মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

চুয়াল্লিশ.
যখনই আমি কাউকে আমার কথা শুনানোর জন্য একটু থামাতে পারতাম, তখন আমি বারবারই ভাবতাম, আমি তাদের সাথে স্টিফেন হারপারের নেতৃত্ব আর তাঁর দল কিভাবে দেশ পরিচালনা করছে, সে সব বিষয় নিয়ে কথা বলবো, অথবা আমি ভাবতাম, আমার শিক্ষকতা জীবন আর ‘কাতিমাভিক’ এর চেয়ারম্যানের অভিজ্ঞতা থেকে যে জ্ঞান অর্জন করেছি তার নিরিখে আমি তাদের সাথে কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থা, পরিবেশ, স্বেচ্ছাসেবীমূলক কাজ আর এ ধরনের কাজে যুব স¤প্রদায়ের অন্তর্ভূক্তি নিয়ে কথা বলবো।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটতো, তা হচ্ছে, আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের প্রচুর কথা শুনতাম। তাদের আসল সমস্যা বা চাওয়া পাওয়ার বিষয়গুলি সম্পর্কে সেই সময় আমার মধ্যে একটা সম্যক ধারণার জন্ম হয়েছিল। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনার সাথে সাথে, তাদের উত্থাপিত সমস্যা বা দাবি দাওয়ার সমাধান কিভাবে হতে পারে, সে ব্যাপারেও তাদের মত বা পরামর্শ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে আসল সমাধানের পথটা একটু প্রশস্ত করতাম। কোনো সন্তানের পিতামাতা তাদের সন্তানের একটা চাকুরীর জন্য কত বেশী দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকেন, সেটা শুনতাম। আমি শুনতাম, অভিবাসীরা কিভাবে প্রতিনিয়ত বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন এবং তাদের আত্মীয় স্বজনদের ভ্রমণ ভিসার জন্য তাদেরকে কি ধরনের ঝক্কি ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। সেই সাথে আমি প্রায় শুনতাম, দিনে দিনে এখানকার মানুষেরা কিভাবে ঋণের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়চ্ছে। কেনাকাটার পর দোকান থেকে বের হলে, কথা বলার জন্য আমি যাদের দিকে এগিয়ে কথা শুরু করতাম, শুনতাম, তারা অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের পর্যাপ্ত খাবার দিতে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হন।

আমি কারো কারো কাছে এটাও শুনতাম, ওখানকার কিছু বাসিন্দা সেই সংসদীয় এলাকার দীর্ঘদিনের যে বৈশিষ্ট্য সেটার আমুল পরিবর্তন করে ফেলছে। গ্রীক ও ইটালিয়ান অভিবাসীরা পাপিনিউ’তে সবচেয়ে বেশী প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং বলা যেতে পারে, ওই এলাকার প্রধানতম শক্তিই ছিল তারা। কিন্তু তারাও এখন আস্তে আস্তে এই এলাকা ছাড়ার কথা চিন্তা করছে। বিভিন্ন দেশ থেকে পাপিনিউ’তে নতুন অভিবাসীদের যে ঢল আসতে শুরু করেছে তাতে পাপিনিউ’তে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর রেস্টুরেন্ট, উৎসব আর কমিনিউটি সেন্টার গড়ে উঠতে থাকে। এগুলো কিন্তু পাপিনিউ’কে অনেক বেশী প্রাণবন্ত করে তোলে। দীর্ঘদিন ধরে পাপিনিউ’তে বাস করে এমন অনেকের কাছ থেকেই আমাকে শুনতে হয়েছে, তাদের আশপাশ যেভাবে নিত্য নতুন মানুষের ভীড়ে ভরে উঠছে, সেটাতে তারা বেশ চিন্তিত।
সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতায় আমি প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হচ্ছিলাম। কেউ কেউ আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল যে, পাপিনিউ’র গোড়াপত্তনি শুরু হয়েছিল ভিল্লারে থেকে। ওখানে যদিও এখন ল্যাটিনো’রাই বেশী বাস করে, কিন্তু সেই জায়গাটা এক সময় গড়ে তোলেন ফরাসী কানাডিয়ান কৃষক আর রাস্তাঘাট মেরামতকারী শ্রমিক। সেই ঘোড়া আর টানা গাড়ির সময়ে তারা ঐ এলাকাটা ধীরে ধীরে বাসযোগ্য করে তোলে। পাপিনিউ এর পার্ক-এক্সটেনশন এলাকার গ্রীকরা এখন প্রায়ই লক্ষ্য করেন, তাদের ছেলেমেয়ে আর নাতিপুতিরা এই এলাকা ছেড়ে সেই দূরের দ্বীপের দিকে গিয়ে নতুন আবাস গড়ে তুলছে, আর তাদের সেই বাড়ীগুলো মূলত কিনে নিচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীরা। ঠিক তেমনি সেন্ট-মিশেল এলাকার সেই ঐতিহ্যবাহী ইটালিয়ান অধ্যুষিত এলাকাটা ধীরে ধীরে হাইতি আর উত্তর আফ্রিকার অভিবাসী দ্বারা ভরে উঠছে। এই যে, নতুন নতুন মানুষের যে আগমন, তার ফলে এই এলাকায় যে বিভিন্ন ঝক্কি ঝামেলার সৃষ্টি হতে থাকে, তা হচ্ছে, শুধু নতুন অভিবাসীরাই চাকুরী সমস্যাই পড়েনি, বরং যুবকদের জন্যও চরম চাকুরী সংকট দেখা দেয়। এই কয়েক দশকে প্রায় গোটা কানাডা জুড়েই প্রতিটি এলাকায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাসের চিত্রটা এমনই হতে শুরু করে। কিন্তু পাপিনিউ’তে যে বহুসংস্কৃতির একটা সুন্দর পরিবেশ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল, সেটা সত্যিই ছিল চমৎকার। ব্যক্তিগতভাবে এই এলাকার এই বৈচিত্রতা আমার খুব ভালো লাগতো, কিন্তু আমার মধ্যে এই ভালোলাগার ভাবনাটা প্রায়ই হোঁচট খাচ্ছিল, যখন নির্বাচনে কি হবে বা কিভাবে নির্বাচনে সফল হওয়া যায়, এ চিন্তার ভাবনায়।

লিবারেল পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রার্থী আর দু’জনের সাথে আমাকে লড়াই এ নামতে হয়েছিল। ওদের মধ্যে দলের নেতাদের পছন্দের ছিল ম্যারী ডেরস আর ইটালী ভাষার সংবাদপত্রের প্রকাশক বাসিলিও জিওরদানো, যারও পেছনে লিবারেল পার্টির একটা বড় অংশের সমর্থন ছিল। দু’জনেই নির্বাচন করার জন্য যা যা প্রস্তুতি লাগে তা করে ফেলেছিল। সেই সাথে নির্বাচনী প্রচারণা আর অন্যান্য কাজ করার জন্য পাপিনিউ’র বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ থেকে তারা পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মী নিয়োগ দিয়ে ফেলেছিল। ঐ ধরনের কোনো প্রস্তুতি বা আয়োজন আমার একেবারেই ছিল না। যেখানে আমি কাজ করার জন্য আমার দু’এক জন বন্ধুবান্ধবকে যোগাড় করছি, সেখানে তারা ডজন’কে ডজন কর্মী নিয়ে কাজে নেমে গেছে।
আমার জন্য বিষয়টা আরো বেশি জটিল হয়ে পড়েছিল, যখন কুইবেকের লিবারেল পার্টির প্রেসিডেন্ট ফরাসী সংবাদ মাধ্যমে জানিয়ে দিলো যে নির্বাচনে পদপ্রার্থী হওয়ার আমার কোনো যোগ্যতাই নাই এবং আমার তেমন কোনো পরিকল্পনা বা ক্ষমতাও নাই। শুধু লিবারেল পার্টি থেকেই আমাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বললো না, বরং রাজনৈতিক পণ্ডিত আর রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছিল যে, আমার রাজনৈতিক জ্ঞান গরিমা কিছু নেই আর কোন জায়গা থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিৎ, সে সম্পর্কেও আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, ফলে আমার পক্ষে নির্বাচনে প্রার্থী হবার ভোটেই জেতা সম্ভব নয়। আর আমার বøক কুইবেকোইসের বারবোট এর মত একজন তারকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার বিষয়তো কেউ ভাবতেই পারে না। তারা এটাও বলেছিল, আমি জেনে শুনে এক পরাজয়ের গ্লানির মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, তাদের মতে আমার এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে আমি কতটুকু নাবালক আর বোকা, তারা আরো মন্তব্য করেছিল, আমার বাবার রাজনৈতিক জ্ঞানের অর্ধেকও আমার ভিতর নেই।

এক বালিকার সাথে কৌতুক ভঙ্গিতে জাস্টিন ট্রুডো

সত্যি বলতে কি, আমার প্রার্থীতার ব্যাপারে তারা যে অংক কষেছিল সেটা আমার একেবারেই পক্ষে ছিল না, এবং মনোনয়ন সভার দু’মাস পূর্বে আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারলাম, আমাকে জিততে হলে, আমার কিছু ব্যাপারে প্রত্যক্ষ সাহায্য দরকার। সময়টা ছিল মার্চের মাঝামাঝি, রেইনে হেবার্ট নামে আমার এক প্রিয় বন্ধু আমাদের দুই সদস্য বিশিষ্ট দলে যোগ দিতে চাইলেন। রেইনে ছিলেন একজন অভিজ্ঞ কুইবেক ভিত্তিক রাজনৈতিক প্রচারণাকারী। তিনি আমার বাবার সময় থেকে ফেডারেল লিবারেল পার্টির হয়ে প্রচারণার কাজ করে আসছিলেন। সেই সাথে আমি ফ্রাংকো লাকোনো’কে আমার ক্যাম্পেইন ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলাম। তখন তারা দু’জনে মিলে কিভাবে পাপিনিউ’র মানুষের কাছে আমাকে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য হিসেবে তুলে ধরা যায়, সেই কাজে লেগে গেলেন। তাদের সাহায্য সহযোগিতায় আমি প্রথমেই কাজ শুরু করলাম লিবারেল পার্টির সেই সব সদস্যদের খুঁজে বের করতে যারা এক সময় সদস্য ছিল কিন্তু এখন নেই, অথবা যারা লিবারেল পার্টির বিষয়ে আগ্রহ হারিয়েছে। আমি গুনে গুনে তাদের বাড়ীতে যেতে শুরু করলাম এবং আমার লিবারেল পার্টির কাজ কর্মে জড়িত হবার জন্য অনুরোধ করতে থাকলাম, যদিও কিছু মানুষ লিবারেল পার্টিতে আবার ফিরে আসা বা রাজনীতির সাথে যোগাযোগ রাখার ব্যাপারে আর আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। তবে আমি দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদেরকে যে সব কথাগুলো বলতাম, সেগুলো অনেকেরই খুব ভালো লেগেছিল, ফলে অনেকেই আবার লিবারেল পার্টিতে ফিরে আসলেন। এপ্রিলের ২৯ তারিখের মধ্যে আমরা লিবারেল পার্টির বারো’শ সদস্য কার্ড বিক্রি করে ফেললাম, অন্যান্য দু’জন প্রার্থী মিলে যতগুলি সদস্য কার্ড বিক্রি করেছিল, আমি একাই সেটা করেছিলাম।

সভার এর দিন যত ঘনিয়ে আসতে শুরু করছিল, আমি ততবেশী আশাবাদী হয়ে পড়ছিলাম। এপ্রিলের শেষের দিকে আমার কাজ কর্মের প্রক্রিয়া আর পরিশ্রম দেখে বেশ কয়েকজন নির্বাচন বিশ্লেষক আমার পক্ষে কথা বলা শুরু করলেন। তবে তখন সত্যিই আমার একান্তভাবে মনে হচ্ছিল, অন্য দু’জন প্রার্থীর চেয়ে আমার রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি আর সেই সময় লিবারেল পার্টিতে যা কিছু খুবই বেশী প্রয়োজন ছিল, সেই সবের সমাধানের জন্য আমি তাদের চেয়ে অনেক বেশী যোগ্য। একদিন এক স্থানীয় ব্লগার আমাদের তিন প্রার্থীকেই দারিদ্র্য, রাজনীতি, অভিবাসন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল, আমি তখন আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর ঐ সংসদীয় এলাকায় কাজ করা অভিজ্ঞতা থেকে তার প্রত্যাশিত উত্তর দিয়েছিলাম। কিন্তু অন্যান্যরা যে উত্তর দিয়েছিল, তাতে ওর সন্তোষ্ট হবার কিছুই ছিল না, বরং তাদের উত্তরে ওটাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, পাপিনিউ নিয়ে তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান আর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি তেমন কিছুই ছিল না। সেই ২০০৭ সালেই আমি জানতাম, যে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রচারণায় ইন্টারনেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে।

আমার খুবই আনন্দ লেগেছিল, ঐ বøগার এক সময় ওয়েব সাইটে তার লেখায় বরাবরই লিখে যেতো, এই নির্বাচনে জেতার কোনোকিছুই আমার মধ্যে নেই এবং আমি নির্ঘাত পরাজিত হতে যাচ্ছি, সেই বøগারই আমার কথা সামনা সামনি শুনে তার ওয়েব সাইটে আমার পক্ষে লেখা শুরু করে দিলো। আমার নির্বাচনের পথে সফলভাবে এগুনোর এটা একটা সামান্য উদাহরণ হিসেবে আমি শুধু উল্লেখ করলাম। তবে আমার মনে হয়, এই সব লেখা ও প্রচারণাগুলো আমার পক্ষে বেশ কিছু ভোটার আনতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এখন আমি বাস্তবতা থেকে বুঝতে পারি, এখনকার সময়ের রাজনৈতিক কর্মী আর সমর্থকরা নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ডিজিটাল মিডিয়াকে অন্যতম কার্যকরী মাধ্যম হিসেবেই মনে করে। (চলবে)