ফায়জুল হক : বাংলাদেশের পলিটিক্যাল টার্মোয়েল (political turmoil) বেশ তুংগে যা আজ নিজ ভ‚খন্ড ছাড়ায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। দেশীয় রাজনীতির সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট কিছু প্রবাসী ছাড়াও লক্ষ লক্ষ সাধারণ প্রবাসীরা আজ বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

দেশের সম্মানের সাথে সরাসরি জড়িত রয়েছে প্রবাসীদের সম্মান-রুটি-রুজি আর ভবিষ্যত প্ল্যানিং। তাই দেশের স্বার্থে এবং আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই সকল প্রবাসীদেরকে আজ নতুন করে নিজেদের করণীয় (Action Plan) চিহ্নিত করতে হবে। দেশের বর্তমান অবস্থাটা একটু খুঁটিয়ে দেখলে হয়তো আমাদের করণীয় বেশ সহজ হয়ে যাবে। প্রিয় পাঠক চলুন দেখে আসি –

(এক) ডক্টর মাহাথির মোহাম্মদ একবার এক সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, রাষ্ট্র ও জনগণের উন্নয়নের সদিচ্ছা অন্তরে ধারণকারী কোন রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর ৩ টার্ম না থাকলে উন্নয়নের সফলতা পাওয়া যায় না। তিনি ১ম টার্মকে প্ল্যানিং (Planning) ২য় টার্মকে ইমপ্লিমেন্টেশন (Implementation) ও ৩য় টার্মকে আউটকাম (Outcome) বা Result হিসাবে গণনা করেছেন। অনুন্নত বিশ্বের জন্য তার ফর্মূলা হয়তোবা সত্য যদিও তা উন্নত বিশ্বের সাথে সাংঘর্ষিক। মিঃ মাহাথিরের এই ফর্মূলা যদি সত্যি হয়ে থাকে সেই হিসাবে আওয়ামী লীগ সফলভাবে (তর্ক এড়িয়ে গেলে) ৩ টার্ম দেশ পরিচালনা করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আউটকাম (Outcome) কি? সফলতার ও ব্যার্থতার সংজ্ঞা বিভিন্ন জনের কাছে ভিন্ন রকম। তবে সার্বিক দৃষ্টিতে গ্রাস Grass roots development / গ্রাস রুটস ডেভলাপমেন্টস হয়েছে অনেক। ওগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আবার দীর্ঘ দিন ধরে হয়ে আসছে বিভিন্ন এনজিও, পূর্ববর্তী সরকার ইত্যাদীর মাধ্যমে।

শিশু মৃত্যুর হার, গর্ভকালীন মায়েদের মৃত্যু হার, নারী শিক্ষা, নারীদের কর্মসংস্থান, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, Old Age benefits & Pension (proposed), National ID, কৃষি শিল্পে আধুনিকীকরন ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। Mass communication, Internet service, যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও উন্নয়ন, অবহেলিত মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন ও রিকগ্নিশন ইত্যাদী আরো অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আমাদের প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে অনেক সামনে চলে এসেছে। ভারতের সাথে তুলনার মূল কারণ হচ্ছে বৃটিশ’র কাছ থেকে বের হওয়ার পর থেকে বর্তমান ভারতে নিরবিচ্ছন্ন ডেভলাপমেন্ট হয়ে চলেছে। বিগত ৭৫ বছরে না এসেছে সামরিক শাসন না করেছে সৎ মা শাসন।

অথচ এই ৭৫ বছরের ২৬ বছরই পাকিস্তানীদের শোষন, নিপীড়ন আর গুলি খেয়ে খেয়ে বেঁচে ছিলাম আমরা। তারপর ’৭১-এর মহান যুদ্ধ-দেশটাকে জ্বালিয়ে খাক করে চলে গেল ওরা। তার মানে নিউক্লিয়ার শক্তি অর্জনকারী মহাশক্তিধর দুইদেশ (ভারত, পাকিস্তান) বিগত ৭৫ বছরে যা করতে পারে নাই আমরা তা ৫০ বছরে করে এগিয়ে গিয়েছি। (আমাদের এগিয়ে যাওয়া ও সাফল্যের স্ট্যাটিস্টিক্স দেখার জন্য প্রিয় লেখক নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের আর্টিকেল পড়ার অনুরোধ করছি।)

আগেই বলেছি Grass Roots & Sustainable developments গুলোর ক্রেডিট শুধু আওয়ামী লীগকে দেওয়া যাবে না। তবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান দারী এই দল বিগত ১৪ বছরে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়ে ডুবন্ত জাহাজকে তীরে ফেরানোর মতই দেশকে ২য় দফা যে নিশ্চিত ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে তা যে কোন শত্রুও স্বীকার করবে। ইতিহাস বিকৃতি আর দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল।

১৪ বছর আগে শিশুরা শেখ মুজিবকে দেশোদ্রুহী কাফের নামে চিনতো (নাউজুবিল্লাহ), এই শিশুরা খন্দকার মোস্তাক-ফারুক ডালিমকে জাতির ত্রাণকর্তা হিসাবে জানতো (আস্তাগফিরুল্লাহ)। এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। দেশটাকে জঙ্গি বাদের আস্থানা বানানো হয়েছিল-নৃতাত্তি¡ক জাতি গোষ্ঠী-হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ও উপজাতি এই দেশের নাগরিক হয়েও প্রতিটি ক্ষন ভীত সন্ত্রস্থ –মৃত্যুর ভয় নিয়ে রাত কাটিয়েছে।

শুধুই কি তাই, জাহাজ ভর্তি করে ট্রাকের পর ট্রাক অস্ত্র জঙ্গীদের হাতে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদেরকে (অনুপ চেটিয়া) বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করে জঙ্গি তৎপরতা চালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। সা¤প্রদায়িক বিজেপির উত্থান আর মার্ডারার মোদি বিদ্বেষ, ভারত বিদ্বেষ যে এক কথা নয় তা ভুলে যাওয়া উচিত কি? একটি দেশ তার বিজনেস পার্টনার বদলাতে পারে কিন্তু প্রতিবেশী বদলাতে পারে না। তাই নিজের স্বাধীনতা সার্বোভৌমত্ব অক্ষুন্ন রেখে জোরালো দাবি তুলে প্রতিবেশীর কাছ থেকে পাওনা আদায় করে নেওয়া এবং দেওয়ার মধ্যেই একটি সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব।

উদাহরণ হিসাবে কানাডা আমেরিকা সম্পর্ক তুলে ধরা যায় (কানাডা আমেরিকার আলোকে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে আরেক দিন লিখার ইচ্ছা থাকলো।) সুতরাং ইতিহাস বিকৃতি আর জঙ্গিবাদ নির্মূলে বর্তমান সরকারের অনেকাংশের সাফল্যকে ক্রেডিট তো দিতেই হবে।

(দুই) প্রায় ১৪ বছর বিরোধীদল বিহীন শাসনের সুযোগ পেয়েও আওয়ামী লীগের ঝুড়িতে ব্যার্থতার সঞ্চয় কিন্তু কম নয়। তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি দুর্যোগকালীন সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার এটা স্বীকার্য। বর্তমান বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে এটা অচল। সরকারের এই নীতির সাথে আমরা একমত। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ ইলেকশন করার আস্থা অর্জনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। বিগত ইলেকশনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ হয়েছে অথচ সরকার নিশ্চিত বিজয় জেনেও এই কারচুপি আশ্রয় না নিয়ে বা না দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টির সুযোগ নিতে পারতো। ’৪৭ এর পর থেকে প্রতিবেশী দেশ বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ইন্সটিটিউশন হিসাবে গড়ে উঠতে পারলেও আমরা এই জায়গায় এক্কেবারেই পিছিয়ে রয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল ও বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত দিয়ে বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক এক্সারসাইজ চালু হবে এটাই ছিল দেশবাসী ও বিশ্বের প্রত্যাশা।

দুর্নিতীমুক্ত প্রশাসন গড়তে সরকার ব্যার্থ হয়েছে। সরকার চরমভাবে ব্যার্থ হয়েছে ব্যাঙ্কিং সেক্টরে; হাজার হাজার কোটি টাকা নাকের ডগা দিয়ে পাচার হয়ে গেছে। এই টাকা দিয়ে বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে বেগম পাড়া। এই বেগম পাড়াগুলোর কিসসা কাহিনীই কাল হয়ে এসেছে সরকারের জন্য। পররাষ্ট্রনীতিতে পুরো দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে নাই সরকার। Balance approach / Balance diplomacy তে আমরা সফল যে নই তা সা¤প্রতিক Visa restrictions / India Card / USA Card / China Card / Russia Card এর পুনঃ পুনঃ ব্যবহার দেখেই আমরা বুঝতে পারি।

একটি দল সারাজীবন ক্ষমতায় থাকতে পারে কিন্তু একজন ব্যক্তি পারে না। ব্যাক্তির পরিবর্তন চিরন্তন। তাই ২০৪২ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগের মধ্যে আমরা কোন Mission / Vision/ Strategic planning / নতুন লিডার তৈরী, জাতিকে এক ছাতার নীচে নিয়ে এসে লিড করার মত পরিকল্পনা আমরা দেখি না। সুতরাং জাতির ভবিষ্যতÑ দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণে এবং বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করতে খুব শীগ্রই প্রধানমন্ত্রীকে উৎধংঃরপ অপঃরড়হ এ যেতে হবে বলে আমরা মনে করি।

(৩) বাংলাদেশে কম বেশী ৫০টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। আওয়ামী লীগ ব্যাতিত কোন রাজনৈতিক দল অদ্যাবধি দেশ পরিচালনার জন্য সঠিক নেতা নির্বাচন করতে পারে নাই। অগ্নি সন্ত্রাস করে রাষ্ট্রকে টেরোরাইজড করা আর ক্ষমতায় যাওয়া ব্যাতিত অন্য কোন উদ্দেশ্য যেন আর কোন এজেন্ডা থাকতে নাই। সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বহির্বিশ্বে লাগাতার ষড়যন্ত্র, দেশের বদনাম করা, রাস্তায় রাস্তায় মিছিল মিটিং এর নামে হাতাহাতি লাঠালাঠি কোন সভ্য দেশের জনতা করে না। বদনাম কোন দলের হয় না। বদনাম হয় দেশের। এই অবস্থার পরিবরর্তন প্রয়োজন।

প্রবাসী হিসাবে আমরা উদ্ভিগ্ন। ওয়াশিংটনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সরকারীসহ প্রবাসে সকল দলের রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ নিয়ে পরাশক্তিদের ক্যাট মাউচ খেলা বন্ধ করতে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন খুবই প্রয়োজন। আর এর দায়িত্ব বর্তায় সরকারের উপর। দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সকল দলের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান সরকারের দায়িত্ব। শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন না দেখে স্বচ্ছ ইলেকশনের মাধ্যমে জাতিকে তার ভবিষ্যত নির্ধারণে সহায়তা করতে বিরোধী দলগুলোর পজিটিভ মাইন্ড সেট একান্ত প্রয়োজন।

FayzulHaque,CCP : Writer & Columnist
Toronto, Canada.