হাসান গোর্কি : কোনো এক বিকেলের মনোরম রোদে লনে চেয়ার পেতে আপনি চা পান করলেন, দেশে ফোন করে মা-র সাথে কথা বললেন, সবজি বাগানের চর্চা করলেন এবং সন্ধ্যায় মুভি দেখতে গেলেন। এই কাজগুলো কি আপনি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় করেছেন? বেশিরভাগ ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী এগুলো ঈশ্বর কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত। সেই অতীন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ এতোটা সর্বব্যাপী ও অনুপুঙ্খ যে এর ক্ষুদ্রতম বিচ্যুতিরও সুযোগ নেই। আপনি যখন চা পান করছিলেন তখন আপনার টেবিলে একটা ওক গাছের পাতা ঝরে পড়েছিল, একটা পতঙ্গ উড়ে এসে চায়ের পেয়ালায় পড়ে মরে গিয়েছিল, চায়ে চিনি কম হয়েছিল, লেক অন্টারিও থেকে এক গুচ্ছ শীতল বাতাস এসে আপনার চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল, আপনি যে চেয়ারে বসে ছিলেন তার একটা পা মাটিতে কিছুটা বসে গেলে আপনি চেয়ারটি নতুন জায়গায় স্থাপন করেছিলেন। এই ঘটনাগুলো ঘটেছিল কোনো এক অতীন্দ্রিয় শক্তির ইচ্ছায়। তাঁর ইচ্ছা হলে এই বিকেলে আপনি লনে চা খেতে না বসে অন্য কিছু করতেনÑ ডাউনটাউনে ঘুরতে যেতেন, মাছ ধরতে যেতেন, শিক কাবাব বানাতেন বা ছেলেমেয়েদের নিয়ে পার্কে যেতেন। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা নেই। কিছু ব্যাখ্যায় বলা হয়, ঈশ্বর মানুষকে বুদ্ধি ও বিবেচনা দান করেছেন এবং তা স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা দিয়েছেন।

‘স্বাধীন ইচ্ছা’-র অর্থ যদি এই হয় যে ঈশ্বর মানুষকে এমন বাছাই করার সুযোগ দেন যা প্রকৃতপক্ষে তাদের ভাগ্যকে প্রভাবিত করে, তাহলে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আছে। আব্রাহিমিক ধর্মগুলোর বিশ্বাস অনুযায়ী হ্যাভেন থেকে পৃথিবীতে মানুষের অবনমন সরাসরি অ্যাডাম ও ইভের করা পছন্দের সাথে যুক্ত। ঈশ্বর মানবজাতিকে তাঁর নিজের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্টি করেছেন এবং এতে বেছে নেওয়ার ক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা এমনকি তা বাস্তবায়নের ক্ষমতাও তাদের ছিলো। ব্যাখ্যায় বলা হয়, স্বাধীন ইচ্ছার অর্থ এই নয় যে মানবজাতি যা খুশি তা করতে পারে। আমাদের পছন্দগুলি আমাদের প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে সীমাবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, একজন মানুষ একটি সেতুর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া বা এটি অতিক্রম না করার মধ্যে একটি বেছে নিতে পারে। কিন্তু সে যা বেছে নিতে পারে না তা হলো সেতুর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া। কারণ, প্রকৃতি তাকে উড়তে বাধা দেয়। এই ধারণাগুচ্ছ পরস্পরবিরোধী। এটা ঠিক হলে ঈশ্বরের ইচ্ছার সার্বভৌমত্বের ধারণা টিকে থাকে না। তাঁর অবহিতি-ই চূড়ান্ত। কারণ এর বাইরে কিছু ঘটতে পারে না। আপনি যা কিছু করবেন ঈশ্বর তা আগে থেকে জানেন। আপনি অন্য কিছু করলে তাঁর জানা ভুল হয়ে যাবে।

বিপরীতক্রমে বিজ্ঞান বলছে মানুষ ইচ্ছা পোষণ ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে স্বাধীন। জীব বিজ্ঞানীদের ধারণা, মানুষের মস্তিষ্ক একটা স্বাধীন ও পরিপূর্ণ চৈতন্যের আধার। পরিপার্শ্ব থেকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে তা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এখানে আলাদা কোনো আধিদৈবিক স্পিরিটের ভ‚মিকা নাই। ধরা যাক, (১) আপনি সমুদ্রের পাড়ে বসে আছেন। হঠাৎ দেখলেন, ১০০ মিটার একটা ঢেউ উপক‚লের দিকে ধেয়ে আসছে, (২) আপনি ১৫০ কিলোমিটার/ঘন্টা গতিতে হাইওয়েতে গাড়ি চালাচ্ছেন। আপনার গাড়ির পেছনের একটা চাকা ফেটে গেলো, (৩) আপনার ছেলে আপনার কাছে মঙ্গোলিয়ার রাজধানীর নাম জানতে চাচ্ছে। এই তিনটি ক্ষেত্রে আপনার কী করণীয় সে সম্পর্কিত তথ্য আপনার মস্তিষ্কে জমা আছে। সেই তথ্যগুলো সন্নিবেশ ও বাছাই করে মস্তিষ্ক যে সিদ্ধান্ত নেবে তার ভিত্তিতে-ই শরীরের অন্য অঙ্গগুলো কাজ করবে। এই ব্যাখ্যাটা সরল। এর বিস্তারিত সমর্থন আছে জৈব-রসায়ন ও জীব-পদার্থবিদ্যায়। আমরা জানি জীবদেহের অঙ্গগুলো টিস্যু দিয়ে তৈরি। টিস্যু তৈরি হয় কোষ দিয়ে। কোষ তৈরি হয় কিছু কোষীয় অঙ্গাণু দিয়ে যা আবার কিছু জটিল জৈব অণু দিয়ে গঠিত। এই অণুগুলো এবার পরমাণু দিয়ে গঠিত। এভাবে জীবদেহের গঠনের ব্যাখ্যা পেতে জৈব ও অজৈব অণুগুলোর ক্রিয়া- বিক্রিয়া-গঠন (যেমন, সালোকসংশ্লষণ, শ্বসন) জানতে হয়। জীবদেহ পদার্থ বিজ্ঞানেরও নিয়ম মেনে চলে। যেমন, প্রাণির শরীরে রক্তবাহী নালিকার মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচল করে যা পদার্থবিজ্ঞানের “Fluid Dynamics”-এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা জানি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শক্তির আদান প্রদান হয়। এই শক্তি-ই আবার পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্য বিষয়।

‘ইচ্ছা শক্তি’ নামে একটা প্রত্যয়ের সাথে আমরা পরিচিত। আমরা জানি, শক্তি ও পদার্থ পরস্পর রূপান্তরযোগ্য। বিজ্ঞানের ভাষায় ‘ইচ্ছা শক্তি’-র অর্থ পদার্থকে ক্ষমতায় রূপান্তর। মস্তিষ্কের শারীরস্থান বিষয়ক গবেষণা ক্ষেত্রকে ‘স্নায়ুশারীরস্থান বিজ্ঞান’ বলে। অন্যদিকে মস্তিষ্কের কার্যকলাপের গবেষণাকে স্নায়ুবিজ্ঞান বলে। মস্তিষ্ককে অধ্যয়ন করার জন্য বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের মস্তিষ্কের জৈব নমুনায় প্রাপ্ত কলা ও কোষগুলির আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন মস্তিষ্ক কীভাবে সংকেত উৎপাদন করে। বর্তমানে চিকিৎসাবৈজ্ঞানিক চিত্রণ প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে স্নায়ুচিত্র এবং বৈদ্যুতিক মস্তিষ্কলেখচিত্র ধারণ করে মস্তিষ্কের আরও নিবিড় অধ্যয়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমাদের যে কোনো ইচ্ছা তৈরি হবার জন্য কিছু ভৌত প্রণোদনা বা অণুঘটক কাজ করে। চাঁদের আলোয় গ্রামের মেঠো পথ ধরে হেঁটে বেড়ানোর ইচ্ছার পেছনে কোনো অতীন্দ্রিয় অণুঘটকের উপস্থিতির প্রয়োজন পড়ে না বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এর একটা পর্যায়ক্রম কল্পনা করা যাক- আপনি চাকরিতে প্রমোশন পেয়েছেন। এই তথ্য মস্তিষ্কে পৌঁছালে মস্তিষ্কে কিছু হরমোনের নিঃসরণ ঘটবে যা আপনার সুখের অনুভ‚তি তৈরি করবে। এই অনুভ‚তিও একটা রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ যা একই প্রকার আরও অনুভ‚তির সম্ভাবনার সন্ধান করবে, নিউরোনে রক্ষিত পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তথ্য নিয়ে মামা বাড়ি যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাবে এবং রাতের আহার সারার পর আপনাকে মামা বাড়ির পেছনের মাঠে চন্দ্রালোক প্লাবিত নির্জন মেঠোপথে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে।

‘স্বাধীন ইচ্ছা’ শব্দগুচ্ছটি গত দুই-তিন সহস্রাব্দের দর্শন শাস্ত্রে বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। যেমন ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ থাকা সম্ভব কিনা, সম্ভব না হলে অন্যথা করার সুযোগ আছে কিনা, আত্ম-নিয়ন্ত্রণের যে ক্ষমতা আমরা চর্চা করি তা আসলে অবগুণ্ঠিত কোনো শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কিনা, মানব মর্যাদা ও নৈতিক দায়িত্বের জন্য স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োজনীয়/অপরিহার্য কিনা- এসব নিয়ে বিস্তর মত পার্থক্য আছে। পশ্চিমা দর্শনের প্রতিটি যুগে এবং প্লেটো, অ্যারিস্টটল, অগাস্টিন, অ্যাকুইনাস, ডেসকার্টস বা কান্টের মতো জগদ্বিখ্যাত দার্শনিকরাও প্রাণি ও উদ্ভিদের স্বাধীন ইচ্ছা আছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। প্রকৃতি থেকে পাওয়া যে সংকেত আমাদের ইচ্ছা তৈরি করে তা যদি উদ্দেশ্যহীন হয় তাহলে কি আমরা স্বাধীন ইচ্ছার অনুগামী বলে নিজেদের দাবি করতে পারি? উত্তরটা উদ্ভিদের কাছে নেওয়া যাক: কোনো এক অরণ্যে একটা বটের ফল মাটিতে পড়ে গেলো, তা থেকে একটা শিশু বট গাছের জন্ম হলো, সূর্যের আলোতে পাখা মেলে সে বড় হলো এবং পত্র-পল্লব-শেকড়-লতা ছড়িয়ে তার সাম্রাজ্য গড়ে তুললো। এই ঘটনায় তার স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের সুযোগ ছিলো না। মাতা বট বৃক্ষ প্রজন্মান্তরে পরিবাহিত হবার যে ইচ্ছা বীজের মাধ্যমে প্রেরণ করেছে শিশু বৃক্ষ তার অনুগমন করেছে অনেকটা অন্ধভাবে। ইলিশ মাছ, পেঁচা, জলহস্তীরাও তা-ই করে। মানুষের ইচ্ছাও গড় পড়তা এ’রকম-ই। তবে বুদ্ধির উৎকর্ষের কারণে মানুষ কিছু ব্যতিক্রমী ইচ্ছা পোষণ করার এবং তার কিছু বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখে। তবে তাকে স্বাধীন বলা যাবে কিনা সে বিষয়ে সংশয় আছে।

প্রাচীন চীনা এবং ভারতীয় দার্শনিকতায় মানুষের ইচ্ছাকে স্বাধীন মনে করা হলেও তাকে প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়ে কিছু মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত মনে করা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছে, তা কার্যকারণ, প্রকৃতির নিয়ম, সময়, পদার্থ, অন্টোলজিকাল কারণ-ভিত্তিক ব্যাখ্যার সাথে সম্পর্কিত। তাই প্রাকৃতিক অনুপ্রেরণার প্রকৃতি মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সদগুণ-দোষ, প্রশংসা-শাস্তি, পুরষ্কার-নৈরাশ্য— এ’ধরণের বৈপরীত্যের ধারণা তৈরি করে। এসবের মধ্যে যেগুলো আমাদের ভালো ফল দেয় (rewarding) সেগুলো আমরা ইচ্ছার তালিকায় ঢুকিয়ে নিই। এই চিত্রটা অন্য প্রাণির ক্ষেত্রেও বুদ্ধির স্তর অনুযায়ী বিরাজ করে। ইচ্ছা পোষণ করার ক্ষেত্রে শিম্পাঞ্জির তুলনায় ভেড়া বা ডলফিনের তুলনায় ইলিশ কম স্বাধীন। আর এরা সবাই মানুষের তুলনায় কম স্বাধীন। কিন্তু যখন আমরা দেখি বুদ্ধি না থাকলেও ইচ্ছা বা ইচ্ছার প্রতিফলন আছে তখন ইচ্ছার উৎস ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ভাইরাস একটা বুদ্ধিহীন প্রাণি (যদি আমরা তাদের প্রাণি হিসেবে বিবেচনা করি)। তারা পোষকের শরীরে টিকে থাকতে ও বংশ বিস্তার করতে চেষ্টা করে। এতে তাদের ইচ্ছা আছে বলে মনে হয়। কিন্তু তা স্বাধীন নয়। এমনকি বাইরে থেকে আসা হলেও তাকে ইচ্ছা বলতে বাধা আছে। কারণ, আমাদের বিবেচনায় ইচ্ছা ধারণ করার জন্য একটা মস্তিষ্ক লাগবে যা ভাইরাসের নেই।

জ্যোতি-পদার্থবিদ্যা বলছে, মহাজগৎ একটা অখণ্ড তরঙ্গ ছাড়া কিছুই নয়। সেক্ষেত্রে এর কোনো স্বাধীন অংশ থাকার কথা নয়। ধরুন, আপনি বাংলাদেশের একটা গ্রামে বাস করেন। ঐ গ্রামে একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক, চোর, ডাকাত, যাদুকর, তাঁতি, জেলে, কিছু সংখ্যক ছাত্র, শ্রমিক, চাকরিজীবী, গৃহিনী আছে। বৃক্ষ, লতা, গুল্ম, পুকুর, ধানক্ষেত, বাঁশ বন, বাসগৃহ আছে। এখানে বাস করে আপনি আসলে কোনো ইচ্ছা-ই পোষণ ও বাস্তবায়ন করেন না যা এই উপাদানগুলো দিয়ে কোনো না কোনো ভাবে প্রভাবিত নয়। আপনি যদি গ্রাম ছেড়ে শহরে, ভিন দেশে এমনকি অন্য গ্রহেও চলে যান তাহলেও এগুলোর প্রভাব থেকে আপনি মুক্ত হয়ে যাবেন না। এই গ্রামের জল, বায়ু, শস্য কণা, সূর্যালোক, ধূলি, পল্লব, পুষ্প থেকে সংগৃহীত জৈব-অজৈব অণু শরীরে বহন করে নিয়ে যাবেন। উপরের দু’টি অনুচ্ছেদে আমরা দেখেছি ইচ্ছার আদি ভিত্তি ভৌত উপাদান। আপনি যদি সম্পূর্ণ নতুন অবয়ব নিতে পারেন তাহলে আপনার ইচ্ছা এই গ্রামের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবে। কিন্তু নতুন উপাদান আপনার যে ইচ্ছা তৈরি করবে তা-ও নতুন পরিবেশের অধীন হবে। এমনকি তা আপনার আদি গ্রামের সাথেও দূরবর্তী সম্পর্কে বাঁধা থাকবে।

অদ্বৈত বেদান্ত হলো বৈদিক দর্শনের সর্বেশ্বরবাদী ধর্মীয় অনুশীলন বা সাধনার পদ্ধতিগত ধারা যা মহাজগতের সামগ্রিকতাকে জীবন্ত সত্তা মনে করে। এই দর্শনে ব্রহ্ম হলো একমাত্র অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা— “সেখানে কোনো দ্বৈততা নেই, কোনো সীমিত, স্বতন্ত্র, স্ব বা পৃথক সীমাহীন মহাজাগতিক ‘আত্ম’ (self) নেই, বরং তা সমস্ত স্ব, সমস্ত অস্তিত্ব, সমস্ত স্থান ও সময় জুড়ে এক এবং অভিন্ন” (Brodd, Jeffrey, 2009, World Religions: A Voyage of Discovery, c„.-43)। অদ্বৈত বেদান্ত অনুসারে প্রতিটি সত্তার ভিতরের ব্রহ্মাÐ ও আত্মা হলো ব্রহ্ম, এবং প্রতিটি সত্তার বাইরের ব্রহ্মাÐ ও আত্মা হলো ব্রহ্ম। ব্রহ্ম হলো বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক সব কিছুর আদি ও শেষ এবং সমস্ত কিছুর মূল উৎস। মহাবিশ্ব ব্রহ্ম থেকে আসে না, বরং সে নিজে-ই ব্রহ্ম। অদ্বৈত বেদান্তের একজন প্রবক্তা আদি শঙ্করের মতে, “নির্গুণ ব্রহ্ম বা গুণবিহীন ব্রহ্ম চূড়ান্ত এবং একমাত্র বাস্তবতা। শ্রুতি যে ব্রহ্মের জ্ঞান প্রদান করে তা আত্ম অনুসন্ধান ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে পাওয়া যায় না। চেতনা ব্রহ্মের সম্পত্তি নয় বরং এর স্বভাব“ (Brodd, Jeffrey, 2009, World Religions: A Voyage of Discovery, c„.-232)। চেতনা যদি ব্রহ্মের স্বভাব হয়ে থাকে তাহলে আমরাও সেই স্বভাবের দাশ। ইচ্ছার উৎস হিসেবে যদি ব্রহ্মের অখÐ চেতনাকে মেনে নেওয়া হয় তাহলে আমাদের ইচ্ছাকে স্বাধীন বলা চলে না।

প্রকৃতিতে জড় বস্তুর স্বাধীন সত্তা থাকলে তা থেকে তৈরি হওয়া জৈব সত্তার স্বাধীন চেতনা (যার একটা উপাদান ইচ্ছা) থাকার সুযোগ ছিলো। আমরা জানি, চারটি ফোর্স ফিল্ড মহাজগতের যাবতীয় বিধি তৈরি করেছে যা থেকে কোনো পদার্থ কণা মুক্ত নয়। প্রাণি-উদ্ভিদও এই পদার্থ কণার সুশৃঙ্খল ও জটিল সমাহার বৈ কিছু নয়। আমাদের ইচ্ছাকে খোলা চোখে আমরা স্বাধীন ভাবতে পারি। বাস্তবে হয়তো তা নয়। আমরা ছোটবেলায় পিঁপড়ার সারির সাথে খেলাধুলা করতাম— পিঁপড়ারা যে পথে সারি বেঁধে চলাচল করতো সে পথে একটা গর্ত খুঁড়ে পানি ঢেলে দিতাম। যখন দেখতাম তারা ঘুর পথে গন্তব্যে যেতে চেষ্টা করছে তখন সেখানেও খড় কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতাম; মনে মনে ভাবতাম তারা এটাকে দাবানল ভাবছে। এরপর তারা এক সময় ক্ষান্ত দিয়ে ডেরায় ফিরে যেতো। পিঁপড়াদের কাছে এই সিদ্ধান্ত হয়তো পরিস্থিতির কারণে নেওয়া স্বাধীন সিদ্ধান্ত মনে হতো অথবা তারা মনে করতো কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তির ইচ্ছা তাদের গতিপথ (ও পরিবর্তিত ইচ্ছাকে) নিয়ন্ত্রণ করছে। মানুষের ব্যাপারটাও হয়তো সে’রকম। আমরাও যখন কিছু ইচ্ছা করি তখন তাকে স্বাধীন ভাবতে পারি অথবা কোনো আধিদৈবিক শক্তির ইচ্ছার অনুগমন বলে মনে করতে পারি। আসলে হয়তো এই দুইটির কোনটি-ই সত্য নয়।

ধরুন, আপনি একটা কবিতা বা ছোটগল্প লেখার ইচ্ছা করলেন। কয়েক দফা চেষ্টা করে সেটা শুরু করতে ব্যর্থ হলেন। এক সময় আকস্মিকভাবে তাড়না অনুভব করলেন এবং লিখতে বসে মনের মধ্যে অপ্রত্যাশিত ধারায় আবেগ/কাহিনীর অনুরণন পেতে থাকলেন। আপনার মনে হতে পারে এটা একটা আধ্যাত্মিক উপঢৌকন (spiritual endowment); এই চৈতন্য মহাকাশ পেড়িয়ে কোনো এক অজ্ঞাত মহাশক্তির নিকট থেকে এসেছে (আমার দুই বন্ধু লেখক/কবি স¤প্রতি তাঁদের এ’রকম অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁদের একজন আমার এই আর্টিকেলের বিষয়বস্তুও নির্ধারণ করে দিয়েছেন) অথবা আপনি মনে করতে পারেন এই উৎপাদন শতভাগ আপনার মস্তিষ্ক জাত। চৈতন্য (আমাদের আলোচনায় ‘ইচ্ছা’) আমাদের মস্তিষ্কের রাসায়নিক বিক্রিয়া, যা ঘটে জৈব অণুর অংশগ্রহণে। জৈব অণু যে পরমাণু দিয়ে গঠিত হয় তারা অজৈব। এভাবে পেছন দিকে যেতে থাকলে আমরা যে জড় জগতে প্রবেশ করি তা আমাদের বিবেচনায় চেতনাহীন। আমরা মাতৃগর্ভে আসার আগে শুক্রানু/ডিম্বাণুতে ছিলাম। তার আগে বিভিন্ন জৈব অণুতে ছিলাম। তার আগে বায়ু, জল, মৃত্তিকার অসীম অন্ধকারে চেতনাহীন মিশে ছিলাম। তারকা ধূলির (স্টার ডাস্ট) আকারে মহাকাশের বিশাল প্রান্তর জুড়ে ভেসে বেড়িয়েছি কয়েকশ’ কোটি বছর। ভ‚মিষ্ঠ হবার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের ইচ্ছাগুলো পরমার্থিক মহাকালের বিচারে স্বাধীন নয়; কারণ তারা সংখ্যাতীত অগ্র-পশ্চাৎ, ভৌত-অভৌত সম্পর্কের নিগড়ে বাঁধা।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা