ডঃ বাহারুল হক : “সিনিয়র’স লিডারশিপ এন্ড এনগেজমেন্ট” নামক একটা প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভলান্টিয়ার এম্বাসেডর হিসেবে কিছুদিন আমি এক জায়গায় কয়েক জন সিনিয়র সিটিজেন এর সাথে কাজ করেছিলাম। তখন হীদার নামের অশীতিপর এক ভদ্র মহিলাকে আমি টিম মেম্বার হিসেবে পেয়েছিলাম। সেখানে সেভাবে হীদারের সাথে আমার পরিচয় এবং অনেক দিন কথা বলা। হীদারকে প্রথম দর্শনে আমার মনে হয়েছিল তিনি অন্যদের মত নন, সম্পুর্ণ আলাদা ধাঁচের একজন ভদ্র মহিলা। তার বেশ-ভ‚ষা, হাঁটা-বসা, কথা-বার্তা, ইত্যাদি, পর্যবেক্ষণ করে সেদিন আমার মনে এ ধারনাই জন্ম লাভ করেছিল। পরবর্তিকালে তার সাথে কথা বলে বুঝেছি আমার ধারনা ভুল ছিল না। হীদারের সব বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে আরেকটা বৈশিষ্ট্য যেটা সবার নজর কাড়বেই সেটা হল তার রুপচর্চা।

আশি পার হওয়া একজন মহিলা নিজেকে এমন সুন্দরভাবে রুপচর্চার মত একটা অসহজ কাজের সাথে নিখুঁতভাবে কেন স¤িপ্রক্ত রাখেন বুঝলাম না। শুধু জামা-কাপড় নয় সুন্দর সুন্দর গহনার প্রতিও হীদারের আকর্ষণ প্রবল। সুন্দর জামা-কাপড়তো আছেই প্রতিবার দেখা হলে দেখি গলায় আর কানে নতুন গহনা। গলার নেকলেসের সাথে সুন্দরভাবে ম্যাচ করে ঝুলে থাকে কানে লম্বা দুল। আর যখন পাথরের নেকলেস পরেন তখন কানেও থাকে একই পাথরের দুল। ওপাল, রুবি, গার্নেট, টোপাজ, কি নেই হীদারের সংগ্রহে! হেয়ার স্টাইলে তার কোন বৈচিত্রতা নাই। হেয়ার স্টাইল সব সময় এক রকম। থাকবে না কেন? বয়সের ঝাপটা হীদারের শরীরের সর্বত্র যথেষ্ট লাগলেও মাথায় লেগেছে একেবারে কম। তাই এ বয়সেও সাদা হীদারেরর মাথা ভরা আছে ঘন সোনালী চুলের বহর। হীদার মাথার ঠিক মাঝখানে একটা সিঁথি টেনে বিশেষভাবে ট্রিম করা চুলগুলিকে সমান দুভাগ করে খুব সুন্দরকরে মাথার দুদিকে ঝুলিয়ে রাখেন। চুলে বিশেষ ক্রিম ব্যবহার করেন; ফলে চুলগুলি এলো-থেলো না হয়ে স্বর্ণলতার মত নিস্তরঙ্গ ঝুলে থাকে, যেমনটা হীদার চান।

হীদারের চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যায় তিনি চোখ দুটোর পেছনে কি পরিমান সময় ব্যয় করেন এবং ওগুলো উজ্জল রাখতে কি রকম সচেস্ট। দুচোখে ব্যবহার করেন ঘন কালো আলগা আইল্যাশ। আইল্যাশের গোড়ায় আবার আই লাইনার দিয়ে এঁকে দেন গভীর কালো দাগ। উপরের আইলিড দুটিতে মেখে রাখেন জরিন মাখা উজ্জল শুরমা রঙের মোলায়েম প্রসাধনী (আই শ্যাডো)। সে প্রসাধনী লাগানোতেও আবার আর্ট আছে। আইলিডের আইল্যাশ ঘেষা প্রান্তে প্রসাধনী সব থেকে বেশি গাঢ়; তারপর যতই আইল্যাশ থেকে দূরবর্তি প্রান্তের দিকে গেছেন ততই প্রসাধনী ক্রমাগতভাবে হালকা হয়েছে। সব মিলিয়ে চোখ দুটি হয়ে থাকে বেশ উজ্জল।

সুনিপুনভাবে প্লাক করা আইব্রৌতে ঘন কালো কাজল মেখে হীদার তার চোখের রুপ চর্চার ইতি টানেন। হীদারের নাকের একটা বিশেষত্ত¡ আছে। আমার মতে হীদারের মুখে যে একটা মার্জিত সুশ্রী ভাব তার অনেকটা তার নাকের অবদান। তার নাকের ‘সুপ্রাটিপ’ অংশটি তার উপরের ঠোঁটের কিনারা থেকে নাক অব্দি বিছানো ‘ফিলট্রামের’ সাথে ৯০ ডিগ্রী কোণে অবস্থান করে না। এ অংশটি আরো কয়েক ডিগ্রী পেছনে হেলে নাকের ‘লম্বা ব্রিজ’ অংশটির দিকে টান করে অবস্থান করে। আর এতেই তার নাক হয়ে উঠেছে অন্য রকম সুন্দর। এ রকম নাকে নোলক মানায় ভালো। হীদার বাঙালি হলে আমি বলতাম – “আপা, অনেক কিছুই তো পরলেন; নাকে একটা নোলক পরেন। আপনাকে আরো সুন্দর লাগবে”।

বয়সের দাবিতে হীদারের কপাল সহ সারা মুখে চিকন বলি রেখার আগমন ঘটেছে। চোয়ালের নিচের চামড়া কিছুটা ঝুলে গেছে। এসব কিন্ত হীদারকে মুখে প্রসাধনী মাখা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। হীদার তার ঠোঁটে ব্যবহার করে গাঢ় লাল বা গোলাপী রঙের লিপস্টিক। লিপস্টিকের গাঢ়তা তার ঠোঁটের কুঁচিতাকে মুছে দেয়। ঠোঁটে আনে গøসি পেপারের মত চক চকে ভাব আর সজীবতা। ব্যক্তিত্বপূর্ণ প্রানখোলা নির্মল হাসি হীদারের আরেক বৈশিষ্ট্য। হীদার হাসলে তার ঝক ঝকে মুক্তার মত চিরল দাঁতগুলি দেখা যায়। আমি অবাক হয়ে ভাবি এ বয়সেও তার সবগুলো দাঁত অত্যান্ত সুন্দর ভাবে মুখের দুমাঢ়ীর সাথে সম্পর্ক অটুট রাখলো কি ভাবে!! হীদারের দুহাতের কব্জিও নিরাবরণ নয়। এক হাতে থাকে কালো বেল্টের একটা কালো ঘড়ি যা সাদা হীদারের বিপরীতে বেশ ফুটে থাকে। অন্য্য হাতের কব্জিতে থাকে নানা রঙের পাথর বসানো সুন্দর ব্রেসলেট। সাজগোজে হীদার তার নেইল পলিশ দেয়া আঙ্গুলকেও বাদ দেন না। হীদারের দুহাতের কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা আঙ্গুল দামি পাথর বসানো অঙ্গুরীয় দ্বারা থাকে সুসজ্জিত। আমি হীদারকে দেখি। আশি বছরের এই হীদারের মধ্যে আমি ২৫/৩০ বছরের হীদারকে খুঁজি; পেয়েও যাই। প্রাচীন মিশরের টলেমিয়ান রাজ বংশের পরম রুপবতী ও প্রতাপশালী রানী ক্লিওপ্যাট্রাকে আমরা অনেকেই কম বেশি জানি। আশি বছর বয়সী এই হীদারকে দেখে আমার মনে এই বিশ্বাস জন্মেছে যে সেই ২৫/ ৩০ বছর বয়সী হীদারকে যদি ক্লিওপ্যাট্রা দেখতেন তাহলে হয়ত কিছুটা ঈর্ষা বোধ করতেন। ক্লিওপ্যাট্রা বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৯ বছর। তার এই স্বল্প জীবনে এসেছিল প্রেম (রোমান সম্রাট জুলিয়াস সীজারের সঙ্গে), বিবাহ (রোমান সেনাধ্যক্ষ মার্ক এন্টোনির সঙ্গে), সন্তান, সম্রাজ্য, ক্ষমতা (মহারানী),সব, সব। কিন্তু তার জীবনে সুখ আসেনি। তার জীবন ছিল প্রবলভাবে ঝঞ্জা-বিক্ষুব্দ। দ্বন্দ-কলহ আর যুদ্ধের তীব্র ঢামা ডোলে পরিপুর্ণ। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে জীবনের ইতি টেনেছেন ক্লিওপ্যাট্রা নিজেই। মিশরের তীব্র বিষধর সর্প রাজকোবরা নিয়ে এনে নিজের শরীরের উপর ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় দংশন বরণ করে ক্লিওপ্যাট্রা ইহ লীলা সাঙ্গ করেছেন। সে সব বিচার করলে দেখা যায় যে টরন্টোর এই হীদার অনেক ভাগ্যবতী। দুঃখ হয়তো এসেছে, কিন্ত তা গোলা হয়ে কখনো তার জীবনে ফাটেনি। জীবনকে হীদার ভালোভাবে উপভোগ করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন।

অনুমতি নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- “আচ্ছা বলোতো তুমি এই বয়সেও কেন কষ্ট করে এত নিপুনভাবে সেজে গুজে থাক”? হীদারের সহজ সরল উত্তর – আমি আমার স্বামীর ইচ্ছা পুরন করছি। আমার স্বামী মৃত্যুর সময় বলে গেছেন- “আমি তোমার আগমনের অপেক্ষায় থাকবো। তুমি সেজে গুজে পরিপাটি হয়ে আমার কাছে আসবে। এর কোন ব্যাতিক্রম করোনা প্লিজ”। আমি একেবারে অভিভ‚ত হয়ে গেলাম হীদারের কথা শুনে। হীদারের কথা শুনে মনে হলো- আমার সামনে যে হীদারকে দেখছি সেতো কোন মানবী নয় সে রুপকথার পরী; উড়ন্ত পরী, যে উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে তার পরম প্রিয় স্বামীর কাছে।