আতোয়ার রহমান : সত্তর দশকে বড় হয়ে ওঠা আমাদের প্রজন্মের বাঙালি একটি গান শুনলে এখনও উদ্বেল হয়ে ওঠে। ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।’ লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর ও কণ্ঠ ছিল অংশুমান রায়ের। সেই মুজিবুরের আজ জন্মশতবর্ষ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর জন্মশতবর্ষে অপরিসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন সফল এবং বিশ্বজনীন এক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। যদিও বাংলাদেশের প্রথিতযশা কবিরা তাঁকে রাজ নীতির কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এক মহাকাব্য আর সেই মহাকাব্যের নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম রাজা শশাঙ্কের সময় থেকে শুরু হয়ে শেখ মুজিব পর্যন্ত চলেছিল। কিন্তু এ সংগ্রামে মুজিব ব্যতীত তারা কেউ সফল হতে পারেননি। কারণ তারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বিপুল আত্মত্যাগ ও রক্তমুল্যে অর্জিত এই দেশটির অভ্যুদ্যয়ের জন্যই হয়তো তাঁর মতো প্রজ্ঞাবাণ, দূরদর্শী, দুঃসাহসী মানুষটির জন্ম হয়েছিল।

আমৃত্যু আপসহীন লড়াকু শেখ মুজিব বাঙালির ভালোবাসায় সিক্ত একটি নাম, শোষিত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির দিশারি প্রতিবাদী, ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। তিনি ছিলেন বীরত্ব, সাহস ও তেজস্বিতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোদ্ধারা সেই স্বপ্নের নির্মাণ করেছেন রাষ্ট্র গঠনের পরিচ্ছন্ন মৌলিক ভাবনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের উপর ভিত্তি করে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিলেন দীর্ঘ কাল ধরে চলে আসা বাঙালির সামাজিক পরম্পরা, মূল্যবোধ ও পারস্পরিক বিশ্বাসকে। এই জন্যই শেখ মুজিব সফল এবং বিশ্বজনীন এক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। তিনি বিশ্বাস করতেন, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ভাষা, সংস্কৃতি ও সংবিধান অন্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ- যাঁদের ভিন্ন সংস্কৃতি, রুচি ও ভিন্ন ব্যবহারিক যাপন- তাঁরা কখনও মেনে নেন না। তাঁর প্রজ্ঞা ও সঠিক নেতৃত্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য নিয়ে আসে ধর্মনিরপেক্ষতা তাঁর জীবনদর্শনের অন্যতম দিক। ছাত্রজীবন থেকে তাঁর অবস্থান সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহারের প্রচন্ড বিরোধী ছিলেন তিনি। ১৯৪৬-এর কলকাতায় সা¤প্রদায়িক দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় তিনি রিলিফের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, দাঁড়িয়েছিলেন বিপন্ন মানুষের পাশে। এই সত্যের বিপরীতে চলিতে চাহিয়াছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা, তাই খালি গায়ে সাধারণ মানুষের মরণপণ লড়াইয়ের কাছে তাঁদের শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে হয়।
দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অমিততেজ মুক্তিবাহিনীর গৌরবদীপ্ত লড়াই আমাদের চিরদিনের অহংকার। ব্রিটিশদের নিষ্পেষণ থেকে পাকিস্তানিদের দুঃশাসনে বাঙালি যখন অতিষ্ঠ, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। ছয়দফা আন্দোলনে নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বায়ত্বশাসনের দাবি থেকে স্বাধীনতা উত্তরণের আন্দোলনকে অত্যান্ত বিচক্ষনতার সাথে তিনি দিয়ে গেছেন।

তার সমগ্র জীবনের প্রায় এক চতুর্থাংশ তিনি জেলে বন্দি ছিলেন। একজন মানুষের জীবনের যে সময়টা সবচেয়ে উপভোগ্য সেই সময়টা তিনি জেলের নিভৃত প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছিলেন। না তিনি নিজের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে জেল খাটেননি। তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন অভাগা বাঙালি জাতিকে মুক্ত ও স্বাধীন করার জন্য। একটি স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য।

বাঙালি জাতির নিজস্ব পরিচয় ও ঠিকানা খুঁজতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন বঙ্গবন্ধু। দেশমাতৃকার জন্য নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও অর্জন করতে চেয়েছেন একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড। তিনি বাঙালির প্রাণের স্পন্দন, যন্ত্রণা, আবেগ, আকাক্সক্ষা, আকুতি উপলব্ধি করতেন এবং বীরের মতো সগৌরবে জেগে উঠেছিলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তার বজ্রকণ্ঠকে কোনোভাবেই স্তব্ধ করতে পারেনি। তারই কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ।

পরবর্তীতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, ভাষা, আন্দোলনের পথ ধরে গণতন্ত্র ও বাঙালির আজন্ম লালিত অধিকার আদায়ের দাবিতে ৬ দফা, ৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় ও শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি, সামরিক জান্তার নিষ্পেষণ, হত্যা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতির ম্যান্ডেট নিয়ে একাত্তরের অগ্নিঝরা ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ মুক্তিকামি মানুষের সামনে সফেদ সাদা পাঞ্জাবির ওপর কালোকোট গায়ে চোখে মোটা কালো চশমা পরে তর্জনী উঁচু করে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, এক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই বজ্রকণ্ঠের উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার যুদ্ধে পাঠিয়েছিল, মানুষ বীরদর্পে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছিল চেতনায়। তার এই উদ্দীপনামুলক ভাষণ একটি নিরীহ জনগোষ্ঠীকে দুর্ধর্ষ যোদ্ধায় পরিণত করেছিল। বাঙালির চেতনায় মুক্তির শ্বেতশুভ্র ফুল ফুটিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার স্বপ্নে মানুষকে উদ্দীপিত করে বাঙালিকে লড়াকু জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তাঁকে অনেক সুউচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর দৃঢ়-দীপ্ত কণ্ঠ আজও যেন প্রতিটি বাঙালির কানে বাজে, এবং যুগ যুগ ধরে তা বাজতে থাকবে। এটি বাংলার মুক্তি সনদ হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর ঐতিহাসিক প্রামান্য দলিল হিসেবে সংরক্ষিত। বিশ্বের সামনে এ এক গৌরব্জনক অর্জন। ৭ মারচের ভাষণে তিনি যা বলেছিলেন সে বিষয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছিলেন, পৃথিবীতে মানুষ যতদিন পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে, ততদিন এই ভাষণ প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত প্রয়াসের কথা সর্বজনবিদিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর দেশটা গড়তে দেশবাসিক আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। উন্নত দেশগুলোতে গিয়েছেন, জাতিসঙ্ঘে গিয়েছেন, বাংবজনবিদিত জন্য সাহায্য চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে সবসময় কাক্সিক্ষত সাহায্য সহযোগিতা পাননি। কিন্তু তাতে তিনি দমে যাননি, মনোবল হারাননি।

তিনি সম্মানজনক আন্তর্জাতিক জুলিও কুরি পদকে ভুষিত হয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ব বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। অনেক বড় মাপের নেতা ছিলেন তিনি। সমগ্র বিশ্বে তিনি সমাদৃত ছিলেন তার নেতৃত্ব গুণেই। বঙ্গবন্ধু অপরিসীম আত্মত্যাগ এবং শেষ পর্যন্ত নিজের জীবন দিয়ে আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারের মূল্য দিলেন।
লেখক : গল্পকার।