বিদ্যুৎ সরকার : দুই.
ভ্রমরের প্লেন ল্যান্ড করছে রাত ৯টায়, স্বাভাবিকভাবেই শুভমকে ৯টার মধ্যেই এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে হবে। ভ্রমর চাকরিতে জয়েন করেছে কয়েক মাস হলো, এরই মধ্যে তাকে বিভিন্ন প্রজেক্টে ট্যুর করতে হচ্ছে। অবশ্য তার কাজের ন্যাচারটাই অমন। মন্ট্রিয়েল গিয়েছিল কাজের সুবাদেই, দুদিন বাদে ফিরছে। একটি হ্যান্ড লাগেজ নিয়ে হন হনিয়ে শুভমের গাড়ির দিকেই ছুটে আসলো।
: হাউ ওয়াজ ট্যুর?
: সো সো!
: এখন তো বেশ রাত হোয়ে গেল চল ডিনারটা শেষ করে ফেলি কোথাও।
: কোন বাংলাদেশী রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেতে চাই। এ দু’দিন বিভিন্ন রকম ডিশ খেয়ে রুচির বেশ পরিবর্তন ঘটেছে, ফিরিয়ে আনতে চাই।
: তা হলে সরাসরি ‘আড্ডা’য় চলে যাই, কি বল?
: ইউ আর গ্রেট। আমিও মনে মনে তাই ভাবছিলাম।
: আড্ডার ডাল, ভাত, সবজি, মাছ আর কি চাই? সিম্পল খাওয়াই খেতে চাই।
: আমারও তাই। বেশি ঝাল, মশলা দেয়া কারি যতটা সম্ভব এভয়েড করতে চাই, বয়সও তো একটা বড় ফেক্টর তাই নয় কি?
: কে বলে তোমার বয়স হয়েছে? ইউ আর লুকিং সো ইয়াং।
: একটু বেশি হয়ে গেল না কি? হুম, গেট ডাওন, আড্ডায় চলে এসেছি। তুমি যাও একটু ফ্রেশ হয়ে নাও, বাই দিস টাইম আমি গাড়িটা পার্ক করেই ফিরছি।
ডিনার শেষ করে গাড়ি চালিয়ে ফিরতে ফিরতে শুভম জিগ্যেস করলো- ভ্রমর, কাল তুমি কি করছো?

: তোমার কি প্রোগ্রাম? ছুটির দিন কিছুই করার নেই। ঘরে গিয়ে না হয় প্ল্যান করি?
: ও তাহলে আজ আমার ওখানেই থাকছো, তাই নয় কি?
: অসুবিধে নেই তো?
: না না তা কেন, কাল পরশু ছুটি সুতরাং তুমি চাইলে রাতভর মেরাথন আড্ডা।
: রাতভর হয়তো সম্ভব হবে না, কিছুটা টায়ার্ড তো চোখে ঘুম। দেখা যাক কতোক্ষণ জেগে থাকা যায়। আর ঘুমিয়ে পড়লে ডেকো না।
দু’জনে হাতে দু’গøাস ওয়াইন নিয়ে গল্পে মশগুল হয়ে পড়ে। ওদের আলোচনার বিষয় আপাতত সমকালীন ফিল্ম ও সদ্য প্রকাশিত বইপত্র। এবার দেশের বইমেলায় প্রকাশিত নতুন কিছু বই ভ্রমর তার সংগ্রহে আনতে সমর্থ হয়েছে। তার পড়া শেষ হলেই শুভমকে তা দেবে বলে কথা দিল। নতুন কিছু মুভি দেখেছে শুভম। সেগুলো দেখতে বললো ভ্রমরকে খুবই ভাল, নেটফ্লিক্সে পাওয়া যাবে।
কথা বলতে বলতে কখন ভ্রমর সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও জানে না। শুভম ভিতর থেকে একটি চাঁদর এনে তার শরীর ঢেকে দিল। শুভমও লাইট অফ করে দিয়ে পাশের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তখন রাত দুটোর বেশি হবে হয়তো।

সকাল বেলায় ঘুম ভাংতেই পাশে ভ্রমরকে দেখে কিছুটা অবাকই হলো শুভম। তাকে না ডেকে কিচেনে গিয়ে দু’জনের জন্য ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর ভ্রমরের ঘুম ভংলে উঠে গিয়ে শুভমকে গুডমর্নিং বলে ওয়াশ রুমে সরাসরি চলে গেল ফ্রেশ হতে। ভ্রমর ফিরলে দুজনেই ব্রেকফাস্ট করতে বসে পড়লো। ব্র্যাকফাস্ট করতে করতে ভ্রমরই প্রসঙ্গ টেনে বললোঃ
তুমিতো জান আমি অন্ধকারে ঘুমাতে পারি না, ভয় পাই, তবুও তুমি লাইট অফ করে দিয়েছিলে।
: সরি, একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম।
: রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভাংলে চেয়ে দেখি চারিদিকে অন্ধকার, আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। তাই উঠে গিয়ে তোমার বিছানায় গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে তোমার পাশে শুয়ে পড়ি।
: তুমি কি রাগ করেছো?
: তা কেন করবো, তুমিতো আজ প্রথম শোওনি। হঠাৎ এমন কী হলো তোমাকে উঠে আসতে হলো? তাই কিছুটা অবাকই হয়েছি বৈকি! এখন বুঝতে পারলাম। ও কে এখন ব্র্যাকফাস্ট কর, তোমার প্রিয় ডাবল ডিম পোজ, জ্যাম-বাটার পাউরুটি আর এক গøাস গরম দুধ – ঠিক আছে?
: কোনটা আমার প্রিয় তা তো তুমিই ভালো জান। সুতরাং এ বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস না করলেও চলবে। তুমি একজন ভীষণ কেয়ারিং পার্সন। অলওয়েজ আই ফিল হোমলি। দু’দিন তো ছুটি। আমার কিছুই করার নেই, তোমার কি প্রোগ্রাম?

: আমারও তেমন কিছু নেই, কেন কিছু করতে চাও তুমি? চল ধারে কাছে কোথাও ঘুরে আসি?
: আমিও তেমনি ভাবছিলাম, পাহাড় নাকি সমুদ্র?
: চল ব্লু মাউন্টেনে একটি সুখকর সময় কাটিয়ে আসি।
পরদিন সকাল সকাল শুভম ল্যামবারগিনি গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের করেতে করতে ভ্রমরের কাছে জানতে চাইলো ব্লু মাউন্টেন যাবার পথে সে তার এপার্টমেন্টে যাবে কি না? ভ্রমরকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও যেতে হবে বলে জানাল। কিছু কুকিজ, সফট ড্রিংক ও চিল্ড বিয়ার নিয়ে নিল সাথে। ভ্রমরকে ওর এপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে শুভম গেল সামনের টিমহর্টন থেকে কফি আনতে। কফি নিয়ে ফিরে এসে দেখে ভ্রমর কাধে ব্যাক-প্যাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সময়ের আগেই ফিরে আসতে পেরে মনে হয় কিছুটা প্রাউড ফিল করলো ভ্রমর। গাড়িতে উঠার সাথে সাথে এক কাপ কফি ভ্রমরকে দিল। ভ্রমর মনে মনে এমন এক কাপ গরম কফির অভাব অনুভব করছিল।
: তুমি কি মানুষের মাইন্ড রিড করতে পার?
: পুরোপুরি করতে পারছি কই?
: চেষ্টা করে দেখ, ধৈর্য ধরে থাকতে হবে তবেই তোমার প্রার্থীত লক্ষে পৌঁছাতে পারবে, আমার বিশ্বাস। অন দ্যা ওয়ে আমরা কি ওয়াসাগা বিচে একটু সময় কাটাতে পারি ডিয়ার?
: হোয়াই নট, একশত বার। ওখানে আমরা লাঞ্চও সেরে নিতে পারবো। তোমার কিছু ছবি তুলতে চাই বিচে গিয়ে।
: আমি কিন্তু সুইমিং কসটিউম সাথে নিয়ে এসেছি, সাঁতার কাটবো ছবিও তুলবো। তোমার ফটোগ্রাফিতে ভাল হাত সেটা আমার অজানা নয় নিশ্চয়ই।
দু’জনের সূর্যস্নান, জলে সাঁতার কাটা, ফটোসেশন শেষে দুপুরের লাঞ্চের জন্য পাশের একটি রেস্তোরাঁ বেছে নিয়ে খেতে বসে পড়ল।

ঝটপট লাঞ্চ শেষ করেই ছুটে চল্লো ব্লু মাউন্টেনের দিকে। বেশি দেরি হলে রুম পেতে সমস্যা হতে পারে। এসে পছন্দসই একটি রুম পেয়ে গেল, জানালা দিয়ে নীল আকাশটা যেমন দেখা যায় তেমনি সবুজ পাহাড়টাকে। ব্যাক-প্যাক ও অন্য একটি ব্যাগ গাড়ি থেকে নিয়ে এলিভেটর চেপে সরাসরি সপ্তম ফ্লোরে নেমে পড়লো।
রুমে ঢুকেই শুভম দুটি বিয়ার ব্যাগ থেকে বের করে একটি ভ্রমরকে দিয়ে চিয়ার্স বলে পান করতে শুরু করে দিল। পর পর দুটি করে বিয়ার পান করে এ বেলা রুমে কাটিয়ে দিয়ে বরঞ্চ, বিকেলে বের হবার মনস্থ করলো।
বিয়ার পান শেষে দুজনেই একটু নেপ নিয়ে নিল। নেপ শেষ করে ভ্রমর বললো বিচে গিয়ে স্নান করে গা কেমন স্টিকি মনে হচ্ছিল তাই কুইক সাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
কিছুক্ষণ পর ভিতর থেকে ভ্রমর শুভমকে ডেকে ব্যাক-প্যাক থেকে ওর টাওয়াল বের করে দিতে বললো।
: তুমি নিয়ে যাওনি?
: ভুলে গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়ো করে ঢুকলাম।
: দরজাতো বন্ধ, দেব কেমন করে?
: আমি দরজা খুলছি।
: বল কি, তা কেমন করে সম্ভব?

: ভেরি সিম্পল, তুমি না হয় কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে থাকলে।
: তা না হয় থাকলাম, তাতেই চলবে?
: তোমার উপর আমার আস্থা অনেক।
ভ্রমর দরজা খুলে টাওয়াল নিতে নিতে বললো, ‘তুমি সত্যি একজন সুবোধ ছেলে।’
বিকেলে ঘুরতে বের হলো দুজনে। প্রথমে রোপ ওয়েতে উঠে এক পাহাড়ের চুড়ায় যেতে যেতে কিছু ছবি তুললো। ওখান থেকে এসে আরো কিছু দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে বাইরের এক রেস্তোরাঁয় ডিনার শেষ করে রুমে ফিরে এসে চিল্ড বিয়ার খুলে খেতে খেতে দুজনে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে গল্প শুরু করে দিল। গল্প করতে করতে কখন যে দুজনেই একই বেডে ঘুমিয়ে পড়ে তা বুঝেনি।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ব্র্যাকফাস্ট করে টরন্টো রওনা হলো। দুজনেরই কিছু জরুরি কাজ করতে হবে তাই। টরন্টোয় প্রবেশ করে সরাসরি চলে গেল ভ্রমরকে নামিয়ে আসতে। ভ্রমর নেমে শুভমকে হাগ দিয়ে বিদায় জানিয়ে ফিরে যাবার মুহূর্তে ভ্রমরকে কাছে আসতে বললো শুভম।
ভ্রমর কাছে আসতেই শুভম নিচু স্বরে বললো-
‘তুমি অনেক সুন্দর।’
: তুমি কি তা আজ জানলে?
: কালই জেনেছি।
: তার মানে কি? আমি আমি যখন টাওয়েল নিচ্ছিলাম তুমি চোখ বুজে থাকোনি?
: চেষ্টা করেছিলাম পারলাম কই! আসলে ফটোমেটিক গøাস থাকাতে তুমি বুঝতে পারনি আমি চোখ বুজে আছি কি না। দোষটা আমার, বলা উচিৎ ছিল।
ভ্রমর ‘নটি বয়’ বলে শুভমের গালটা টিপে দিয়ে হাসতে হাসতে বাসার দিকে দৌড়ে চলে গেল।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা