হাসান গোর্কি : উপর্যুক্ত শিরোনামে গত চার পর্বের লেখায় আমরা ইসরায়েলের বিস্ময়কর সামরিক, গোয়েন্দা ও কৌশলগত সক্ষমতার বেশ কিছুটা পরিচয় পেয়েছি। শিক্ষা-বিজ্ঞান-দর্শন, প্রযুক্তিসহ জ্ঞানের অন্য সকল শাখায় তাদের উৎকর্ষও বিস্মিত হবার মতো। তাদের অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার পেছনে নিরলস জ্ঞানচর্চা এবং তার প্রয়োগ বড় ভ‚মিকা রেখেছে। ইহুদি জনসংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার ০.২%। ১৯০১ সালে প্রবর্তিত হবার পর এ পর্যন্ত ২৮৮ জন ইহুদি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। পৃথিবীতে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৩১%। তাদের মধ্যে থেকে নোবেল জিতেছেন ৫৮৯ জন। মুসলিম জনসংখ্যা ২৫%। মুসলিম নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর সংখ্যা ১৩। হিন্দু জনসংখ্যা ১৬%। তাদের নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা ৯। ইহুদিদের তুলনায় খ্রিস্টান জনসংখ্যা ১৫৫ গুণ বেশি। কিন্তু তাদের নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা ইহুদিদের মাত্র ২ গুণ। মুসলিম ও হিন্দুদের সন্মিলিত জনসংখ্যা (৪১%) ইহুদিদের তুলনায় ২০৫ গুণ। কিন্তু তাদের নোবেল বিজয়ীর সন্মিলিত সংখ্যা ইহুদিদের সংখ্যার ১৩ ভাগের ১ ভাগ। পৃথিবী বদলে দেওয়া তত্ত¡ কমিউনিজমের স্বপ্নদ্রষ্টা কার্ল মার্কস; সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক স্পিনোজা, বিশ্ব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনস, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত দার্শনিক নোয়াম চমস্কি, লেখক আর্থার মিলার, ফ্রানজ কাফকা, জন স্টেইনব্যাক, আইজাক আসিমভ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া গ্রæপের মালিক রুপার্ট মারডক, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া গ্রæপের মালিক ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গÑ এঁরা এসেছেন ইহুদি স¤প্রদায় থেকে। এই তালিকাটা একটা নমুনা মাত্র। শুধু নোবেল বিজয়ীদের নাম লিখলে তা এই নিবন্ধের চেয়ে বড় হবে। মেধাবী ইহুদিদের তালিকাটা আসলে অনেক বড়। তাই বর্তমান পৃথিবীর বিজ্ঞান, বাণিজ্য, রাজনীতি ও চলমান পুঁজি ও প্রতিপত্তির একটা বড় অংশ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন ইহুদিরা।

ভিক্তর মাৎসুলেনকো তাঁর The History of Second World War বইয়ের ভ‚মিকায় লিখেছেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধান ছিল।” ভার্সাই চুক্তি জার্মানিকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। হিটলার ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারানো জার্মানির হৃত অর্থনৈতিক, সামরিক শক্তি ও ভ‚মিকেন্দ্রিক সম্পদ পুনরুদ্ধার করা এবং পুনরায় একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। জাপান ও জার্মানি সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠে যা একসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি ভ‚খণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো এখনো এটাকে ভার্সাই চুক্তির মতো তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মনে করে, যদিও বাস্তব প্রতিক‚লতাকে মেনে নিয়ে ইসরায়েলের অস্তিত্ত¡ স্বীকার করে নিতে হচ্ছে তাদের। ইসরায়েলকে প্রথম স্বীকৃতিদানকারী মুসলিম দেশ তুরস্ক। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৪৯ সালে রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দেয় তুরস্ক। পরে বিভিন্ন সময় ইসরায়েলের সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, মরক্কো, ওমান ও বাহরাইন। সৌদি আরবসহ ১০টি মুসলিম দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ক‚টনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে।

স¤প্রতি আরব শান্তি উদ্যোগ পরিকল্পনায় ইসরায়েলকে ১৯৬৭ সালের সীমান্তে ফিরে যাওয়ার এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। আরব নিউজের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘে সৌদি রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আল-মুয়াল্লিমি দাবি করেছেন, “পুরো মুসলিম বিশ্ব ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে এবং তেল আবিবের সাথে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে প্রস্তুত যদি তারা ১৯৬৭ সালের ১ জুন দখল করা অঞ্চল থেকে সরে যেতে রাজি হয়।” ইসরায়েল এই দাবি মেনে নিলে তারা কিছু ভ‚খণ্ড হারাবে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তাদের লাভের পাল্লাই ভারি হবে। বিশাল সংখ্যক শত্রæ দেশ দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকার চেয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করলে তারাই বেশি লাভবান হবে। এরকম সম্ভাবনা একেবারে কম নয়। এর আগে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল দখলকৃত সিনাই উপদ্বীপ মিশরকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যদিও চুক্তিটি পরে বাস্তবায়িত হয়নি। ইসরায়েল ও পিএলও-র মধ্যে ১৯৯৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘অসলো চুক্তি ১’ এবং তার ধারাবাহিকতায় মিশরের তাবায় ১৯৯৫ সালে ‘অসলো চুক্তি ২’ স্বাক্ষরিত হয়।

নরওয়ের মধ্যস্থতায় পক্ষ দুটি এই জোড়া চুক্তিতে উপনীত হয় বলে এদের নাম ‘অসলো চুক্তি’। চুক্তিতে স্থির হয়, পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকা থেকে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী পর্যায়ক্রমে সরে যাবে। পাঁচ বছরের জন্য ‘অন্তর্বর্তী স্বশাসিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ’ গঠিত হবে। এরপর জাতিসংঘের ২৪২ ও ৩৩৮ প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্থায়ী সমাধান হবে। সুস্পষ্টভাবে লিখিত না হলেও এই চুক্তিতে ইসরায়েল পরোক্ষভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের স্বীকৃতি দেয়। যার ফলে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে পিএলও ইসরায়েল রাষ্ট্র মেনে নেয়। ইসরায়েলিরা মেনে নেয় যে, ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ প্রতিনিধি। এ চুক্তির ফলে ইসরায়েলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন পেলেও প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনকে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাসঘাতকরূপে চিহ্নিত করেন। অসলো শান্তি চুক্তির সাফল্য উদযাপনের জন্য তেল আবিবের কিংস অব ইসরায়েল স্কয়ারে আয়োজিত গণ শোভাযাত্রায় আমির নামে এক ইহুদি চরমপন্থির গুলিতে রবিন নিহত হন। প্যালেস্টাইনি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও এই চুক্তির বিরোধিতা করে, ইয়াসির আরাফাত কোণঠাসা হয়ে পড়েন এবং হামাসের মতো চরমপন্থী দলগুলোর উদ্ভব ঘটে। সর্বশেষ দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পর এই চুক্তি বাস্তবায়নের আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৪৮ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইসরায়েলি ও প্যালেস্টাইনিদের অধিকারে থাকা অঞ্চল (সাদা- ইসরাইল। সবুজ/কালো- প্যালেস্টাইন)

বর্তমানে ইসরায়েলি ও প্যালেস্টাইনিরা বাস করছে ডান দিক থেকে প্রথম ম্যাপের যথাক্রমে সাদা ও সবুজ অংশে। ১৯৬৭-র আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব ইসরায়েল মেনে নিলে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আকার হবে বাঁ থেকে তৃতীয় ম্যাপে যথক্রমে সাদা ও সবুজ অংশ। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য এ’রকম একটা ব্যবস্থা কি ইসরায়েল মেনে নেবে? তার সম্ভাবনা কম। ১৯৪৮-এ রাষ্ট্র পত্তনের পর থেকে ৩টি বড় এবং আরও ৪/৫টি ছোট যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে তারা এখন যে অবস্থায় পৌঁছেছে তাতে তারা দখলকৃত ভ‚খণ্ড ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। যে কোনো সমঝোতা তাদের অস্তিত্তে¡র ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। আজকের শান্তিপূর্ণ প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র ভবিষ্যতে তাদের জন্য বিষ ফোঁড়া হয়ে উঠতে পারে; যেমনভাবে ১৯৪৮-এ অস্তিত্তে¡র সংকটে ভোগা ক্ষুদ্র ইসরায়েল পুরা মধ্যপ্রাচ্যের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ইসরায়েলের জন্য হুমকি ছিল ইরাক ও সিরিয়া। তাদের পরমাণু কর্মসূচিকে ইসরায়েল নিজে আক্রমণ করে ধ্বংস করেছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা লিবিয়ার পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুপ্রাণিত করেছে সেদেশে নিয়োজিত ইহুদি লবি; এমনকি তারা সাদ্দাম হোসেন ও গাদ্দাফীর পতনের পেছনেও সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছে। কারো কারো মতে ইরাক ও লিবিয়ার ঘটনাবলীর পুরো পরিকল্পনাটি-ই সাজিয়েছিল ইহুদি লবি।

আগের পর্বে আমরা দেখেছি ইসরায়েলের জন্য এখন প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে উঠেছে ইরান। কারণ ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পৌঁছেছে বলে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। তবে ব্যাপারটা ইরানের বিরুদ্ধে প্রচারণাও হতে পারে। ইরান বরাবর দাবি করে এসেছে যে তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ এক রিপোর্টে বলেছে, ইরানের হাতে ৬০% পর্যন্ত সমৃদ্ধ ৪৩ কেজি ইউরেনিয়াম আছে। একটি পরমাণু বোমা বানাতে প্রায় ২৫ কেজি ইউরেনিয়াম দরকার হয় – যা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ হতে হবে। ৬ জাতির সাথে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বিষয়ে চুক্তিটি বাহ্যত একটা সৎ ও সরল উদ্যোগ। কিন্তু এর পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের বড় লক্ষ্য থাকতে পারে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইরান তার ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্টের গতি শ্লথ করেছে এবং এমন পর্যায়ে সীমিত রেখেছে, যা শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন। বিনিময়ে ইরানের ওপর ইতোপূর্বে আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে ছয় বিশ্বশক্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইরান শর্ত পালন করছে কি না, সেটা তদারক করছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি। গণমাধ্যমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে এ চুক্তির ইতিবাচক, নেতিবাচক অনেক বিষয়েই আমরা বিস্তারিত জেনেছি। কিন্তু এর অন্য ন্যারেশনও আছে, যেটা গণমাধ্যমে আসেনি বা এলেও খুব কম আলোচিত থেকে গেছে।

কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা, ছয় বিশ্বশক্তির আসল উদ্দেশ্য ছিলো ইরানের পরমাণু স্থাপনায় প্রবেশাধিকার অর্জন করা, যাতে বিশ্বশক্তিকে উপেক্ষা করে ইরান যদি পরমাণু বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়, তাহলে ইরানের পরমাণু স্থাপনার ওপর কীভাবে সফল হামলা চালানো যাবে, সেটা জানা। অন্য কথায়, বোমাটা ঠিক কোথায় ফেলতে হবে, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা। নির্ভুল মানচিত্র ছাড়া এ ধরনের স্থাপনায় হামলায় সফল হওয়া কঠিন। কারণ, ইরাক ও সিরিয়া হামলা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইরান তার পরমাণু স্থাপনা অনেকটাই দুর্ভেদ্য করে তৈরি করেছে- উচ্চশক্তির গতানুগতিক বোমা ফেলে যা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এর জন্য দরকার হবে সঠিক নিশানায় বেশ কিছু শক্তিশালী ক্লাস্টার বোমা ফেলা, যা ভ‚গর্ভস্থ স্থাপনাগুলোকেও ধ্বংস করবে। শুধু তা-ই নয়; মাটির অনেক নিচে তৈরি করা স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে স্থলপথে বড় সামরিক অভিযানের প্রয়োজন হবে। চুক্তির ফলে তারা সেখানে নিয়মিত পরিদর্শনের সুযোগ পাবে এবং চুল্লির অবস্থান, ইউরেনিয়ামের রক্ষণাগার, দপ্তর, ল্যাবরেটরিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিখুঁত মানচিত্র তৈরি করতে পারবে। এই মানচিত্র ব্যবহার করে নির্ভুল নিশানায় অব্যর্থ আঘাত হানা যাবে। রাশিয়া ছাড়া বাকি ৫ বিশ্বশক্তির এই গোপন ইচ্ছার বিষয়টা কি ইরান জানে না? হ্যাঁ। এটা ইরানও জানে। তাহলে প্রশ্ন দেখা দেয়, তারা বাঘকে ছাগলের খোঁয়ার চিনিয়ে দিচ্ছে কেন? আসলে এ ক্ষেত্রে ইরানেরও নিজস্ব কৌশল আছে। তারা জানে, পশ্চিমা বিশ্ব যেকোনো মূল্যে ইরানকে পরমাণু বোমা তৈরি থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করবে; এমনকি সেটা শক্তিপ্রয়োগ করে হলেও। চুক্তি না করলে পশ্চিমা বিশ্ব ইরাকের মতো হামলার অজুহাত পেয়ে যাবে। ইরান সেটা হতে দিতে চায়নি। বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নিয়ে ইরান বোমা তৈরির ইচ্ছাটাও আপাতত স্থগিত করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো অবরোধের ধকল কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে শক্ত করা এবং প্রচলিত অস্ত্রের ভান্ডারকে আরও শক্তিশালী করা। বিশ্ব রাজনীতিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটলে এবং সেটা তাদের অনুক‚লে গেলে তখন ভেবেচিন্তে তারা বোমা বানানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।

স¤প্রতি জেরেমি বার্নস্টেইন নামের মার্কিন এক পদার্থবিদ দ্য ইরান ডিল: মিথ অ্যান্ড রিয়্যালিটি নামে একটা বই লিখেছেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে ইরান পরমাণু শক্তির বিষয়ে যে কৌশলগত সক্ষমতা অর্জন করেছে, তা বোমা বানিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট। তাদের যা বাকি আছে তা হলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। গত কয়েক বছরে রাশিয়া ভ‚-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেশ দাপটের সঙ্গে সক্রিয় হয়েছে। সিরিয়া ইস্যুতে রাশিয়ার অনড় অবস্থান থেকে এটা অনুমান করা চলে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হওয়ার যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, সেটা আপাতত নাই। রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের বাণিজ্যিক ও সামরিক লেনদেন বেশ বড় আকারের; এমনকি সেটা পশ্চিমা অবরোধের সময়ও চালু ছিল। ইরানের আর্টিলারি ও এয়ারফোর্সের প্রায় পুরোটাই রাশিয়ান অস্ত্রে সজ্জিত। (ইরান এখন নিজেও অনেক অস্ত্র তৈরি করছে। বিশেষ করে তাদের তৈরি ড্রোন অনেক কার্যকর বলে প্রমানিত হয়েছে।) রাশিয়া ইরানের এয়ারফিল্ড ব্যবহার করে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরানের পার্লামেন্টের স্পিকার আলি লারিজানি ২০১৭ সালে রাশিয়ান টিভি ‘আরটি’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি দুই দেশের সম্পর্ক দৃঢ় করার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ প্রকাশ করার সময় রাশিয়ান এম্পায়ার ও পার্সিয়ান এম্পায়ারের মধ্যে ১৫২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্পর্কের কথা স্মরণ করেন। এটা যে শুধু গতানুগতিক সৌজন্য ছিল না, সেটা বোঝা যায় যখন পরের সপ্তাহে ইরানকে ‘কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন’-এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলো। রাশিয়া বাদে এই সংগঠনের অন্য সদস্যদের সবাই পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য: আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান। ইরান এই সংগঠনে যোগ দিলে তাদের ওপর মার্কিন বা ইসরায়েলি হামলার আশঙ্কা কমে আসবে। তখন তারা ছয় জাতির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার সাহস পাবে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যেকোনো পক্ষ এক বছরের নোটিশে এই চুক্তি অকার্যকর ঘোষণা করতে পারে।

ইরান পরমাণু বোমা বানাতে পারবে কি না সেটা অনেকটা নির্ভর করছে আগামী কয়েক বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান কোথায় পৌঁছায়, তার ওপর। পাকিস্তান পরমাণু বোমার মালিক হয়েছে চীন ও আমেরিকার যুগপৎ ছত্রচ্ছায়ায়। ইরান যদি পরমাণু বোমা বানাতে চায়, তাহলে তাকেও কোনো নির্ভরযোগ্য মিত্র খুঁজতে হবে। এবং সেটা হতে পারে কেবল চীন-রাশিয়াই। তবে এই দুই দেশের আনুক‚ল্য-ই ইরানকে তার লক্ষ্যপূরণের নিশ্চয়তা দেবে এ রকম সরল সমীকরণে যাওয়া যাবে না। কারণ, ইরানের হাতে পরমাণু বোমা থাকলে সেটা শুধু মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি হুমকিকে চ্যালেঞ্জ করবে তা-ই নয়, এ অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্যও বড় আকারের ধাক্কা খাবে। তেলসম্পদের ওপর নজরদারির সুযোগ কমে আসবে। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, জর্ডান, ওমানের মতো মিত্ররা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করবে। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের স্বার্থের বিপক্ষে যায় এমন কিছু আমেরিকা হতে দিতে চাইবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজে ইরানে আক্রমণ না করে ইসরায়েলকে ব্যবহার করা বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করবে। ইসরায়েলকে এখন আর কেউ আক্রমণ করতে যাবে না। কারণ তাদের হাতে পরমাণু বোমা আছে। বোমার সংখ্যা ৭৫ থেকে ৮০০-র মধ্যে বলে ধারণা করা হয়।

২০১৮ সালে ছয় জাতি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়াটা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সন্দেহজনক মনে করছেন। তাদের ধারণা ইরানের ওপর যে কোনো সময় হামলার ক্ষেত্র উন্মুক্ত রাখতেই তাদের সরে যাওয়া। ইরাকের বিরুদ্ধে গণ বিধ্বংসী অস্ত্র উৎপাদন করা ও মজুত রাখার অভিযোগ তুলে সেদেশে হামলা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন ইসরায়েল ও তার মিত্ররা বলতে শুরু করেছে ইরান ছয় জাতির সাথে করা চুক্তি ভঙ্গ করে পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টা করছে। এটা হয়তো ইরাকের ওপর হামলার অনুকরণে আরও একটা বহুজাতিক হামলার ছক যা ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির সক্ষমতাকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দেবে। আগেই বলেছি ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো এতটা দুর্ভেদ্য করে তৈরি করা হয়েছে যে বিমান হামলার মাধ্যমে এগুলোর বড় ক্ষতি করা যাবে না। স্থাপনাগুলো মাটির অনেক গভীরে এবং এর কয়েকটি পাহাড়ের নিচে তৈরি করা হয়েছে। এগুলো ধ্বংস করতে হলে একই সাথে বিমান ও স্থল হামলা করতে হবে। কাজটি দুঃসাধ্য। গত ৪ পর্বের লেখা যারা পড়েছেন তাদের মনে আছে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রটি এখনও অপ্রতিরোধ্য; তাদের কাছে দুঃসাধ্য বলে কিছু নাই। (সমাপ্ত)

hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা