শারমীন শরীফ : আজীবন সংগ্রামী জীবনপ্রভা বিশ্বাস ১৩৩২ (১৯২৫) সালের ১৩ই মাঘ বৃহত্তর বরিশালের বর্তমান পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি থানা কামারকাঠি গ্রামের পৈত্রিক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ধন্বন্তরী আইচ সরকার, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু জীবনপ্রভা বিশ্বাসের বয়স যখন মাত্র চার বছর তখন তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। মা কুসুমকুমারী আইচ গৃহিণী কিন্তু তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন একজন বৈষয়িক মানুষ। স্বামীর মৃত্যুর পর উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের বধু হিসাবে বিশ্বাস সম্পত্তি দেখাশোনার পরও তিনি সন্তানদের মানুষ করতে সচেষ্ট ছিলেন। দু’বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে জীবনপ্রভাত চতুর্থ।

জীবনপ্রভা বিশ্বাস প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন নিজ গ্রামের সরকার বাড়ির পাঠশালা থেকে। এরপর তিনি নবকুমার উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হন। কিন্তু স্কুল জীবন থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ার ফলে পড়াশুনায় তাঁর তেমন অগ্রগতি হয়নি। স্কুলে পড়া কালে ১৯৪৮ সালে জীবনপ্রভা বিশ্বাসের বিয়ে হয় একই গ্রামে বসবাসকারী স্কুল শিক্ষক কমরেড অজিত কুমার বিশ্বাসের সাথে। অজিত কুমার বিশ্বাস নিজেও ছিলেন মার্কস বাদে বিশ্বাসী। ১৯৬২ সালে জীবনপ্রভা নবকুমার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন। ততদিনে তিনি চার সন্তানের জননী।

বড় দাদা মহেন্দ্রনাথ আইচ ও মেঝ দাদা জগদীশচন্দ্র আইচ সরকারও ছিলেন বাবার মতো ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত। বড় দাদা অনুশীলন দলের সদস্য ছিলেন। মেঝদাদা ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী। দুই ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় জীবন প্রবাহ বিশ্বাস রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। জীবনপ্রভা যখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী তখন স্বদেশী আন্দোলনের হাওয়া গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। সেই হাওয়ায় জীবনপ্রভারাও আন্দোলিত হয়েছিলেন। মুকুন্দ দাসের গান তখন আপামর নারী পুরুষের সকলকে দেশপ্রেমে উদ্বেলিত করে তোলে। জীবনপ্রভাদের বাড়িতে তখন প্রায়ই মার্কসবাদীদের গোপনে মিটিং হতো। মিটিং এর কাগজপত্র এবং কিছু কিছু রাজনৈতিক বই পত্র জীবন প্রহার কাছে রাখা হত। একদিন পুলিশ হামলা করলে জীবনপ্রভা কাগজপত্র ওর বই গুলির গুরুত্ব বুঝে অত্যন্ত বিচক্ষণতাঁর সাথে লুকিয়ে ফেলতে সমর্থ হন। ওই সময় থেকেই তাঁর কাছে রাখা বইগুলি তিনি পড়তেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাকারের লুণ্ঠনের কাহিনী, সূর্যসেন, প্রীতিলতাঁর বীরত্ব গাথা, বিপ্লবীদের ত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ে দাদারা প্রায়ই আলোচনা করতেন। বড়দের আলোচনা এবং বই-পুস্তক পড়তে পড়তে তিনি রাজনীতিতে আরো আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

১৯৩২ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত এবং স¤প্রসারিত করার লক্ষ্যে সূর্যসেন এবং মনোরমা বসু তহবিল সংগ্রহের আহ্বান করেন। জীবনপ্রভাত তাঁর নিজের অলংকার খুলে তহবিলে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই অর্থাৎ ১৯৩৭-৩৮ সাল থেকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং ১৯৪৪ সালে পার্টির সদস্যপদ পান। আন্দামান ফেরত কমরেড নলিনী দাস, মুকুল সেনরা তখন তাদের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন। ১৯৪২ সালে বরিশালে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠিত হয়। কামারকাঠিতে সরজু আইচের সহযোগিতায় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির গঠনে এবং সামগ্রিক কাজে অগ্রণী ও সক্রিয় ভ‚মিকা রাখেন। সমিতির পক্ষ থেকে তখন বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে সভা করা হতো। সভাগুলোতে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ বিরোধী আলোচনা করা হতো। এছাড়া নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে আলোচনা করা হতো। নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে সমিতির পক্ষ থেকে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাঠশালাটি প্রথমে সরকার বাড়িতে শুরু হয় এবং এখানে এক বছর চলে। পরের বছর মনোরঞ্জন আইচ সরকাররের মায়ের নামে সরোজিনী বালিকা বিদ্যালয় নামকরণ করে তিনি স্কুলের জন্য নতুন জায়গা এবং নতুন ঘর তুলে দেন। স্কুলে প্রথমে ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রী ছিল, পরে এর সংখ্যা ৮০ থেকে ৯০ তে উত্তীর্ণ হয়। তবে মুসলিম মেয়েদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। জীবনপ্রভাত বিশ্বাস এই স্কুলের শিক্ষকতা করেছেন। স্কুল চলতো গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে মুষ্টি চাল আদায় এবং নারী শিক্ষায় বিশ্বাসী অর্থশালীদের চাঁদা থেকে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত স্কুল টি চালু ছিল। দেশ বিভাগের পরে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়।

জীবনপ্রভা বিশ্বাস

জীবনপ্রভাব বিশ্বাস কমিউনিস্ট পার্টি ও আত্মরক্ষা সমিতি করতে গিয়ে অনেক বাধা পেয়েছেন। তখন তিনি অবিবাহিত থাকায় গ্রামের বিরোধিতাকারীরা তাঁর নামে অনেক কুৎসা রটাতো, ডাকে তিনি কুৎসিত চিঠি পেতেন, অনেক সময় তাঁর নামে বিভিন্ন পোস্টার লাগানো হতো। জীবনপ্রভার মা এতে করে খুবই উদ্বিগ্ন হতেন, বিধবার মেয়ে হিসেবে ভয় পেয়ে তিনি জীবনপ্রভাকে বাধাও দিয়েছেন কিন্তু পরবর্তীকালে মা নিজেও পারায় পাড়ায় তাঁর সাথে আত্মরক্ষা সমিতির মিটিংয়ে যেতে শুরু করেছিলেন।

১৯৪৫ সালে বরিশালে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রাদেশিক কমিটির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মনোরমা মাসিমা তখন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সভানেত্রী ছিলেন। জীবনপ্রভা বিশ্বাস উক্ত প্রাদেশিক সম্মেলনে কামারকাঠি শাখার পক্ষ থেকে যোগ দেন। ওই সময় বিভিন্ন কাজের মধ্যে দিয়ে মাসিমার সাথে জীবনপ্রভাব ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী কালে মাসিমাদের তাদের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। ১৯৪৫ সালেই জীবনপ্রভা কলকাতায় ‘নারী সেবা সংঘ’ আয়োজিত একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহন করেন। উক্ত প্রশিক্ষিণে সরোজিনী নাইডুর সাথে তাঁরব সাক্ষাৎ হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন গনসংগঠন মিলে প্রতি সপ্তাহে কামারকাঠিতে সভা হতো। বিশ্বযুদ্ধ এবং ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে সোচ্চার ও সংগঠিত করার লক্ষ্যে সভা গুলোতে আলোচনা হত এবং বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হতো। এ-সময় সরকার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা রাধিকা মোহন করকে আন্দামান দ্বীপে দীপান্তর করে। ১৯৪৬ সালে দেশ বিভাগের আগে এবং পরে ১৯৪৮ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা সৃষ্টি হয়। দাঙ্গায় বহু হতাহত হয়। পূর্ববঙ্গে হিন্দুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হলে হিন্দুরা স্রোতের মতো ভারতে চলে যেতে থাকে। কিন্তু জীবনপ্রভারা ভারতে যাননি সে সময়। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে থাকে এবং কমিউনিস্ট কর্মীদের পুলিশি হয়রানির মধ্যে রাখে। অনেকের বিরুদ্ধে হুলিয়াও জারি করে। ১৯৪৮ সালে বিয়ের পরপরই জীবনপ্রভা আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন। তখন তিনি গৌড়নদী এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন এবং কৃষক আন্দোলন সংঘঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে সভা চলাকালীন সময়ে এক হিন্দু গুপ্তচার পুলিশকে খবর দেয়। সেদিন কমরেড অজিত বিশ্বাস গ্রেপ্তার হন এবং তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন জীবনপ্রভা বিশ্বাস গ্রেফতাঁর হন এবং তাকেও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। দুজনকেই বরিশাল জেলে পাঠানো হয়। জেলে তখন ভজন বসু (মনোরোমা মাসিমার মেয়ে) পুতুল দাসগুপ্ত, অমীয় দাশগুপ্ত, সুজাতা দাশগুপ্ত অনেকেই ছিলেন। সুজাতা দাশগুপ্ত কে গর্ভাবস্থায় জেলে নেয়া হয় এবং জেলে থাকাকালীন তাঁর পুত্র সন্তান হয়, সেজন্য পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল ‘বন্দি’। পুরুষদের মধ্যে নলিনী দাস, মুকুল সেন, প্রশান্ত দাশগুপ্ত, হীরালাল দাস, যতীন দাশগুপ্ত ও অজিত বিশ্বাস সহ অনেকেই ছিলেন। জেলে তখন রাজবন্দীদের সাধারণ কয়েদিদের মধ্যে রাখা হতো এবং তাদের সাথে চোর ডাকাতের মতোই আচরণ করা হতো। সে জন্য রাজবন্দিরা ভালো খাবার বই পত্র পড়ার সুযোগ চিকিৎসা সুযোগ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎকারের সুযোগের দাবিতে এবং বিনা বিচারে রাজশাহী জেলে রাজবন্দী হত্যাকাÐের প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। একটানা ৩২ দিন অনশনের পর জীবনপ্রভা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৫০ সালের শেষের দিকে বা ৫১ সালের প্রথম দিকে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। ছাড়া পেয়ে তিনি শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে ওঠেন এবং সেখান থেকেই আবার রাজনৈতিক কর্মের সাথে সম্পৃক্ত হন। পার্টির গোপন সভা গুলি আয়োজন করা এবং গোপন কর্মীদের আশ্রয় দেয়া তখন তাঁর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

১৯৬৭ সালে একই গ্রামে বসবাসকারী তাঁর সহোদরা সুধাচন্দ্র স্বামীর সহ কুচক্রীদের হাতে নিহত হন। সুধাচন্দ্রের তখন ৫ সন্তান। বড় মেয়ে সবিতা চন্দের বয়স মাত্র ১২ বছর এবং ছোট ছেলেটি তখনো বুকের দুধ ছাড়ার বয়স হয়নি। জীবনপ্রভা রাজনীতি এবং নারী আন্দোলনের পাশাপাশি তাঁর বোনের পিতৃ-মাতৃহীন ৫ সন্তান এবং নিজের পাঁচ সন্তানকে একই সাথে মানুষ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। জীবনপ্রভার নিজের কোলেও তখন দুধের সন্তান তবু তিনি বোনের ছেলেকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াতে কারপণ্য করেননি।

১৯৬৮ সালে মনোরমা মাসিমাসহ তিনি কামারকাঠি থেকে বরিশালে চলে আসেন এবং সেখানে মহিলা সংগঠনের কাজ সহ সমাজচ্যুত মহিলাদের আশ্রয়দানের জন্য মনোরমা মাসিমা গড়ে তোলা মাতৃ মন্দিরের সকল কাজে তিনি সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে মাসিমাকে সহযোগিতা করেছেন এবং মাসিমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর কাছে ছিলেন।

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ৭০ এর নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের সময় জীবনপ্রভাব স্বরূপকাঠি পিরোজপুর ও বরিশাল সহ বিভিন্ন এলাকায় সভা করেছেন। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের আগে মহিলাদের আত্মরক্ষা করার কৌশল ও পদ্ধতি জানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় সভা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই যখন দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছিল জীবনপ্রভা তখন বাংলাদেশে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং দেশের ভেতর থেকেই অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন।শান্তি কমিটির সদস্যরা তাকে একাধিকবার একা ধরার জন্য চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তাকে না পেয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটপাট করে। ওই সময় তিনি বিভিন্ন গ্রামে হিন্দু মুসলিম বাড়িতে পালিয়ে থেকেছেন। তিনি গ্রামের যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ঢুকলে তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেছেন।

জীবনপ্রভার পাঁচ সন্তানরা প্রত্যেকের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আমৃত্যু তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন, গ্রামে থেকেছেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল নারী মুক্তি তথা মানুষ মুক্তির স্বপ্ন। সেই মুক্তির প্রয়াসে তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কাজ করে গিয়েছেন।
আজীবন সংগ্রামী এই নারীনেত্রী ২০০৫ সনের ২৮ জানুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন।