ডঃ বাহারুল হক : রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প অপরিচিতা পড়েন নাই এমন বাঙালী কম আছে। একটা মেরুদন্ডহীন পাত্র খব সুন্দর চেহারা আর উচ্চ ডিগ্রীধারী হলেও সে যে পাত্র হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয় বা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না অপরিচিতা গল্পে রবীন্দ্রনাথ তা বুঝিয়েছেন।

গল্পের উৎপত্তি ধনাঢ্য পরিবারের অল্প বয়সে পিতা হারানো এবং মায়ের একমাত্র সন্তান উচ্চ শিক্ষিত অনুপমকে দিয়ে। গল্পের বিকাশ ঘটেছে অভিজাত পরিবারের ডাক্তার পিতার কণ্যা কল্যানীকে টেনে আনার ফলে। আর গল্পের সমাপ্তি হয়েছে যা অবধারিতভাবে ঘটার সম্ভাবনা ছিল তা অকল্পনীয়বাবে না ঘটার মাধ্যমে।

ভালো ছেলের সংজ্ঞা অনুয়ায়ী অনুপম ভালো ছেলে নয় এ কথা বলার কোন সুযোগ নাই। উত্তম স্বভাব চরিত্র ছাড়াও অনুপম সুরুপেরও অধিকারী। অনুপমের মা অল্প বয়সে স্বামীকে হারান। ফলে একমাত্র শিশু পুত্র সন্তান অনুপমকে নিয়ে জীবন কাটানোর জন্য অভিভাবক হিসেবে বেছে নেন পুত্র অনুপম থেকে মাত্র ছয় বছরের বড় নিজের ছোট ভাইকে। এ পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন যাদের থাকে বিশেষ একটা লক্ষ্য। লক্ষ্যটা হলো তিনি কোনমতেই কোন সময়েই কোথাও কারো কাছে এতটুকুও ঠকবেন না। অনুপমের মামা সে প্রকৃতির একজন মানুষ। মামার প্রতি মায়ের সীমাহীন অনুগত ভাব দেখে মামা অনুপমের কাছে হয়ে গেল ঈশ্বরের মত একজন। মামা যা বলেন তাই, মামার কথার উপরে আর কোন কথা নাই।

সাতাশ বছর বয়সী এম এ পাস ধনাঢ্য পরিবারের পুত্র সন্তান অনুপমের জন্য পাত্রী দেখার গুরুদায়ীত্ব কাঁধে নিয়ে এবার মাঠে নেমেছেন অনুপমের অভিভাবক মামা। পাত্রী দেখতে দেখতে শেষে পছন্দ হয়ে গেল কল্যানীকে। পাত্রের নিবাস কলিকাতা অপরদিকে পাত্রী থাকে এক হাজার কিঃ মিঃ দুরে উত্তর প্রদেশের ছোট এক নগরী কানপুরে। পরিবার দুইটি বাঙালী তবে একটা আরেকটার অচেনা। অনুপমের বন্ধু হরিশ পাত্রীর খোঁজ দিয়েছে। পাত্রী ভালো বংশের। পাত্রীর বংশমর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নাই। পাত্রী পক্ষ এককালে অত্যান্ত ধনবান ছিল। কিন্তু বর্তমানে সে রম রমা অবস্থা আর নাই। পাত্রীর বাবা ডাঃ শম্বুনাথ বাবুর সাথে অতীতের সেই অঢেল বিত্ত বৈভবের আর পরিচয় ঘটেনি।

তিনি পৈত্রিক ভিটে মাটি ছেড়ে সুদুর কানপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। একমাত্র কণ্যা কল্যানীকে নিয়ে তার নিরিবিলি খুব সাধারন একটা সংসার। অনুপমের মামা হরিশের মুখ থেকে পাত্রী পক্ষ সম্বন্ধে সব শুনলেন। মামার পছন্দ হয়ে গেল। কথা বার্তা চলতে থাকলো। এক সময় বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল। পাত্রের মামা খুব খুশি। পাত্রী পিতা মাতার একমাত্র সন্তান। পিতা ডাক্তার। অতএব যা কিছু আছে সব তো পাত্রী পাবে। এটা মনে করে পাত্রের মা-মামা বেজায় খুশি। তবে বিয়ে উপলক্ষে কি কি পাবে পাত্র বা পাত্রকে দেয়া হবে তার লিস্ট তৈরী হলো। বিশেষ করে গহনার। দরে ভারে সংখ্যায় গহনার আদ্যপান্ত লিপিবদ্ধ করা হলো। তারপর ঠিক হলো বিয়ের দিনক্ষণ। নির্দিস্ট দিনে পাত্র অনুপমকে নিয়ে মা-মামা বরযাত্রী সমেত হাজির হলেন কানপুরে কন্যার পিত্রালয়ে। অনুপমকে নিয়ে তার মা-মামা সভায় বসেছেন। বরযাত্রীরা বসেছেন আহার গ্রহনের প্রস্তুতি নিয়ে। পাত্রীর বাবা বরযাত্রীদের খাওয়ার দিতে দেরি হয় নাই। বরযাত্রীদের খাওয়া দাওয়া শেষ। এখন বিয়ের কার্য সম্পাদন বাকি। পাত্রের মামা হঠাৎ পাত্রীর বাবার সাথে আড়ালে কথা বললেন। এইখান থেকে ঘটনার সুত্রপাত।

পাত্রীর বাবা পরিস্কার একটা সুযোগ পেলেন মানুষ হিসেবে অনুপমের মামা এবং অনুপম কেমন তা বুঝার। কল্যানীকে তার বাবা যে সব গহনা দিবেন বলে বিয়ের ফর্দে উল্লেখ ছিল সে সব গহনা দেয়া হচ্ছে কিনা এবং সেগুলোর মান কিরকম তা বুঝার জন্য সাথে করে আনা স্যাকরা দিয়ে বিয়ের মন্ত্র পাঠের আগে পরখ করে দেখা দরকার বলে পাত্রের মামা নিঃসংকোচে বলে দিলেন পাত্রীর বাবাকে। গহনা বিষয়ে পাত্রের মামার প্রস্তাব বিশেষ করে স্যাকরা দিয়ে মান যাচাই করার প্রস্তাবে পাত্রীর বাবার সততার প্রতি পাত্রের মামার যে কি পরিমান অবিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে সেটা বুঝতে পাত্রীর বাবা মোটেই কোন সময় নেননি। পাত্রের মামার এই প্রস্তাবে পাত্রীর ব্যাক্তিত্বশালী সল্পভাষী বাবা ভিষণ অপমান বোধ করলেন। কিন্তু তিনি তা বাহিরে প্রকাশ করলেন মা।

একেবারে স্বাভাবিক অবস্থায় রইলেন। তিনি শুধু অনুপমকে ডেকে বললেন- “তোমার মামা বলিতেছেন, বিবাহের কাজ শুরু হইবার আগেই তিনি কনের সমস্ত গহনা যাচাই করিয়া দেখিবেন, ইহাতে তুমি কী বল?” অনুপম কিছুই বললো না।

সে মাথা হেঁট করে চুপ করে থাকলো। মামা বলিলেন, ‘ও আবার কী বলিবে। আমি যা বলিব তাই হইবে।’ পাত্রীর বাবা অনুপমের দিকে তাকিয়ে অনুপমকে জিজ্ঞাসা করলেন – “সেই কথা তবে ঠিক? উনি যা বলিবেন তাই হইবে? এ সম্বন্ধে তোমার কিছুই বলিবার নাই?” অনুপম চুপ করে থেকে তার যে কিছু বলবার নাই তা বুঝিয়ে দিলও পাত্রীর বাবা ভিতরে গেলেন এবং কল্যানীর গা থেকে সমস্ত গহনা খুলে এনে স্যাকরার সামনে মেলে ধরলেন। স্যাকরা গহনা সমুহ দেখলেন; কয়েকটা চেপে টিপে দেখালেন আর বললেন – এগুলো সব পুরানো আমলের খাঁটি সোনার গহনা; এরকম গহনা এখন আর ব্যাবহার হয় না। পাত্রের মামা যে শুধু স্বর্ণের মান দেখলেন তা নয় তিনি বিয়ের ফর্দ করার সময় পাত্রীর বাবা যে পরিমান ও যে সংখায় নানা আইটেম দিবেন বলে লেখা হয়েছিল সে সব ঠিক ঠাক মত দেয়া হলো কিনা তাও ভালো করে দেখে নিলেন। গহনা চাপ্টার শেষ হলো। এবার সভায় বসে বিয়ের কাজটা শেষ করার জন্য বললেন মামা। কিন্তু পাত্রীর বাবা যে ইত্যোমধ্যে অন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন – তিনি বিয়ে দিবেন না। কেন দিবেন না তা জানতে চাইলে তিনি বললেন- ‘আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব, এ কথা যারা মনে করে তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।’

তাছাড়া গহনা বিষয় সহ আরো কয়েকটা বিষয়ে কথা বলে পাত্রীর বাবা নিশ্চিত হলেন যে অনুপম সুরুপা, উচ্চ ডিগ্রীধারী হলেও সে প্রচন্ডরকম ব্যাক্তিত্বহীন এবং অত্যান্ত ভীতু প্রকৃতির একটা মানুষ। এ ধরনের মানুষগুলো সমাজে মেরুদন্ডহীন বলে পরিচিত। অপরদিকে কথা বার্তা বলে আরেকটা সত্য উন্মোচিত হয়েছে যে অনুপমের মামা অনুপমদের পরিববারের মুখ্য নিয়ন্ত্রক। তার কথার বাহিরে অনুপম বা তার মায়ের কিছু করার বা বলার নাই। পাত্রীর বাবা সব বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তিনি অনুপমের মত একটা মেরুদন্ডহীন ছেলে যার আবার নিয়ন্ত্রক অতি চালাক এক মামা তার হাতে কণ্যা তুলে দিবেন না। তিনি তার একমাত্র সন্তান কল্যানীকে অনুপমের সাথে বিয়ে দিলেন না। অনুপমের বিয়ের সাধ আর মিটলো না; বিয়ে না করে করেই তাকে পাত্রীর বাবার ইচ্ছামত নিজ গৃহে ফিরে যেতে হলো।