শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

আমার শরীরটা ধীরে ধীরে ভারি হচ্ছে বুঝতে পারি আর ভীষণ শরীর খারাপ থাকে। ইদানিং কাজে আসাটা রীতিমত যুদ্ধ আমার জন্য। কিছুই খেয়ে পেটে রাখতে পারি না, সব বেরিয়ে যায়। এর মধ্যে এত অসুস্থ হয়েছিলাম যে ৯১১ ডেকে হসপিটালে যেতে হয়েছিল। আমারোও ভীষণ ডিহাইড্রেশন হয়ে গিয়েছিল। মাঝরাতে হঠাত মনে হল নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমি ৯১১ কল না করে ইমারজেন্সি হেলথ লাইনে কল করলাম। ওরা আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে একটা প্রাথমিক এসেসমেন্ট করে বলল- ‘এক্ষুনি ইমার্জেন্সিতে যাও’। আমি ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। আমার সন্তানের বাবা তখন রাতের শিফটে কাজ করত। আমি তাকে কল করে জানাতে সে ৯১১ ডাকতে বলল এবং বলল যাবার আগে তাকে ফোন করে কোন হাসপাতালে যাচ্ছি সেটা জানাতে। আমি প্যারামেডিক্সদের কাছ থেকে হাসপাতালের ঠিকানা জেনে নিয়ে তাকে জানিয়ে স্ট্রেচারে উঠে গেলাম। ওরা এম্বুলেন্সেই একটা স্যালাইন শুরু করে দিল। হাসপাতালে নিয়ে মনে হয় ৩/৪টে স্যালাইন দিয়েছিল আর অনেক রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা করল। তবে আলট্রাসাউন্ডের অভিজ্ঞতাটা ছিল সব থেকে হৃদয়স্পর্শী আলট্রাসাউন্ডের মেশিন চালু হতেই টেকনিশিয়ান ভ্যলিউম বাড়য়ে দিল। শব্দ শুনছি- ধুক ধুক, সে বলল তোমার সন্তানের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছ? আমার চোখে তখন আনন্দ, মায়া আর ভালবাসার বন্যা। আঙ্গুল দিয়ে স্ক্রিনে কিছু একটা দেখালো, চোখের জলে ঝাপসা তাকে দেখলাম কিন্তু কিছু বুঝলাম না, জানলাম সে ভাল আছে। শারিরীক অবয়ব বোঝার মত সময় তখনও নাকি হয়নি। থাক এত বুঝে কাজ নেই। তুমি বলেছ সে ভাল আছে তাতেই আমি মহা খুশী। আমাকে রুমে ফেরত আনার পরে সন্তানের পিতা এলে আমি তাকে বললাম যে আমি আমাদের আদরের টুকরোটাকে দেখেছি, তার বুকের ধুক ধুক শুনেছি। সে খুব আফসোস করল এরেক্টু আগে এল না বলে।

বিছানায় শুয়ে এখন ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা। ঘন্টা দু’য়েক পরে এসে সে জানাল যে সব কিছু ঠিক আছে, কোন চিন্তা নেই। ডাক্তার একটা ওষুধ লিখে দিল যেটা খেলে আমার খাবার বের হয়ে যাবে না কিন্তু ৩০টা ছোট্ট বড়ির দাম ১৫০ ডলার, ২০০৫ সালে ১৫০ ডলার অনেক টাকা। শুনে আমার চক্ষু কপালে। দয়ালু ডাক্তার সেটা বুঝতে পেরে আমাকে একটা স্যাম্পেল কৌটা ধরিয়ে দিল যেখানে ২ মাসের সাপ্লাই ছিল। ডাক্তার কৌটার গায়ে একটা ওয়েব এড্রেস দেখিয়ে বলল ওখানে ঢুকে এপ্লাই করতে ফ্রি ওষুধের জন্য। আমার এই যে খাবার পেটে না রাখতে পারাটা সাময়িক নয় এবং আমি যে পুরো ১০ মাস এই সমস্যায় ভুগব ডাক্তার সেটা পরিষ্কার বলে দিল, বলল এটা একটা রোগ এবং এর নাম হল Hyperemesis Gravidarum (HG) ডাক্তার ফিরে গিয়ে একটা চিঠি লিখে এনে দিয়ে বলল এই চিঠিটা ওদের ওয়েবসাইটে আপলোড করে দিতে এবং ফর্মফিলাপ করতে। ওরা প্রয়োজনে ডাক্তারের সাথে কথা বলে এবং আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি এসেস করে হয়ত আমাদের পুরোটা সময় ফ্রি ওষুধ সাপ্লাই দেবে। শুনে কিছুটা ভরসা পেলাম এবং ডাক্তারকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম। সন্তানের পিতা সকালে অফিসকে জানিয়ে দিয়েছিল যে আমি অসুস্থ এবং ২ দিন কাজে আসব না। হাসপাতালে বসেই একটা বড়ি খেয়ে নিয়েছিলাম, তাই বমি বমি ভাবটা ছিল না। বাড়ি ফিরে এসে একটা ওয়ার্ম শাওয়ার নিয়ে একটু স্যুপ খেলাম। একটু অপেক্ষা করে দেখলাম যে বমি পাচ্ছে না। কি যে একটা আরাম হল বলে বোঝাতে পারব না। লম্বা একটা ঘুম দিলাম। পরেরদিনও যেহেতু কাজে যাইনি তাই অনেক রেস্ট নিলাম সাথে সারাদিন সিডি তে ক্লোজাপ-১ দেখে দিন পার করে দিলাম।

দু’দিন রেস্ট নিয়ে আলসে হয়ে গিয়েছিলাম। পরের দিন কাজে যেতে ইচ্ছে করছিল না। সিক লিভগুলো এখনি খরচ করে ফেলতে মন চাইল না, তাই রেডি হয়ে চলে গেলাম, কিন্তু মর্নিং কফি খুব মিস করি এখন। ধীর পায়ে অফিসে ঢুকলাম। নিজের জায়গায় গিয়ে বসতেই দেখতে পেলাম কত্তগুলো ফাইল জমা হয়ে আছে। মেজাজটা একটু খারাপ হল। সবাই জানতে চাইল আমি কেমন আছি, আমার অনাগত সন্তান কেমন আছে। খুব ভাল লাগল আমার জন্য ওদের নিখাদ ভালবাসা দেখে। ব্রেকফাস্ট টাইমটা শেষ হতেই কিচেন থেকে আমার জন্য একটা গরম মাফিন, একটা ডিম সেদ্ধ আর এককাপ হট চকলেট চলে এল। আমার জন্য খাবার এলে এখন কেউ কিছু বলে না। আমিও আরামে মাফিনে একটা কামড় বসিয়ে এক সিপ হট চকলেট খেয়ে ফাইলগুলো তে মনোযোগ দিলাম। এর মধ্যে কাজে আবার মন বসে গিয়েছে। হোমে ঢোকার সাথে সাথে মুডটা যেন অন্যরকম হয়ে যায়। আমি সুনিতাকে একটা কল করলাম। বিপিন বাবুর বিষয়ে ওর সাথে আর কথা বলার সুযোগ পাইনি। সুনিতা জানাল যে প্রথম সপ্তাহে বিপিন বাবু একটু চুপচাপ ছিলেন কিছু পরের সপ্তাহে তিনি কথা বলতে শুরু করেছেন। অনেক গল্প করছেন সুনিতার সাথে। হেটে হেটে কফিও খেতে গিয়েছেন ওকে নিয়ে। সুনিতার রান্না খেয়ে তিনি ভীষণ খুশি, বলেছেন অনেক দিন পরে ঘরোয়া ইন্ডিয়ান রান্না খেয়ে সে খুব তৃপ্ত । আমি সুনিতাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানালাম। সুনিতা বলল বিপিন বাবু আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছেন আমি যেন তাঁকে একটা কল দেই। আমি বিপিন বাবুর বাড়ির নাম্বারে কল করলাম। ফোনটা বাজতে বাজতে ভয়েস মেইলে চলে গেল, বুঝলাম বিপিন বাবু মেলিসার কন্ঠ শুনছেন, আমিও শুনলাম। আবার ফোন দিলাম তিনি ফোন ধরলেন। আমি নিজের পরিচয় দিতেই তিনি উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন।

বিপিন বাবু বললেন সুনিতা দারুণ একটা মেয়ে, অসাধারণ ওর ব্যাবহার, রান্না সব কিছু, আরো বললেন যে তিনি যে কোন বিষয়ে ওর সাথে আলাপ করতে পারেন এবং সুনিতাও আলাপে যোগদান করে এবং সে গভীর জ্ঞান রাখে সব বিষয়ে। আমাকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন ঠিক মানুষটিকে পাঠানোর জন্য। শুনে আমি যার পর নাই খুশি হলাম, আমি জানালাম যে এটাই আমার কাজ। তাকেও আমি ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, সে যেন প্রয়োজনে আমাকে কল করে। বিপিন বাবু বললেন যে রুহাও নিয়মিত খোঁজ রাখে। আমাদের কম্পানিকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখলেন। সকাল বেলা মনটা ভাল হয়ে গেল। ক্লায়েন্টের সাথে ওয়ার্কার ম্যাচিং করাটা কাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। সব সময়ে সম্ভব হয় না তখন বার বার নার্স চেঞ্জ করতে হয়। বিপিন বাবুর সাথে কথা শেষ করে আমি খাবারটা শেষ করলাম তারপরে ফাইলগুলো টেনে নিলাম। প্রথম ফাইলটাই এঞ্জেলার, আমি নতুন এসেসমেন্টের জায়গাটা মনযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলাম। ডক্তারের ভাষ্যমতে এঞ্জেলার ডেমেশিয়ার প্রগ্রেস খুব ফাস্ট। ওষুধ বদলে দিয়েছে স্লো প্রগ্রেসের জন্য। ডাক্তার আরো লিখেছে যে ও এখনো এগ্রেসভের পর্যায় যায়নি। এখনো সে ক্যমিউনিকেট করে এবং কাছের মানুষদের চিনতে পারে অতয়ব আপাতত শুধু ওষুধ পরিবর্তন ছাড়া আর কিছু করতে হবে না। যাক এঞ্জেলাকে এক্ষুনি ৩ তলায় যেতে হচ্ছে না বলে আমি খুব খুশি হলাম। ৩ তলার কথা মনে হলেই আমার কেমন অবসন্ন লাগে। তবে এই ঘটনার পরে ডাক্তারের রেকমেন্ড অনুযায়ী হোমের সব ফ্লোরের কর্মীদের জন্য একটা ডেমেনশিয়া ট্রেনিংয়ের ব্যাবস্থা করা হল, কারন সব ফ্লোরেই কয়েকজন আর্লি স্টেজের ডেমেনশিয়া রেসিডেন্ট রয়েছে। মনে হল আজ দিনটাই ভাল যাবে! সব সুখবর!

কিছুক্ষণ পরে ন্যান্সি এল আমার খবর নিতে, সে জেনেছিল যে আমি ২দিন সিক কল করেছি। ওকে জানালাম ভাল আছি। ন্যান্সি আমায় জানাল যে জনের ফ্লোরে একজনের স্ট্রোক করে সে এখন হাসপাতালে, বেঁচে যাবে তবে আর হাটাচলা করতে পারবে না তাই হাসপাতাল থেকে ফিরে সে অন্য ফ্লোরে যাবে আর ওর রুমটা খালি হল বলে ন্যান্সি ওখানে চলে যাবে কারণ সে অনেক আগে আপ্লাই করে রেখেছিল বলে সে রুমটা পেয়ে গেল। আমি ন্যান্সির জন্য খুব খুশি হলাম, সে আর জন এখন একসাথে খেতে পারবে, যখন ইচ্ছে একসাথে সময় কাটাতে পারবে। আমি ন্যান্সিকে অভিনন্দন জানিয়ে বললাম যে আমরা ওকে খুব মিস করবো, ন্যান্সি আমাকে একটা হাগ দিয়ে বলল নিজের যতœ নিতে এবং মাঝে মাঝে ওদের ফ্লোরে যেতে। বললাম তুমিও এস আমাদের দেখতে। বিদায় পর্ব দেখে মনে হচ্ছে ন্যান্সি অন্য কোন জায়গায় চলে যাচ্ছে কিন্তু আমি জানি আসলেই এর পর থেকে ওর সাথে আমার খুব কম দেখা হবে যদি ন্যান্সি আমাদের কাছে না আসে। যে কোন বিদায়ই কষ্টের। এত আনন্দের মধ্যে মনটা একটু ভারি হয়ে গেল।ন্যান্সিকে বললাম যে ৮ তলায় অনেক পুরুষের মন ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে! ন্যান্সি বলল অনেক নারী আনন্দে পার্টি দেবে, আমি বললাম সে পার্টিতে তুমিও এস, ন্যান্সি হাসতে হাসতে চলে গেলে আমি নিরবে ফাইলে মনোযোগ দিলাম। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা