ফরিদ আহমেদ : ১৯৪৩ সাল। অর্থহীন এক বিশ্বব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত তখন পৃথিবীর সব পরাশক্তিগুলো। এই যুদ্ধের কোনো অংশ না হবার পরেও বাংলার বুকে নেমে আসে শকুনের কালো ছায়া। শুরু হয় সর্বব্যাপী এক দুর্ভিক্ষ। এর পিছনে শুধু খাদ্যাভাবই দায়ী ছিলো না, অবিবেচক শাসকদের অব্যবস্থাপনা এবং লোভী মানুষদের কারসাজিও মুখ্য ভুমিকা পালন করেছে।

অবিভক্ত বাংলায় তখন ছয় কোটি জনবসতি ছিলো। এর মধ্য থেকে প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষ মারা যায়। অনাহার, অপুষ্টি, আর এর সাথে আসা রোগ-ব্যাধিতে ভুগে মারা গিয়েছিলো তারা। বাংলা অব্দে সেটা পঞ্চাশ সাল বলে পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষ।

দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা বহন করেছে গ্রামবাংলার দরিদ্র মানুষেরা। আকালের হাত থেকে বাঁচতে আরও অনেকের মতোই জয়গুনও তার দুই সন্তানকে নিয়ে চলে গিয়েছিলো ঢাকা শহরে। জয়গুনদের বাড়ি ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের মাঝামাঝি ফতুল্লার কাছাকাছি একটা গ্রামে। ঢাকা শহরে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে, বা অন্য কোনো কাজ করে দুর্ভিক্ষের সময়টাকে কোনোক্রমে পার করেছে জয়গুন।

গ্রামের মানুষ তারা। বেঁচে থাকার লড়াই করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে হয়েছিলো শহরমুখী। অচেনা শহরে তারা অকাতরে হারিয়েছে আত্মীয়-স্বজন এবং আপনজনদের। এই লড়াইটাও বিজয়ের লড়াই ছিলো না। শহরেও পরাজিত হয়েছে তারা। নিজেদের অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হয়েছে সেখানে। ফলে, দুর্ভিক্ষের অনতিবিলম্ব পরেই গ্রামে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিধবা জয়গুন।

জয়গুনের প্রথম স্বামী যখন বেঁচে ছিলো, তখন মোটামুটি সচ্ছল জীবনই ছিলো তাদের। কিন্তু, স্বামী মারা যাবার পরে জয়গুন হারিয়েছে সবকিছুই। দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিলো। সেই সংসারও টেকেনি। ছোট ছেলেটাকে রেখে তাকে আর তার কন্যাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো নতুন স্বামী। শহরে যাবার আগে বসতবাটিটুকুও বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছিলো। ফিরে এলে বাস্তুহারা জীবন হবার কথা গ্রামে। কিন্তু, সেই জায়গাটাতে সামান্য একটু আশার বসতি ছিলো জয়গুনের। তার একটা ছাড়া ভিটে আছে। জয়গুনের প্রপিতামহ খুব সস্তায় এই ভিটেটা কিনেছিলো। ভিটেটার ব্যাপারে নানা ধরনের কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। ভিটের বাড়িটা ছিলো পূর্ব-পশ্চিম প্রসারী, সূর্য দীঘল বাড়ি। সূর্য দীঘল বাড়িতে থাকলে নির্বংশ হতে হয়, এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে ছিলো মানুষের মনে। যে কারণে এই সূর্য দীঘল বাড়িতে কেউ থাকেনি, ভিটেটা পড়ে থেকেছে অব্যবহৃত। শহরে যাবার আগে এটাকেই বিক্রি করতে চেয়েছিলো জয়গুন। কেউ কিনতে রাজি হয়নি।

শহর থেকে ফিরে এখানেই আশ্রয় নেবার পরিকল্পনা করে জয়গুন। এই ভিটের অর্ধেক মালিক সে। বাকি অর্ধেকের মালিকানা তার নাবালক ভাইপো শফির। শফির মা-ও তার সঙ্গে শহরমুখী হয়েছিলো। একই সঙ্গে ফিরেও আসার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই দুই নারী এবং তাদের সন্তানরা এসে ঠাঁই নেয় পরিত্যক্ত সূর্য দীঘল বাড়িতে। ভিটের জঙ্গল পরিষ্কার করে তারা, নিজেদের বাঁশঝাড়ের বাঁশ আর খড় দিয়ে থাকার জন্য কোনো রকমে ঘর ওঠায়। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস। সেটার থেকে মুক্তি পেতে ফকির জোবেদ আলীকে ডেকে আনে তারা। ফকির বাড়ির চারকোণে চারটা তাবিজ পুতে দেয়। এর বিনিময়ে জয়গুন তাকে দেয় সোয়া পাঁচ আনা পয়সা, আর শফির তার ভিক্ষার ঝুলি থেকে বের করে দেয় সোয়া সের চাল।

এতেও ফকির জোবেদ আলীর মন ভরে না। একদিন সে লালসার হাত বাড়ায় জয়গুনের দিকে। স্বামী-বিহীন একটা অল্পবয়সী সুশ্রী মেয়ে, কাজেই তার দিকে সহজে হাত বাড়ানো যায়, এই ধারণা থেকে ফকির এই কাজ করে। এই আক্রমণের পালটা হিসাবে জয়গুন ফকিরের মুখে চুনের ঘটটা ছুড়ে মেরেছিলো। আক্ষরিক অর্থেই মুখে চুন-কালি মেখে সূর্য দীঘল বাড়ি থেকে পালিয়েছিলো ফকির জোবেদ আলী। শুধু ফকির জোবেদ আলীই নয়, গ্রামের গেদু প্রধানও কাম তাড়নায় অস্থির হয়ে জয়গুনকে বিয়ে করার জন্য উতলা হয়ে গিয়েছিলো। শুধু তাই পেটের সংগ্রাম না, নিজের সম্মান বাঁচানোর সংগ্রামও জয়গুনকে করতে হয়েছে অবিরত।

সূর্য দীঘল বাড়িতে আশ্রয় নেবার পরেই শুরু হয় জয়গুন এবং শফির মায়ের টিকে থাকার সংগ্রাম। শফির মা তার আকালের সময়কার ভিক্ষাবৃত্তিতেই নিয়োজিত থাকে। জয়গুন বেছে নেয় কঠিন পথ। ফতুল্লা থেকে ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহ পর্যন্ত চলে যেতো সে। সেখানে গিয়ে সস্তায় চাল কিনে এনে লাভে বিক্রি করতো। এই কাজেও শান্তি ছিলো না। মাঝে মধ্যেই রেল পুলিশকে সেই চাল থেকে ঘুষ দিতে হতো বিনা টিকেটে ভ্রমণের জন্য। জয়গুনের এই জীবন সংগ্রামে তার বারো বছর বয়সী ছেলে হাসুও যোগ দেয়। কুলি-গিরি করা শুরু করে সে।

জয়গুনের জীবন সংগ্রামে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং নারী-বিদ্বেষী ধর্ম। বেপর্দা চলে বলে মানুষ নানা কথা বলে। সেগুলো জয়গুনের কানে দিলে সে জ্বলে উঠে বলে, “খাইট্যা খাইমু। কেওরডা চুরি কইর্যাও খাই না, খ’রাত কইর্যাও খাই না। কউক না, যার মনে যা।” এই কথা তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে বললেও নিজের মনের মাঝে অজানা ভয় ঠিকই কাজ করে তার। তার প্রথম স্বামী মুনশী ছিলো। পুঁথি থেকে পড়ে শোনাতো বেপর্দা নারীর দোজখের শাস্তির ভয়ংকর বিবরণ। সেগুলো মনে পড়তে জয়গুন শিউরে উঠে। কিন্তু, যখনই ছেলেমেয়েদের কচি মুখ ভেসে ওঠে, তখনই ‘ধর্মের অনুশাসন সে ভুলে যায় এক মুহূর্তে। জীবন ধারণের কাছে ধর্মের বারণ তুচ্ছ হয়ে যায়, মিথ্যে হয়ে যায় তার কাছে।’

এই রকম একজন মেরুদণ্ড সোজা নারীকেও মেরুদণ্ড বাঁকা করতে বাধ্য করে ধর্ম ব্যবসায়ী এবং সমাজের সুবিধাভোগী মানুষগুলো। জয়গুনের কোমল জায়গাতে হাত দেয় তারা। মাত্র দশ বছর বয়সী কন্যা মায়মুনার বিয়ের সময়ে তাকে তওবা করতে বাধ্য করায় তারা। বেপর্দা স্ত্রীলোক তাদের কাছে রাস্তার কুত্তীর সমান। মানসিকভাবে অসুস্থ এই লোকগুলো মুক্ত হয়ে উড়তে চাওয়া পাখি মায়ের পায়ে পরিয়ে দেওয়া হয় শিকল।

সেই শিকল অবশ্য বেশিদিন পরিয়ে রাখতে পারে না তারা জয়গুনের পায়ে। পর্দানশীন শিকল পরা নারীর পরিণতি কী হয়, সেটা খুব ভালো করেই জানে জয়গুন। দুর্ভিক্ষ সবে শুরু হয়েছে, সেই সময়ে তার দ্বিতীয় স্বামী করিম বখশ তালাক দিয়েছিলো তাকে। ছেলেকে রেখে দুই মেয়েসহ তাড়িয়ে দিয়েছিলো জয়গুনকে। “দুর্নামের ভয়ে স্বামী পরিত্যক্তা জয়গুন তখনও ঘরের বার হয়নি। খেতে না পাওয়ায় তার বুকে দুধ ছিল না। দুধের শিশু দুধ না পেয়ে শুকনো পাটখড়ির মত হয়েছিল। শেষে ধুঁকতে ধুঁকতে একদিন মারা গেল।”

১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্র ছিলো কোলকাতা। দেশ ভাগের পরে ঢাকা কেন্দ্রিক একটা সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। সেই চর্চাতে আমরা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পেয়েছি। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। আবু ইসহাক তাঁর উপন্যাসের পটভ‚মি হিসাবে বেছে নিয়েছেন চল্লিশের দশককে, বিশেষ করে দুর্ভিক্ষের পরপরের সময়টাতে। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে উঠে এসেছে দেশভাগের বিষয়। তবে, লেখক উপন্যাসের শিল্পিত রূপকে অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে রাজনীতিকে মোটা-দাগে ব্যবহার করেনি, জয়গুনের জীবন সংগ্রামের মাঝে সূ²ভাবে সেটাকে রোপণ করে দিয়েছেন তিনি। উঠে এসেছে দুই স¤প্রদায়ের মধ্যেকার অবিশ্বাস, হিন্দুদের অনিশ্চয়তা, চৌদ্দ পুরুষের ভিটে ছাড়ার জন্য ভীতিকর ব্যগ্রতা। আর এর মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠে এসেছেন একজন রমেশ চক্রবর্তী। গ্রামের ডাক্তার তিনি। সমস্ত মনঃপ্রাণ ঢেলে মানুষের সেবার করেন তিনি। অনেকের কাছ থেকে টাকা-পয়সাও নেন না।

তাঁর স্ত্রী যখন এর ওর দেশত্যাগের কথা বলে তাঁকে দেশত্যাগ করার জন্য চাপ দেন, নইলে মুসলমানদের হাতে কচু-কাটা হতে হবে, তখন রমেশ ডাক্তার উত্তর দেন,
“ওসব বাজে কথা রাখো। এখানে কে তোমাকে মারছে শুনি? কতগুলো পশুর প্ররোচনায় যা হয়েছিল, তা আর হবে না দেখে নিও। ভায়ের বুকে ছুরি বসিয়ে আনন্দ পাওয়া যায় না – সবাই বুঝতে পেরেছে। ভায়ের বুকের রক্তে যে করুণ অভিজ্ঞতা হল, হিন্দু মুসলমানের মন থেকে তা সহজে মুছে যাবে না। আর যদি একান্ত মুছেই যায়, তবে বুঝব তার পেছনে কাজ করেছে স্বার্থান্ধ হিংস্রতা। শুধু এখানেই নয়। সব জায়গায় এ হিংস্রতা দেখা দিতে পারে। এখন এক গণ্ডগোলের ভয়ে পালিয়ে আর এক গণ্ডগোলের মুখে গিয়ে পড়তে হবে। এখানে আমাদের কীসের অভাব? কোন দুঃখে যাব আমরা ঘর-বাড়ী ছেড়ে? জানো না এখানে আমরা মা-র কোলে আছি। “

রমেশ ডাক্তারের এই ভাবনা অবশ্য সত্যি হয়নি। একই মায়ের দুই অংশ সন্তানদের অনেকেই শুধুমাত্র ধর্মের কারণে একজন আরেকজনের প্রতি হিংস্র মনোভাব বজায় রেখে চলেছে। অথচ ধর্মবিশ্বাস একটা বায়বীয় জিনিস মাত্র। নরম মাটি আর সেই মাটিতে বসা শিকড়টা হচ্ছে বাস্তব। সেই বাস্তবকে অস্বীকার করে চলেছে তারা নিত্যদিন।

আবু ইসহাকের উপন্যাসটা নাতিদীর্ঘ, কিন্তু পড়ার পরে এর দীর্ঘ রেশ থেকে যাবে। মহত্তম উপন্যাসের যেটা বৈশিষ্ট্য। স্বল্প দৈর্ঘ্যের মধ্যেই জীবনের গভীরতম বোধকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন লেখক। এটা নিয়ে বাংলাদেশে একটা চলচ্চিত্রও হয়েছে। মহত্তম উপন্যাসের মহত্তম চিত্রায়ন ছিলো তা। বাংলাদেশে নির্মিত সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে সেটা অন্যতম। ১৯৭৯ সালে এটা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলো।