সাজ্জাদ আলী : প্রতিদিনের মতো আজও বেলা উঠার বেশ আগেই সতীশ দাদুর দিন শুরু হয়েছে। মেঠো পথ দিয়ে সে হেঁটে এগুচ্ছে। গন্তব্য আমার দাদীর বাড়ি। পাশের গাঁ, গজারিয়ায় তার বাড়ি। টানা পায়ে হাঁটলে মিনিট বিশেকের দুরত্ব। দু গাঁয়ের মধ্যে চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হাঁটা পথ পড়েছে। শীতের ভোর, প্রতিটি ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু। ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারিদিক। পঞ্চাশ হাত দূরে যে কী আছে, তা দেখার উপায় নেই। সতীশ দাদুর খালি পা, গায়ে কোনো কাপড় নেই। পরনে শুধু একখন্ড নেংটি। ডান হাতে একখানা লাঠি, আর বাম হাতে দুধভর্তী পিতলের ঘটি। তার বয়স আন্দাজ করা কঠিন। কেউ কেউ বলে অনুমান ৬৫ বছর হবে। শীতে কাঁপছে বুড়ো, তবুও হাঁটছে। ঘন ঘন পূবদিকে তাকাচ্ছে, কখন বেলা উঠবে। বেলা উঠলে ঠান্ডা কমে, শরীরে একটু ওম হয়।

সতীশ চন্দ্র বালা, আমার দাদীর বাঁধা গোয়ালা। গত ২০/২৫ বছর ধরে প্রতিদিন সকালে সে দুধ দিয়ে যায়। ঝড় বৃষ্টি বাদল যাই হোক, তার দুধ দেওয়া কামাই নাই। মানুষটার কোনোদিন অসুখও করে না। আমাদের এলাকাটা বিলাঞ্চল, বছরের ৬ মাসই নৌকায় চলাচল। বর্ষাকালে দাদু তরী বেয়ে আসে। ভাঙ্গা তরীখানার তলা ফুটো। সারাক্ষণ পানি উঠতে থাকে। খানিক দূর বৈঠা বায়, আবার পানি সেচে। চারটা গাই গরু আছে তার। পালা করে অন্তত দুইটা গাই সবসময়ই দুধ দেয়। কাকডাকা ভোরে গাইগুলো প্রথমবার দোয়ায় সে। সেই দুধ পিতলের ঘটিতে ভরে দাদীর বাড়ির দিকে রওনা হয়। তার ছেলে পরেশ বেলা উঠলে গাইগুলাকে নিয়ে ঘাস খাওয়াতে বেরিয়ে পড়ে। গজাইরার বিলে গরুর খাবারের কোনো অভাব নাই। দুর্বা ঘাস, কলমী শাক, কচুরী পানা, অফুরন্ত ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। বেলা একটু হেললে পরেশ গাইগুলোকে আরো একবার দোয়ায়। বিকালে সেই দুধ সে হাটে নিয়ে বিক্রি করে।

সকালের দুধ বেচার কাজটা সতীশ দাদুর, আর বিকালেরটা পরেশের। গাই গরু ছাড়াও ওদের পালে গোটা পনেরো মুরগী আর দশটার মতো হাঁস আছে। ওই সব হাঁস মুরগী দিনে গড়ে ৮/১০ করে ডিম দেয়। এই ডিম আর দুধ বেচেই সতীশ দাদুর সংসার চলে। না, শুধু চলে বললে কম বলা হয়, বেশ ভালোই চলে। অবশ্য ওদের চাহিদা কম বলেই ওরা চালিয়ে নিতে পারে। নেংটি পরেই সতীশ দাদু জীবনটা কাটিয়ে দিল। টাকা খরচের ভয়ে শরীর ঢাকতে কোনোদিন একখোট কাপড় কিনলো না। তবে কাপড় না কিনলেও ডাঙায় পৌনে এক কাঠা ধানি জমি কিনেছে সে। তা নিয়ে তো পাঁচ গাঁয়ে একেবারে ধন্যি ধন্যি পড়ে গেছে। দুধ বেচে জমি কেনা! চাট্টিখানি কথা তো নয়!

যুদ্ধের বছরের কথা বলছি। সতীশ দাদুদের গ্রামটি খুবই ছোট। মাত্র চারখানা বাড়ি। গাঁয়ের ৫০/৬০ টি পরিবারের সবাই হিন্দু। মিলিটারির ভয়ে গ্রাম খালি, খাঁ খাঁ করছে। শরণার্থী হয়ে গ্রামবাসীরা এখন ভারতে। শুধু সতীশ দাদুর পরিবারই দেশে পড়ে আছে। জীবনের ভয় যে তাদের কিছু কম, তা না। কিন্তু হাঁস, মুরগী আর গাইগুলা নিয়ে তো ইন্ডিয়া যাওয়া যাবে না। শরণার্থী হয়ে ওপার গেলে হয়তো জীবন বেঁচে যাবে। কিন্তু আবার তো দেশে ফিরতে হবে! এত কষ্টের গবাদি পশুগুলো খোয়া গেলে তখন তো না খেয়ে মরবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যদি মরণ হয় তো হোক, তবুও গাইগরু ছেড়ে ওরা কোথাও যাবে না।

বাড়ির কাজের লোকদের কাছে দুধের ভান্ড খালি করে সতীশ দাদু ফিরে যায়। দাদীর সাথে তার দেখা হয় না। ঘুম ভাঙলেও বেলা ওঠার আগে তিনি কাউকে দেখা দেন না। কোন দিন কতটুকু দুধ দিল, সে হিসাব সতীশ দাদুই রাখে। দুই সের, তিন সের বা আড়াই সের কোনো ঠিকঠাক নেই। তার গাইগুলো যে দিন যতটা দুধ দেবে, সে দিন ততটা সে আমাদের দুধের ডেক্সিতে ঢেলে দিয়ে যাবে। এটাই তার সাথে কথা। প্রতি জুম্মার দিনে দাদী তার দাম চুকায়। সতীশ দাদু শুক্রবারদিন দাদীর ঘরের বারান্দার খামে হেলান দিয়ে বসে। অপেক্ষায় থাকে দাদী কখন ঘরের দরজা খুলবে। মেজকাকী মাটির মালশায় হুড়–ম আর পাটালি গুড় খেতে দেয় দাদুকে। মুসলমান বাড়ির থালাবাটি সে ছোঁবে না। খাওয়ার পরে মালশাটা সাথে করে নিয়ে যায়।

ও ছতীস, এ হপ্তায় কয় স্যার দুধ দিলা? ঘরের দরজা খুলে বেরুতে বেরুতে দাদী জিজ্ঞাসা করলেন (তিনি সতীশ উচ্চারণ করতে পারেন না)।
ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালো সতীশ। দাদীর পায়ের সামনে হাটু গেড়ে বসে মাটিতে মাথা ঠেকায়ে প্রণাম করলো। তারপর বলল, ১৭ স্যারের অল্প এট্টু কম হইছে দাদীআম্মা।
আইচ্চা ঠিক আছে। ওই জুলেখা গোলা ঘরের তালা খুইলা ছতীশরে ১৫ স্যার ধান দিয়া দে, বলতে বলতে দাদী জলচকির ওপরে বসলেন।

সতীশ দাদু অন্যদিন জুলেখা বুজির পিছ পিছ রওনা দেয়। আজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে। দাদী বললেন, ছতীশ আর কিছু কবা নাকি?
আম্মা আমি এট্টু জমি কিনছি শোনছেন তো, মাটিতে চোখ রেখে সতীশ বালা কথা বলছে।
লোক মুখে শুনছি। তয় তুমি তো আর কও নাই, হুক্কার নল হাতে নিতে নিতে দাদী বললেন।
এট্টুফোটা জমির কথা আপনেরে কব কোন সাহসে আম্মা? আপনি হলেন জমিদার, ডাঙায় আপনার শ শ বিঘা জমি।

আমি জমিদার না ছতীশ, আর তোমার ওই জমিও “এট্টুফোটা” না। ও তুমি কষ্ট কইরা খাইয়া না খাইয়া কেনছো। খবরডা শুইনা আমি ভারি খুশি হইছি। তোমার জন্যি দোয়া করছি। তা সে জমি নিয়া কিছু হইছে নাকি, দাদী জিজ্ঞাসা করলেন।
আম্মা, জমিতে আউস ধান বুনবার চাই। তয় বেছন কিনার ট্যাকা নাই, বলল সতীশ।
ওই জুলেখা, হাঁক ছাড়লেন দাদী।

জুলেখা বুজি দৌঁড়ে এসে সামনে দাঁড়ালো। দাদী বললেন, এক কাম কর তো, ছতীশ রে আরো পাঁচ স্যার ধান দে। গোলা ঘরের মাচায় এক্কেবারে দক্ষিণ পাশের যে ডোল, ওর মদ্দি আউসের বেছন রাখা আছে। সেইখান থেইক্যা পাঁচ স্যার ওরে আলাদা কইরা মাইপা দে।
সতীশ দাদুর মুখে স্বর্গীয় হাসি। দাদীকে করজোড়ে প্রণাম করে সে জুলেখা বুজির পিঁছু পিঁছু হাঁটা ধরলো। দাদী পেছন থেকে ডাক পাড়লেন, ও ছতীশ খাড়াও কতাতো শ্যাষ অয় নাই।
ক’ন আম্মা। থতমতো খেয়ে দাড়িয়ে গেল দাদু।
এই মাঘ মাসের শীতির মদ্দি তুমি বেলা উঠার আগে দুধ নিয়া আস ক্যা? বেলা বাড়লি আসবা, তাতে অসুবিদা নাই।

আম্মা, অসুবিদা আছে। গেরামের গুড়োগাড়ারা পিছনে লাগে। হাবাজাবা কতা কইয়া খ্যাপায় আমারে। সেই জন্যি বেলা উঠার আগে আসি।
সে কী কতা? তুমারে খ্যাপাবি ক্যা? তুমি তো কাউর সাতে পাঁচে নাই! আর এদ্দিন তা আমারে কও নাই ক্যা, দাদী আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন।
গুড়াগাড়ারা শরমের কতাও কয় দাদীআম্মা। তা আপনেরে কওন যায় না। গেরাম থেইক্যা আদব কায়দা উইঠা গ্যাছে, লজ্জা মাখামুখে বলল সতীশ দাদু।
কোন বাড়ির ছাওয়ালপাওয়ালরা তুমার পাছে লাগে? আর ওরা কী কয়? তুমি কও তো আমারে, দাদী যেন গর্জে উঠলেন।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সতীশ দাদু বলে উঠলো, আম্মা আমি নাকি দুধে জল মিসাই! ওরা পিঁছে পিঁছে হাঁটে আর দল বাইন্দা গান গায় “সতীশ বালার দুধে জল”!
আরে, এর মদ্দি শরমের কী? ওরা কী তোমার দুধ খাইয়া দ্যাখছে নাকি? এই গাঁয়ে তুমি দুধ দেও আমারে। আমার নাতি পোতারা তোমারে কী কোনোদিন কিছু কইছে নাকি? আর এতে তুমি শরম পাও ক্যা?
দাদীর প্রশ্নবানে সতীশ বালার নাস্তানুবুদ অবস্থা। তাকে উদ্ধার করতে জুলেখা বুজি আগায়ে আসলো। তার দিকে চেয়ে বললো, ও খুড়ো তুমি গোলা ঘরের দিকে আউগাও। আমি আইসতেছি।

দাদীর কানের কাছে ঝুঁকে চাপা গলায় জুলেখা বুজি বললো, শরমের কতাও আছে আম্মা। সতীশ খুড়োর কাপড় চোপড় দ্যাহেন না ক্যামন? এক খোট নেংটি ফরে! দিন দিন সেই নেংটিও যেন ছোড হইতেছে। গেরামের পুলাপাইনরা তারে নিয়া গান বানছে। খুড়োরে পথে দেখলেই ওরা দল বাইন্দা সেই গান গায়,
সতীশ বালার দুধে জল
নেংটির ফাঁকে জঙ্গল !
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)