হাসান গোর্কি : জন-অংশগ্রহণ, দর্শক সংখ্যা এবং আর্থিক লেনদেনের হিসেবে বিশ্বকাপ ফুটবলের সমকক্ষ কোন ভূমণ্ডলীয় যজ্ঞ নেই। এই লেখা প্রকাশিত হবার দিন নয় দশক বয়সী এই বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ১২টি খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই প্রতিযোগিতার আয়োজনে নতুন স্টেডিয়াম, মেট্রোরেল, বাস, পার্ক, হোটেল, মিডিয়া-সেন্টার নির্মাণ ও নিরাপত্তা খাতে আয়োজক কাতারকে ব্যয় করতে হচ্ছে ২২০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে রাশিয়া যে পরিমাণ খরচ করেছে, কাতার বিশ্বকাপের ব্যয় তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি। ১৯৯৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৭ বিশ্বকাপের একত্রিত খরচকেও ছাপিয়ে গেছে এই ব্যয়। ২০ নভেম্বর শুরু হতে যাওয়া ২২তম মহারনে কে চ্যাম্পিয়ন হবে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের ১৮ ডিসেম্বর লুসাইল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিতব্য ফাইনাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে ফুটবল নিয়ে যারা দিনাতিপাত করেন, বসে নেই সেই বিশ্লেষকরা। তাঁদের বেশিরভাগই মনে করছেন, বরাবরের মতো এবারও শিরোপা লড়াই সীমাবদ্ধ থাকবে ফুটবল পরাশক্তিগুলোর মধ্যে। চ্যাম্পিয়ন হতে পারে এমন ১০টি দলের একটা তালিকাও তারা ইতোমধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন। আসুন দেখা যাক আসন্ন বিশ্বকাপ নিয়ে সেই বিশেষজ্ঞরা কী ভাবছেন। কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও স্পোর্টস ম্যাগাজিনগুলোর প্রকাশ করা সম্ভাবনার গড় করলে তালিকাটা এরকম দাঁড়ায়: (১) ব্রাজিল (২) ফ্রান্স (৩) আর্জেন্টিনা (৪) ইংল্যান্ড (৫) স্পেন (৬) জার্মানি (৭) নেদারল্যান্ডস (৮) পর্তুগাল (৯) বেলজিয়াম (১০) ডেনমার্ক। এ মুহূর্তে ফিফা র‌্যাংকিং এ শীর্ষ ৫ দল হলো, ব্রাজিল, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা এবং ইংল্যান্ড।

সেমিফাইনালে খেলতে পারে যে ৪ দল:
বাছাই-১, ব্রাজিল: সর্বশেষ ফিফা র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঁচ বারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের বর্তমান অবস্থান প্রথম। দলটি রানার্স আপ হয়েছে ২ বার এবং তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান পেয়েছে যথাক্রমে ২ ও ১ বার। এবারের বিশ্বকাপে ফুটবল বোদ্ধাদের একটা বড় অংশ শীর্ষ বাছাই হিসেবে ব্রাজিলকেই মানছেন। তাদের ধারণা অনুযায়ী এ দলটি খুবই ভারসাম্যপূর্ণ এবং ধারাবাহিক। পাশাপাশি প্রথম পর্বে গ্রæপ এ তে সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং ক্যামেরুনের মোকাবিলা করে দ্বিতীয় পর্বে পৌঁছে যাওয়া তাদের জন্য হয়তো কঠিন হবে না। ২০১৮-র বিশ্বকাপে ব্রাজিলের গ্রুপে সার্বিয়া ও সুইজারল্যান্ড ছিলো। ২০১৪-র বিশ্বকাপে তাদের গ্রুপে ক্যামেরুন ছিলো। এবার কাকতালীয়ভাবে পুরনো প্রতিপক্ষদের নিজের গ্রুপে পেয়েছে ব্রাজিল।

বাছাই-২, ফ্রান্স: ফিফা র‌্যাংকিং এর তৃতীয় স্থানে আছে ফ্রান্স। দলটি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ২ বার। রানার্স আপ হয়েছে ১ বার এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছে ২ বার। ফুটবল বিশ্লেষকদের বিবেচনায় এবারের আসরের দ্বিতীয় বাছাই ফ্রান্স। তাদের গ্রæপে ডেনমার্ক শক্তিশালী দল। অন্য দুটি দল হলো, তিউনিসিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া। ফলে দ্বিতীয় পর্বে যাবার ক্ষেত্রে ফ্রান্স বড় বাধার মুখে পড়বে না। ১৯৯৮-র বিশ্বকাপে ৩-০ এবং ২০০৬-র বিশ্বকাপে ১-০ গোলে ব্রাজিলকে হারিয়েছিল ফ্রান্স। এদের কোনো একটা দল নিজেদের গ্রæপে রানার্স আপ হলে কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের মুখোমুখি হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে শীর্ষ দুই বাছাইয়ের একটা সেমিফাইনালের আগেই বাদ পড়ে যাবে।

বাছাই-৩, আর্জেন্টিনা: ফিফা র‌্যাংকিং এর চতুর্থ দল দুইবার বিশ্বকাপ বিজয়ী এবং ৩ বারের রানার্স আপ আর্জেন্টিনা বিশেষজ্ঞদের বাছাইয়ে আছে তৃতীয় স্থানে। গ্রুপ C- তে তাদের প্রতিপক্ষ সৌদি আরব, মেক্সিকো এবং পোল্যান্ড। আর্জেন্টিনার বর্তমান ফর্ম বিবেচনায় নিলে গ্রুপ পর্ব পেরোতে তাদের সমস্যা হবার কথা নয়।

বাছাই-৪, ইংল্যান্ড: ফিফা র‌্যাংকিং এ পঞ্চম দল ইংল্যান্ড বিশেষজ্ঞ বাছাইয়ে আছে চতুর্থ স্থানে। প্রথম তিনটি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড অংশ নেয়নি। তখন তারা ফিফার সসস্যপদও নেয়নি। ফুটবলের সুতিকাগার হিসেবে অভিহিত হলেও তারা বিশ্বকাপ জিতেছে মাত্র একবার (১৯৬৬)। এর বাইরে তাদের সর্বোচ্চ ভালো ফলাফল দুইবার (১৯৯০, ২০১৮) চতুর্থ স্থান লাভ। গ্রুপ B- তে ইংল্যান্ডের সাথে আছে ইরান, যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েলস। (১৯৯৮-র বিশ্বকাপেও ইরান, যুক্তরাষ্ট্র একই গ্রুপে ছিলো।) কোনো অঘটন না ঘটলে এই গ্রুপ থেকে ইংল্যান্ড দ্বিতীয় পর্বে চলে যাবে।

বর্তমান ফিফা র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী ষষ্ঠ, ৭ম, ৮ম, ৯ম এবং ১০ম স্থানে আছে যথাক্রমে ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ও ডেনমার্ক। ইতালি ৪ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, দুই বারের রানার্স আপ এবং বর্তমান ইউরো চ্যাম্পিয়ন। বাছাইপর্বের প্লে অফ ম্যাচে উত্তর মেসিডোনিয়ার কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাদ পড়ে যায় ইতালি। এর আগে তারা ব্রাজিল ও স্পেনের টানা ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার বিশ্বরেকর্ড ভেঙে একটানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত ছিলো। স্পেন একবার (২০১০) বিশ্বকাপ জিতেছে। নেদারল্যান্ডস তিনবার (১৯৭৪, ‘১৯৭৮, ২০১০) ফাইনাল খেলেও শিরোপা বঞ্চিত। পর্তুগালের সেরা সাফল্য একবার (১৯৬৬) তৃতীয় স্থান অর্জন। ডেনমার্কের সেরা সাফল্য একবার (১৯৯৮) কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছানো। স্পেন, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল ও ডেনমার্ক শক্তিশালী দল। কিন্তু তাদের চেয়ে শিরোপার বড় দাবিদার মনে করা হচ্ছে ফিফা র‌্যাংকিং-এ ১১তম স্থানে থাকা জার্মানিকে। দলটি ৪ বার বিশ্বকাপ জিতেছে। রানার্স আপ হয়েছে সর্বাধিক ৪ বার। তৃতীয় স্থানও লাভ করেছে সর্বাধিক ৪ বার। চতুর্থ স্থান পেয়েছে ১ বার। সব মিলিয়ে সেমিফাইনাল খেলেছে ১২ বার। সার্বিক পারফরমেন্সের বিবেচনায় বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল জার্মানি। বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় এবার ষষ্ঠ বাছাই হিসেবে স্থান পেয়েছে দলটি।

ফিফা র‌্যাঙ্কিং এবং শীর্ষ বাছাই দলগুলোর তালিকায় মিল নেই কেনো? ফুটবল বিশেষজ্ঞরা কেনো ১১ নম্বরে থাকা জার্মানিকে ষষ্ঠ বা ২ নম্বরে থাকা বেলজিয়ামকে ৯ম বাছাই মনে করছেন? এক্ষেত্রে তারা আসলে বিবেচনায় নিয়েছেন ফুটবল ঐতিহ্যকে। মেক্সিকো বিশ্বকাপে (১৯৮৬) প্রথম রাউন্ডে ডেনমার্ক উরুগুয়েকে ৬-১, জার্মানিকে ২-০ এবং স্কটল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলে চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। সে’সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক রোববার-এর এক ক্রীড়া সাংবাদিক বাংলাদেশ ফুটবল দলের তদানীন্তন জার্মান কোচ বেকেল হপ্টকে প্রশ্ন করেছিলেন, “এবারের বিশ্বকাপে ডেনমার্ক কী চ্যাম্পিয়ন হতে পারে?” বেকেল হপ্টের উত্তর ছিল, “বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য ফুটবল ঐতিহ্যের দরকার।” ঐ সাংবাদিকের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, “আপনি কি মনে করেন ডেনমার্ক যে কোন দলকে হারানোর যোগ্যতা রাখে ?” উত্তরে বেকেল হপ্ট বলেছিলেন, “আমি মনে করি ডেনমার্ক এ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী ২৪টি দলকেই হারানোর যোগ্যতা রাখে।” (তখন বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিল ২৪) সাংবাদিক সংশোধন করে দিয়ে বললেন, “২৪টি নয়, বাকি ২৩টি।” হপ্ট উত্তর দিয়েছিলেন, “না ২৪টি-ই। আগামী যে কোন ম্যাচে ডেনমার্ক নিজেকেও হারিয়ে দিতে পারে।” নক আউট পর্বের প্রথম ম্যাচে ডেনমার্ক স্পেনের কাছে হেরেছিল ১-৫ গোলে।

কাতার বিশ্বকাপে কানাডা দলের সম্ভাব্য প্রথম একাদশ

বড় টুর্নামেন্ট জেতার জন্য ঐতিহ্যের দরকার- এটা একটা সাধারণ সূত্র। সূত্রটা কি এবার ভেঙে পড়বে? আট জাতির সাফল্য গাঁথা হিসেবে টিকে না থেকে নতুন কোনো দেশ চ্যাম্পিয়ন হলে কি বৈশ্বিক এই উত্সবের জৌলুস আরো বেড়ে যাবে? আমাদের মনস্তত্ত¡ তা বলে না। ধরুন, দক্ষিণ কোরিয়া, ঘানা, ইকুয়েডর বা অয়েলস- এর মধ্যে কোনো একটা দল চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলো। সেক্ষেত্রে আমরা সেটাকে আপসেট ভাবতেই পছন্দ করবো এবং নিজেদের পছন্দের পরাশক্তিগুলোর ব্যর্থতায় হতাশ হবো। বাংলাদেশের কথাই ধরুন। সেখানে ৯০% দর্শক ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখার জন্য উদগ্রীব থাকে। তাদের সবাই হতাশ হবে এবং পরবর্তী বিশ্বকাপের জন্য অপেক্ষা শুরু করবে। আমার প্রথম পছন্দের দল (ইতালি) বিশ্বকাপে যেতে পারেনি। তাই টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই আমি অর্ধেক আগ্রহ হারিয়ে বসে আছি।

কানাডা এবার দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপে কানাডা গ্রুপ পর্বের সবক’টি ম্যাচে (সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও হাঙ্গেরির কাছে) পরাজিত হয়েছিল। F গ্রুপে কানাডার সাথে আছে গত বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া, বর্তমান ফিফা র্যাংকিং- এর ২ নম্বর দল বেলজিয়াম (গত বিশ্বকাপের সময় তারা র্যাংকিং -এ ১ নম্বরে ছিলো) ও মরক্কো। তাই দ্বিতীয় পর্বে যাওয়া কানাডার জন্য কঠিন হবে। তবে একটা অঘটনের আশায় বুক বাঁধতে দোষ নেই। স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়াও খেলাধুলার অংশ। উত্থান-পতনের উত্তেজনা আছে বলেই বিষয়টা এতো চিত্তাকর্ষক। এবার ব্যর্থ হলে ঘরের মাঠে আগামী বিশ্বকাপের জন্য অপেক্ষা শুরু হবে। ২০২৬-র বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করবে কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো। সহ-আয়োজক হিসেবে ২০২৬ বিশ্বকাপেও খেলবে কানাডা। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত মোট ২২টি বিশ্বকাপের ২টি করে আসর বসেছে ইতালি, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি ও মেক্সিকোতে। ২০২৬ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবার পর মেক্সিকো ৩ টি বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে এককভাবে এই তালিকার শীর্ষে উঠে যাবে।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা