শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

এই দেশে কাউন্সেলিং সিস্টেমটা খুব মজার। এদের কাজ হল হৃদয় বৈকল্যের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা। মনের যে কথা কাউকে বলা যায় না, মন খুলে সেসব কথা কাউন্সেলরকে বলা যায়। কাজের মাধ্যমে বা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের মাধ্যমে গেলে এই সার্ভিস সম্পূর্ণই ফ্রি। মনোযোগ দিয়ে সে সব কথা শুনে এবং মাঝে মাঝে দু’একটা প্রশ্ন করে এটা ওটা জেনে নেয়। ক্লায়েন্টের কথা বলা শেষ হলে তখন তার বলার পালা আর ক্লায়েন্ট তখন শুনবে। মোট কথা সে বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, ক্লায়েন্টের সমস্যা তেমন কোন সমস্যা নয় এবং কি কি উপায় অবসাদগ্রস্থতা বা অন্নান্য সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। আর একান্তই যদি কোন কিছুতেই কিছু না হয় তাহলে ডিপ্রেশনের ওষুধ ধরিয়ে দেয়।
চিকিৎসার প্রথম অংশটা আমার খুব পছন্দ। কারণ কেউ ধৈর্য্য ধরে আমার বকবক শুনছে এবং সাথে তাঁর নিজের সমস্যার গল্প জুড়ে দিচ্ছে না বা মনে মনে সমালোচনা করে আমাকে তুলোধুনো করছে না। এটা ভাবলে এমনিতেই মন ভাল হয়ে যায়। যাই হোক, নির্দিষ্ট দিনে আমি কাজের কাউন্সেলরের সাথে দেখা করলাম, এখানে সুবিধা ছিল এই যে তাঁর জানা ছিল আমার তাঁর কাছে যাবার কারণ। সে শুরুতেই হালকা দু’একটা কথা বলে মূল কথায় চলে গেল। সে বলল যে, যেহেতু সে জানে আমার আসার কারণ তাই সে কিছু প্রশ্ন করতে চায় সেশন শুরুর আগে। আমার ব্যক্তিগত জীবনকে জানবার জন্য বিভিন্ন প্রশ্ন করল তারপরে আমাকে বলবার সুযোগ দিল। আমি হাসিমুখে বললাম যে, বেলার প্রয়াণে আমার মন খারাপ এইটুকুই এবং সেটাও আমি অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি। আমি জানি বেলা যেখানে গিয়েছে, সেখানে সে অনেক ভাল আছে! অতয়ব আমার কোন সমস্যা নেই।

আমার এই কথায় যে সে খুব একটা খুশি হয়নি সেটা তাঁর মুখ দেখেই বোঝা গেল। কাউন্সেলর আমার এই উত্তরকে উইথড্রন বা ডিনায়াল হিসেবে ধরে নিয়ে আমাকে বিভিন্নভাবে বোঝালো, আমি কি করে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। সাথে সে এও বলল যে, আমার বিষন্নতা আমার অনাগত সন্তানের জন্য ভাল নয়। সব কথার মধ্যে তাঁর এই কথাটা আমার সব থেকে পছন্দ হল। আমি কাউন্সেলরকে বললাম যে, আমি ঠিক আছি, আমি জানি বেলা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং অপেক্ষাও করছিলেন, আমি তাঁকে মিস করছি ঠিকই কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে আমি ঠিক হয়ে যাব। সে খুব খুশি হল আমার কথায় বলল, আমাকে যা আনন্দ দেয় তাই যেন বেশি বেশি করে করি। মনে মনে বললাম, ১ মাসের পেইড ভ্যাকেশন দাও বাবা, আমার থেকে খুশি আর কেউ হবে না। কিন্তু হায়! তা তো আর হবে না; তাই লক্ষি মেয়ের মত তাঁর কথায় সায় দিয়ে ভেগে এলাম কাউন্সেলরের কাছ থেকে।

সপ্তাহ শেষে অরুণ এল মাসিমার জিনিসপত্র নেবার জন্য। জিনিসপত্র আর কি; একটা স্যুটকেস আর ছোট্ট একটা বক্স। অরুণ এলে আমি ওকে সেগুলো সব বের করে দিলাম স্টোরেজ থেকে। অরুণ বলল, ও মাসিমার রুমটা দেখতে চায়। আমি ওকে নিয়ে গেলাম সাথে করে, ভেজানো দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই যেটা সর্বপ্রথম চোখে পরে সেটা হল মাসিমার খালি চেয়ার। অরুণ বিষণ্ণ চোখে চেয়ে রইলো সেদিকে, আমি খুব আস্তে করে বললাম যে মাসিমা খুব ভাল আছেন এখন। অরুণ জানতে চাইল, আমি কি করে এত নিশ্চত হলাম যে তিনি খুব ভাল আছেন। আমি বললাম যে মাসিমা এখন মেসোর সাথে আছেন আর বছরের পর বছর তিনি এর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। অরুণ ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে মাসিমার খালি চেয়ারটাতে বসে বাইরে তাকিয়ে বলল যে, সে অনেক অল্প বয়সে দেশ ছেড়েছে, মায়ের অনেক কিছুই সে জানে না। বিদেশী মেয়ে বিয়ে করায় এমন একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছিল যে মাকে আর কাছেই পাওয়া হয়নি তেমন ভাবে। অরুণ জানতে চাইলো আমি মাসিমার বিষয়ে অনেক গল্প জানি কিনা? আমি বললাম- ৮ মাস অনেক সময়, অনেক গল্প করেছেন মাসিমা। অরুণ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল যে সে সারাজীবন তার মায়ের সন্তান হয়েও জানতে পারেনি অনেক কিছু। অরুণের ধারণা অরুণের বিয়ের কারণে মাসিমা ওর কাছে থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। কথাটা যদিও বা কিছুটা ঠিক কিন্তু পুরোটা ঠিক নয় আর আমি সেটা অরুণকে বলতেও পারি না, তাই আমি বললাম যে মাসিমা জানতেন ওরা কত ব্যাস্ত আর ভাষাগত সমস্যার কারণেও মাসিমা ওর বউমার সাথে ঘনিষ্ট হতে পারেননি। অরুণ হয়ত কিছুটা স্বস্তি পেল আমার কথায়। আমাকে বলল, সময় করে একদিন কল করে আমার কাছ থেকে শুনবে ওর মায়ের গল্প। আমি বললাম, “নিশচই”। অরুণ জর্জের সাথে দেখা করতে চাইল, আমি রুম নাম্বার বললে সে বাক্স-প্যাটরা নিয়ে জর্জের ঘরের দিকে চলে গেল। আমি ওর অপসৃয়মান পথের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, ‘আরেকটা অধ্যায়ের ইতি হল’।
ভিক্টোরিয়া হোমে এসেছে দু’মাস হল কিন্তু আজ পর্যন্ত তাকে কোন খাবারের জন্য ডাইনিং রুমে নেয়া যায়নি। সে প্রয়োজনে না খেয়ে থাকবে কিন্তু কিছুতেই ডাইনিং হলে যাবে না। যেহেতু ভিক্টোরয়ার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই তাই এই বিষয়ে কারো কাছে সাহায্য চাওয়া বা নালিশ করা সম্ভব হয়নি, যা করার হোমকেই করতে হবে। অনেক কাহিনী শেষে সাব্যস্ত হল যে, ৩ বেলার খাবার ওর রুমে নিয়ে যাওয়া হবে কিন্তু তাতে হোমের নিয়ম ভঙ্গ হয় এবং আরো অনেকেই এই আবদার করতে পারে ভেবে হোম ভিক্টোরিয়ার পাওয়ার অফ এটর্নী টমাসকে কল করে জানাল যে, ওকে প্রাইভেটিলি নার্স হায়ার করতে হবে ৩ বেলা খাবার খাওয়ানোর জন্য। এই বিষয়ে ভিক্টোরিয়াকে জানানো হলে সে চেঁচিয়ে লোক জড় করল এটা জানানোর জন্য যে, হোম ওকে ফাইনান্সিয়ালি এবিউজ করছে। এত টাকা দিয়ে সে হোমে থাকে আবার আলাদা করে কেন তাকে লোক হায়ার করতে হবে? ভিক্টোরিয়ার কথায় যুক্তি আছে কিন্তু হোমের রুলস মানতেই হবে। অতয়ব বাইরে থেকে নতুন নার্সের আগমণ হল ভিক্টোরিয়ার সাহায্যের জন্য, ৩ বেলা ১ ঘন্টার জন্য কেউ আসবে ওকে খাওয়াতে। শুরুতে হোমের নার্সদের জন্য নোটিস বোর্ডে বড় করে একটা নোট ঝুলানো হয়েছিল এই বলে যে “ভিক্টোরিয়ার প্রাইভেট সাহায্যের প্রয়োজন, হোমের কোন নার্স যদি আগ্রহী থাকে ৩ বেলা ভিক্টোরিয়াকে খাবার খাওয়ানোর জন্য (রেগুলার শিডিউলের বাইরে) সে যেন নার্সিং ষ্টেশনে যোগাযোগ করে এবং এই কাজের জন্য আওয়ারলি রেট বেশী দেয়া হবে। আশ্চর্যজনক ভাবে কেউ এগিয়ে এল না। আমি দু’একজনকে জিজ্ঞেস করাছিলাম কেন কেউ এই এক্সট্রা ইনকামে আগ্রহী নয় এবং উত্তর পেয়েছিলাম এই যে,- “We alreadz had enough of Vcitoria, for the love of God we don’t need it anymore; please forgive us!”… অগত্যা টমাস বাইরে থেকে নার্স নিয়ে এল। প্রথম দিনেই সকালবেলা ভিক্টোরউয়ার রুম থেকে হুলুস্থুল শব্দ, খাবারের প্লেট ছুড়ে মেরেছে ভিক্টোরিয়া ওর নতুন নার্সের গায়ে। সারা গায়ে খাবার মাখানো নার্স কাঁদতে কাঁদিতে বেরিয়ে চলে গেল এবং একেবারেই চলে গেল। পুরো বিষয়টা অনিশ্চিত হয়ে গেলে টমাসকে কল করা হল।
মাসিমা চলে যাবার পর থেকে জর্জ ডাইনিং হলে মাসিমার টেবিলে একা একা বসে বিমর্ষ ভাবে খায়, কোন দিকে তাকায় না, কারো সাথে কথা বলে না। চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যায়। আমার মত জর্জও কাউন্সেলিং করেছে কিন্তু এই জিনিষটা ওর কাছে ডাল-ভাতের মত। সারা জীবনের এক চতুর্থাংশ সময় ওর কাউন্সেলিং করে কেটেছে, তাই কাউন্সেলরের কথা ওর এক কান দিয়ে ঢোকে আর এক কান দিয়ে বেরয়। আমার মাথায় একবার একটা দুষ্টু বুদ্ধি এল যে, জর্জের সাথে ভিক্টোরিয়ার পরিচয় করিয়ে দেই, তারপরে নিজেকেই নিজে ছি ছি করলাম। বেচারা জর্জের প্রতি এর থেকে বড় অন্যায় আর হবে না, বিদ্ধস্ত জর্জকে এভাবে অত্যাচার করার চিন্তা মাথায় আসার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিলাম। আজ জর্জ ডাইনিং এ খেতে আসেনি বলে আমি ওর রুমে খোঁজ নিতে গেলাম, গিয়ে দেখি ভর দুপুরে অনেক ড্রিংক করে বুদ হয়ে বসে আছে সে, খুব অবাক হলাম জর্জের এই অদ্ভুত আচরণে, এমনটা আগে কখনো দেখিনি। আমি গিয়ে ডাকলাম, চোখ খুলে একবার তাকাল তারপরে আর সাড়া দিল না। আমি পালস ধরে দেখলাম ঠিক আছে। ডিউটিরত জচঘ কে খুঁজে বের করে ঘটনার ববরণ দিয়ে বললাম জর্জকে চেক করবার জন্য। সে তড়িঘড়ি জর্জের ঘরের দিকে চলে গেল। অরুণ আসা ছাড়া দিনটা আজ খুবই চুপচাপ ছিল, দিনের শেষে আমি যখন সব গোছাচ্ছি এবং ভাবছি যাবার আগে জর্জকে একবার দেখে যাব ঠিক তখনই ফোনটা এল, আমার সহকর্মী লিন্ডা ফোনটা ধরল। ওর কথা বলার ধরণে বুঝলাম সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে, কয়েকবার জর্জ-জর্জ শুনলাম। ফোন রাখার পরে ওর হরবরতা শুনে যেটুকু বুঝলাম যে দুপুরের পরে কোন এক সময়ে জর্জের নেইবার বারবারাকে নিয়ে জর্জ সেই বেসামাল অবস্থায় কোথাও যাচ্ছিল গাড়ি চালিয়ে এবং যাবার পথে মুখোমুখি একটি ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে জর্জের তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়েছে এবং বারবারা মৃতপ্রায়। আমি থমকে গিয়েছিলাম, বোবা হয়ে গিয়েছিলাম! ভোঁতা একটা অনুভূতি নিয়ে উঠে লিণ্ডার পেছন পেছন হোমের ডিরেক্টরের রুমের দিকে গেলাম। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা