শারমীন শরীফ : বদরুন্নেসা আহমেদ ১৯২৪ সালের ২রা মার্চ কলকাতায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ আব্দুল মুক্তাদির ও মা সৈয়দা মাহমুদা খাতুনের পরিবারে চার কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের মধ্যে বদরুন্নেছা তৃতীয়। পৈত্রিক নিবাস পশ্চিমবঙ্গের বীরভ‚মে। বাবা তৎকালীন পাটনা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কলকাতা কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাড়িতে উর্দু ভাষার প্রচলন ছিল কিন্তু বাবা-মার প্রচেষ্টায় তারা চেষ্টা করতেন বাংলায় কথা বলবার। ছেলেবেলায় খুব ডানপিটে ছিলেন ফলে মেয়েদের বদলে অনায়াসে তাঁর সখ্যতা হত ছেলেদের সাথে এবং বড় ভাইয়ের বন্ধুরা ছিল তাঁরও বন্ধু।

পড়ালেখায় তাঁর হাতেখড়ি হয় কলকাতার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়ে। সেই স্কুল থেকেই ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে। পরবর্তীকালে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন এবং ১৯৪৪ সালে সেখান থেকেই আই এ পাস করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে প্রাইভেটে বি এ পাস করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এডুকেশনের এম এড করেন এবং ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর ডিগ্রী।

তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয় কলকাতায় ছাত্রী থাকাকালীন অবস্থায়। তিনি বিভিন্ন সমাস সমিতিতে অংশগ্রহণ করতেন মুসলিম নারীদেরকে সাহায্য করবার জন্য। এছাড়াও ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় লঙ্গরখানায় সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ১৯৪৭ সালে সরকারি কর্মকর্তা নুরুদ্দিন আহমেদের সাথে তাঁর বিয়ে হয়।

স্বামীর প্রত্যক্ষ ও সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং শশুর বাড়ির অনুপ্রেরণায় বদরুন্নেসা সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। বিয়ে এবং দেশভাগের পর পাকিস্তানে এসে নিখিল পাকিস্তান এবং ন্যাশনাল গার্ডে যোগ দেন।

১৯৫২ সালে স্বামীর চাকরির সুবাদে তিনি সিলেটে অবস্থান করছিলেন। ভাষা আন্দোলনের জোয়ার সেখানেও প্রবাহিত হয়। সেই আন্দোলন কে কেন্দ্র করে সিলেট শহরে ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কর্তৃক আহূত প্রতিবাদ সভা সমিতিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ এবং বক্তব্য প্রদান করতেন। তিনি ১৯৫৩ সালে সমাজ সেবামূলক অবদানের জন্য রাণী এলিজাবেথ ‘করোনেশন’ মেডেল লাভ করেন। তাঁর দৃঢ?তা কর্মদক্ষ ও আত্মবিশ্বাস দেখে মুগ্ধ হয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাকে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রার্থী মনোনয়ন করেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচনে শশুর বাড়ি কুষ্টিয়ার নির্বাচনী এলাকায় তিনি মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে এম এন এ নির্বাচিত হন। তাঁর সমৃদ্ধ রাজনৈতিক জীবনে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায?িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৮ সালের পর আইয়ুবী আমলে তাঁর রাজনৈতিক কর্ম ও তৎপরতাঁর কারণে সরকারি কর্মকর্তা স্বামীকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হলে তিনি সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাধা নিষেধ এড়াতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও সমাজ সেবায় মনোনিবেশ করেন।

১৯৬০ সালে তৎকালীন মুসলিম গার্লস স্কুলের শিক্ষকতাঁর মাধ্যমে তাঁর পেশাজীবন শুরু করেন। সে সময় তিনি ‘উইমেন্স হেলথ’ নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এরপরে তিনি ঢাকার লালমাটিয়া কলেজের উপ-অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীকালে তিনি একই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হলে কলেজের অধ্যাপনা থেকে তিনি নিজেই অব্যাহতি নেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে তাঁর দৃষ্টান্ত সামনে রেখে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

১৯৬১ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশী থাকাকালীন সময়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি গোপনে চালাতে থাকেন তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতা। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি ঘোষণার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে আওয়ামীলীগ মহিলা শাখার সভানেত্রী ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে তাঁর সমমনা বরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি গঠন করেছিলেন ‘গণসংস্কৃতি পরিষদ’। এই পরিষদে অন্য যারা ছিলেন তাদের মধ্যে এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, মোস্তফা সারোয়ার, এম এ হামিদ, আমিনুল হক উল্লেখযোগ্য।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে পুনরায় এম এন এ নির্বাচিত হন। এই কারণে সরকার তাঁর স্বামীকে কাজ থেকে সাসপেন্ড করে কিন্তু এতেও তিনি দমে যাননি। উনিশের নির্বাচনী প্রচারণা এবং ডেমরার ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণসহ গঠনমূলক কাজে তিনি ছিলেন সদা কর্মচঞ্চল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও তিনি অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি বাংলার নারী সমাজকে সংগঠিত ও সম্পৃক্ত করতে সক্রিয় ভ‚মিকা রাখেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালীকে হত্যা শুরু করে এবং তাঁর পাশের বাসা থেকে বঙ্গবন্ধু কে গ্রেফতাঁর করে নিয়ে যায়। সেই রাতে তিনি পালিয়ে পেছনের বাসা ব্যাংকার রহমান সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি পরিচিত ছিলেন বলে পাক বাহিনীর তাঁর উপরে বিশেষ নজর ছিল, এই কারণে তিনি বাধ্য হয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে আগরতলা চলে যান। সেখান থেকে তিনি ছেলেমেয়েদেরকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন কিন্তু তিনি আগরতলা থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর কাজ ছিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের কাছে শরণার্থী আশ্রমের রিপোর্ট পেশ করা, শরণার্থীদের মাঝে চিকিৎসা সহ ত্রাণ সামগ্রির সুষ্ঠ বিতরণ ও শরণার্থীদের থেকে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের বেছে নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সারদা সেবা সংঘ, রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত ত্রাণ কার্যক্রমে তিনি যুক্ত ছিলেন। বদরুন্নেসার স্বামী দেশে ছিলেন, ফলে পাক আর্মি তাকে ধরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে রেখে সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ডিসেম্বরের শেষের দিকে বদরুন্নেসা দেশে ফিরে আসেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ, বিশেষ করে মহিলাদের পুনর্বাসনে সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন। তিনি এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক মনোনীত হন এবং প্রতিটি জেলায় প্রতিষ্ঠানটি শাখা গঠন করেন।
১৯৭৩ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশের সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

তিনি বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্যা ছিলেন। পাশাপাশি বাড়ি থাকায় একই পরিবারভুক্ত ছিলেন তাঁরা। যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ নিতেন এবং দিতেনও। তিনি সংসদ অধিবেশনে খসড়া সংবিধান বিলের উপর আলোচনা কালে আইনগতভাবে নারীর প্রতি যে বৈষম্য রয়েছে তা সংশোধন ছাড়াও অসা¤প্রদায়িক রাষ্ট্র ও নারী পুরুষের সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠার উপরে জোর দেন। এছাড়াও তিনি বিবাহ আইন, বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ও উত্তরাধিকার আইনের সংশোধনের প্রয়োজন বলে বক্তব্য রাখেন।

১৯৭৪ সালের ২৫ শে মে স্বামী এবং দু ছেলের দু মেয়ে রেখে আজীবন সংগ্রামী বদরুন্নেসা আহমেদ মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত তিনি শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী দায়িত্বে ছিলেন। তিনি কুষ্টিয়ায় বেশ কয়েকটি স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুক্তি সংগ্রাম এবং জাতির পুনর্গঠনে ভ‚মিকা জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর মৃত্যুর পর তাকে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের অন্যতম বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং তাঁর নামানুসারে ঢাকার বকশিবাজার মহিলা কলেজের নামকরণ করেন ‘বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়’। রাজনীতি চর্চা ও শিক্ষকতা ছিল বেগম বদরুন্নেসা আহমেদের জীবনের অঙ্গ। সমাজসেবা ও নারী প্রগতিতে তিনি ছিলেন আজীবন ব্রতী। তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সভাপতি ও মহিলা সমিতির উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের একজন পথিকৃৎ হিসেবে বেগম বদরুন্নেসা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।