মণিজিঞ্জির সান্যাল : সময় পাল্টেছে, মানুষের কাজের ধারাও পাল্টে গেছে। প্রত্যেকেই তাদের মতো করে ব্যস্ত। এই ইঁদুর দৌঁড় প্রতিযোগিতায় মানুষের ভাবনার জায়গারও রং বদল হয়েছে। মানুষ এখন চূড়ান্ত পেশাদার, তারই পাশাপাশি শহরের চারপাশে চূড়ান্ত মন খারাপ করা ঘটনা। সঙ্গে রোজকার জীবনের চাপ।

এই ভার্চুয়াল জগতেও তার ছাপ প্রতিমুহূর্তে আমরা অনুভব করি। মাঝে মাঝেই আমরা প্রত্যক্ষ করি হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি নেই। ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিও কালো। কেউ আবার দু একটা শব্দের মধ্যে লিখে দেন “আমি ডিপ্রেশনে আছি।”

সম্পর্কে এত তাড়াতাড়ি বিচ্ছেদ, অফিসে কাজের চাপ, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই, সন্তানের সমস্যা তো আছেই, তার থেকেও ভয়ানক সাফল্যের চূড়োয় পৌঁছেও সবসময়ই আরো আরো উঁচুতে পৌঁছানোর বাসনা শুধু নয়, কিছুই করতে পারিনি সবসময়ই এই চিন্তা। পাশাপাশি চারপাশে ঘটে যাওয়া চূড়ান্ত মনখারাপ করে দেওয়া কতোরকম ঘটনা। যার থেকেই সৃষ্টি হয় হতাশা ও ডিপ্রেশন।

আসলে প্রতি মুহূর্তে যদি “কী চেয়েছি আর কী যে পেলাম” এই ভাবনার মধ্যেই জীবন কাটতে থাকে, তাহলে অবসাদ বা ডিপ্রেশনের আর দোষ কি?
আগে কজন আর সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আসত? মানুষ মনেই করত না, শরীরের মতো মনেরও চিকিৎসা দরকার হতে পারে। আগে মানুষ মন খারাপকে গুরুত্বও দিত না।

কিন্তু আজকাল সফটওয়ের ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর মানুষও আজকাল মনোবিদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। বেশিরভাগই পেশার দৌড়ে হতাশার চোরাবালিতে তলিয়ে নেশার আবর্তে ঢুকে পড়েছেন। সেই চক্রব্যূহ থেকে বেরোতেই এই পদক্ষেপ।
এখন তো সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়েরাও মনোবিদ ও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে বেশি আসছেন। এই স্মার্ট ফোনের দৌরাত্মে প্রতিটি পরিবার আজ কাহিল বাচ্চাদের নিয়ে। ভিডিও গেমে আসক্ত আজ বেশিরভাগ পরিবারের ছেলে মেয়েরা। তার থেকে বেরনোর কোনো পথ তারা খুঁজে না পেয়ে মনোবিদের সাহায্য নিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।

গানবাজনা, অভিনয়, মডেলিংয়ের জগতের সেলিব্রিটিরাও মনের ডাক্তারের দরজায় নিয়মিত ভিড় জমাচ্ছেন। এখন কাউন্সেলিং শব্দটা তাই খুব পরিচিত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্রই কাউন্সেলিং সেন্টার খোলা হচ্ছে। ক্যাম্প হচ্ছে। শিক্ষকরা ছাত্রকে গাইড করছেন। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে চেম্বারে পাঠাচ্ছেন। বড় বড় স্কুল কাউন্সেলিং সেশন রাখছে।
আসলে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এখন বিপ্লব এসেছে। তার জেরেই নতুন ধরনের কিছু মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। বাচ্চাদের মধ্যে মোবাইল অ্যাডিকশন সাংঘাতিক বেড়ে গিয়েছে। বয়ঃসন্ধির সময় এই শিশুরাই আসক্ত হচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপে। সারাক্ষণ ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে থাকার ফলে সামাজিক সম্পর্কগুলি সেভাবে দানা বাঁধছে না। একাকিত্ব দূর করতেও অনেকে ফেসবুকে আসক্ত হচ্ছে।

এখন যৌনতা নিয়েও অনেক বেশি খোলাখুলি কথা হচ্ছে। সমকামিতা নিয়ে কথা বলতে সেভাবে আর কেউ সঙ্কোচ বোধ করছেন না। ‘ম্যারিটাল ডিসহারমনি’ বা দাম্পত্য কলহ আগের থেকে এখন অনেকটাই বেড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এর পিছনেও ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড অনেকটা দায়ী। একাকিত্ব কমাতে স্বামী বা স্ত্রী সমব্যথী খুঁজছেন, দিনের পর দিন মেসেঞ্জারে ভাব বিনিময়, তারপর নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, ফলে সংসারে অশান্তি এবং সম্পর্ক ভেঙে যেতে বেশি সময়ই লাগছে না।
অন্যদিকে বয়স্করা প্রযুক্তিকে ভয় পেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন। তাদের একাকীত্ব বেড়েই চলেছে।

বয়স্করা স্মৃতিভ্রংশ বা ডিমেনশিয়া নিয়ে মনোবিদের কাছে আসছেন।
অনেকেই হতাশার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে খানিকটা গুটিয়ে থাকেন। বরং হতাশার জন্য তৈরি হওয়া উপসর্গকে শারীরিক অসুস্থতা মনে করেন।
অনেকে বুঝতেই পারেন না তার আসল সমস্যাটা কোথায়। হতাশার কারণে কেউ অনিদ্রার শিকার হতে পারেন। কারো হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। মাথা যন্ত্রণা করতে পারে। বমি বমি ভাবও আসে অনেকের। এখন যদি কেউ শুধু হজমের ওষুধ বা বমির ওষুধ খায় তবে সাময?িক স্বস্তি মিললেও হতাশা কাটবে না। উপসর্গগুলির উৎসের সন্ধানে নামতে হবে। আর সেটা একজন সাইকিয়াট্রিস্টই করতে পারেন।

কখনো কখনো আবার ভাল বন্ধুর সাহচর্য একজন হতাশাগ্রস্ত মানুষকে অনেকটাই সজীব করে তুলতে পারে। কারণ মনের দুঃখটা ভাগ করে নিলে মনে হবে এই দুঃখের পৃথিবীতে আপনি একা নন, দেখবেন মনে অনেক জোর পাচ্ছেন।
প্রতিদিন নিয়ম করে ধ্যান করুন। দেখবেন ধ্যানে মন অনেক শান্ত হয়।
ইচ্ছে হলে মন খুলে কাঁদুন। কাঁদলে মন অনেকটাই হালকা হয়ে যায়। পুরো জীবনটা শুধু সুখেই কেটে যাবে, এই ভাবনাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। ছোটখাটো দুঃখ-কষ্ট জীবনে আসবেই, হতাশাও আসবে। এরই নাম জীবন। কে ভালোবাসে বা বাসে না এসব নিয়ে ভাবা একদম বন্ধ করে দিন।

আমাকে কেউ ভালবাসে না, কেউ আমায় বোঝে না, এই চিন্তাটা মারাত্মক। আপনিই আপনার সব থেকে ভাল বন্ধু। মানুষ নিজেকেই সব থেকে বেশি ভালোবাসে। তাই কে ভালোবাসল, কে বাসল না, ডোন্ট কেয়ার।

একজনের ভালোবাসার ওপরে নিশ্চয়ই আপনার জীবন নির্ভর করছে না। জীবন আপনার আর তাকে যতœ করার দায়িত্বও আপনার। কেন অন্যের মুখাপেক্ষি হয়ে আপনার এই জীবনটাকে নষ্ট করবেন বলুন তো? যেটুকু আছে তাকেই যতেœ ভরে তুলুন। হৈ হৈ করে ভরে তুলুন আপনার প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত। আপনাকে দেখে যেন আপনার পাশের মানুষেরাও বলে উঠতে পারে “আহা জীবন কতো সুন্দর ! আমরাও এভাবে বাঁচতে চাই …।”
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ