?) একটা ঈশ্বরের ধারণা এনেছেন, সেটা কার ঈশ্বর?
পূজা পর্যায়ের দু’টো গানের কথাই আলোচনা করি। প্রথম গানটি ৫৯৬ ক্রমিকের,
“তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।”

এখানে এই “তোমার” বলতে রবীন্দ্রনাথ কী বুঝিয়েছেন? তর্কহীনভাবেই বলা যায়, “তোমার” বলতে সেই তথাকথিত স্রষ্টা বা ঈশ্বরকে বুঝিয়েছেন। এখান “তোমার অসীম” বলতে অবশ্যই মহাবিশ্বকে বুঝিয়েছেন। অথচ অসীম মহাবিশ্ব বললে “তোমার অসীম” বলাটা খুব অযৌক্তিক। কেননা, বিজ্ঞান এমনকি যুক্তিবাদে সৃষ্টি কথাটাই অর্থহীন। এ বিশ্বে কিছুই সৃষ্টি হয় না, সব কিছু রূপান্তরিত হয়, গঠিত-পুনর্গঠিত হয়। তাই সৃষ্টিরই যেখানে অর্থ নেই, স্রষ্টা আছে কী না-আছে এমনকি থাকার প্রয়োজনই বা কী আছে, সেটা প্রমান সাপেক্ষ।
তাছাড়া যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে কোনো স্রষ্টা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তবে তা কিছুতেই অসীম হতে পারবে না। কারণ, সসীম কোন সত্ত¡া দ্বারা অসীম কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। আপনি নিজের সীমার বা আয়ত্বের বাইরে বাস্তবের কোন কিছু যার আকার-আয়তন আছে তা বাস্তবে তৈরী বা সৃষ্টি করতে পারবেন না। কল্পনা করতে পারবেন কিন্তু সেটা বাস্তব হবে না।

আর মহাবিশ্ব যতোই অসীম হোক, মহাবিশ্ব কিন্তু কাল্পনিক কোনো জিনিস বা এনটিটি নয়। এর বাস্তবতা আছে, যা প্রমানিত। তাই রবীন্দ্রনাথের “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই”- বাণীর “তোমার” শব্দটি ভুল বার্তা দেয়। বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদে এর কোনো মানেই নেই। আর প্রচলিত ধর্মের ছাঁচে ফেললে “তোমার” শব্দটির অর্থ নৈর্ব্যক্তিক তো নয়ই বরং বিভ্রান্তিমূলক এবং সব ধর্মের ধর্মবিশ্বাসের সাথে দ্বন্দময়।

রবীন্দ্রনাথ হয়ত “তোমার” শব্দটি বাদ দিয়েও গানটি রচনা করতে পারতেন এবং সেটিই হতো বিমূর্ত; সেটিই হতো মত বা বিশ্বাসের উর্ধ্বে। কিন্তু ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন গানটি লিখেন তখন ঈশ্বরের এই সর্বজনীন বা বিমূর্ত ধারণা হয়ত তাঁকে তেমনভাবে আলোরিত করেনি।
দ্বিতীয় গানটিও পূজা পর্বের। প্রথম গানটির ঠিক আগের ক্রমিক রবীন্দ্রনাথ নিজে সাজিয়েছিলেন ৫৯৫ ক্রমিকে,
“অল্প লইয়া থাকি, তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়
কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে প্রাণ করে “হায় হায়”।”
একই বছর অর্থাৎ ১৯০১ সালে। ভালোই চলছিল গানটি সাধারণ বা বিমূর্ত ভাব ও ভাবনায়। হঠাৎ করে সঞ্চারী এবং আভোগে এসে “তোমাকে” শব্দটি ব্যবহার করলেন।
“তোমাতে রয়েছে কত শশী ভানু, হারায় না কভু অনু পরমানু
আমার ক্ষুদ্র হারাধনগুলী রবে কি না তব পায়?”

সেই প্রথম গান “তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে”-এর মতোই এক মূর্তিমান সত্ত¡াকে টেনে আনলেন। অথচ অসীম মহাবিশ্ব ও মানবজাতির অসহায়ত্ব বা অনিশ্চিত জীবনের এই দ্বন্দকে তথাকথিত স্রষ্টা বা ঈশ্বর ছাড়াও ব্যক্ত করতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ; কিন্তু করেন নি। কারণ, রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন তথাকথিত না-দেখা না-জানা স্রষ্টা বা ঈশ্বরে বিশ্বাসী।
তবে রবীন্দ্রনাথ কি নিজের স্রষ্টা বা ঈশ্বরকে “তুমি”, “তোমার” এ রকম সর্বনাম বাচক শব্দ ব্যবহার করে বিমূর্ত বা নৈর্ব্যক্তিক করতে চেয়েছেন? অথচ রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরের প্রতিশব্দ “তুমি” -এর সাথে প্রচলিত বিশ্বাসীদের ঈশ্বরের “তুমি” অনেক অনেক দূরের।

তবুও কেন রবীন্দ্রনাথ এই সুক্ষ্ণ চাতুরীটা করেছেন? এটা কি নিতান্তই সব ধর্মের লোকের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য? নাকি, “ঈশ্বর” নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজের অবস্থানই স্পষ্ট ছিল না? রবীন্দ্রনাথ যদিও নিজেই অনেকবার বলেছেন যে, তিনি নিজেই বহুবার মত বদলেছেন। যে কোনো বিমূর্ত ধারণা বা বস্তুতে বিশ্বাস বা মতাদর্শ এক সরলরৈখিক অবস্থানে রাখা সত্যি কঠিন। হয়ত রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ জীবনে নিজেও তাঁর বিশাল সাহিত্যকর্মে “ঈশ্বর বিশ্বাস” নিয়ে একই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এই যে মানুষের মত বদল রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন, এগিয়ে যাওয়া।

১৯৩৮ সালে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“মত বদলিয়েছি। কতবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই। সৃষ্টিকর্তা যদি বারবার মত না বদলাতেন তা হলে আজকের দিনের সংগীতসভা ডাইনোসরের ধ্রæপদী গর্জনে মুখরিত হতো।”

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা।)