ইউসুফ কামাল : জীবনে কোনটা যে সুখ আর কোনটা যে কষ্টের, সেটা সুখের সময় কখনোই বোঝা যায় না। কারণ সুখের সময়গুলো এতো তাড়াতাড়ি চলে যায় যা বোঝা যায় অনেক পরে। আর পরে তা আঁকড়ে ধরতে চাইলেও আর ধরে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সেই সাথে মূল্যবান একটা জিনিষ স্রোতের মতো হারিয়ে যায় তা হলো ‘সময়’। যেটা কারো জন্যেই বসে থাকে না, বা কোনো কিছুর বিনিময়েই আর ফিরে পাওয়া যায় না। ছাত্রজীবনের চিন্তা শুধুই পরীক্ষা কেন্দ্রিক, তাতে ক্লাশ আর সাথে পরীক্ষা আর ফলাফল। বাস্তব চিন্তা বলতে ঐ গুলোই। দৈনন্দিন খরচাদির চিন্তা যাদের করতে হয় না তাদের তো মহা আনন্দ। কোনো কষ্টই যেনো তাদের আর স্পর্শ করতে পারে না। ছাত্র জীবনের মতো এই সর্বোত্তম সুখের জীবন আর হয় না! ক্লাস শেষে বা দুপুরে টিএসসির খাওয়া শেষে বিকেলে কেউ কেউ টিএসসির সামনের ভীড় এড়াতে সামনের রেস কোর্সের মাঠে পর্যন্ত চলে যেতো। এর কোনো ব্যাত্যয় ছিলো না, এটাই যেনো প্রাত্যহিক ধরাবাধা রুটিন। দিনগুলো যেন সুপারসনিক জেটের মতোই তীব্র গতিতে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো।

বিকালের দিকে আলম রোজীকে সাথে নিয়ে বসতে গিয়েছিলো রেসকোর্সের ভিতরে। আমরা কেউই ছিলাম না সাথে, হয়তো গল্পচ্ছলে দুইজন হাঁটতে হাঁটতে একটু ভিতরের দিকেই চলে গিয়েছিলো। ওদের দুজনকে একা পেয়ে একটা ঝামেলা শুরু করতে যাচ্ছিল কয়েকজন মানুষ আর ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে ওরা আর এগোয়নি তড়িঘড়ি করে ফিরে এসেছিলো। শুনে নিষেধ করছিলাম আমাদের ছাড়া যেনো আর না যায়। বলেছিলাম, চারপাঁচ জন এক সাথে থাকলে কেউ আর সমস্যা করার সাহস পাবে না। মাঝে মাঝে কলাভবনের ছাদেও নাকি এমনি অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে কারো কারো। জুনিয়র কিছু ছাত্র কোন যুগলকে বসে গল্প করা দেখলেই নগদ অর্থ আদায় করার উদ্দেশ্যে ঝামেলা করতে চেষ্টা করতো। মান সন্মানের কথা চিন্তা করে অনেককেই টাকা দিয়েই চলে আসতে হয়েছে বলে শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরে বিষয়টা যাওয়ার পরে কলাভবনের ছাদের দরজায় তালা মেরে ছাত্রছাত্রীদেরকেও ছাদে উঠাই বন্ধ করে দিয়েছিলো কর্তৃপক্ষ। জহুরুল হক হলের অনাবাসিক ছাত্র আমি, বাসাতেই থাকতাম। কোনো না কোনো হলের ছাত্র হিসেবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে হয়, এটাই চিরাচরিত নিয়ম। হলে থাকে না থাকে ছাত্রের পরিচয় কিন্তু হল হিসেবেই, আই/ডি কার্ডেই বোঝা যেতো কে কোন হলের ছাত্র! নিজ ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা ছাড়াও নিজের এলাকার বন্ধুরাও বেশির ভাগ এই জহুরুল হক হলেই থাকতো। বন্ধু পনু সিরাজও এই হলেই থাকতো, ওদের সাথে ঘনিষ্ঠতার অন্য কারণ- এলাকায় এক সাথেই রাজনীতি করতাম। মাঝে মাঝেই বিকেলের দিকে ওদের সাথে চলে যেতাম কলাবাগানের নেতার বাসায়। রাজনীতির মারপ্যাচ তখন সবে দেখতে শুরু করেছি, তখনও বুঝিনি রাজনীতির ভিতরে শঠতাও কাজ করে।

তখন কতই বা বয়স ছিলো, রাজনীতির উন্মাদনায় সারাক্ষণ ব্যাস্ত থাকতাম, গভীরভাবে নেতার চরিত্রের মূল্যায়ন করার মতো যোগ্যতাও তখন ছিলো না। রাজনীতির কানাগলির ভিতর একবার ডুবে গেলে অনেক কিছু বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও বোধহয় লোপ পায়। এমনি মোহান্ধ হয়ে যায় সবাই। আমরাও যে তার ব্যাতিক্রম ছিলাম না সেটা বুঝেছি অনেক মূল্য দিয়ে। রাজনীতি দিয়ে আমাদের সমাজে খুব সংক্ষেপেই উপরে উঠার সিঁড়ির সন্ধানও পাওয়া যায় এটাও অনেকে ভাবে। সব ক্ষেত্রে না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্তমান সমাজে এটাই হচ্ছে। এই রাজনীতিই আফিমের নেশার মতো মানুষকে বুঁদ করে রাখে। একবার কারো মুরিদ হয়ে গেলে নেতা-নেত্রীর ভুল তখন ভূল মনে হয় না, মনে হয় নেতা কোনো ভূল করতে পারেন না। নেতার সমস্ত কার্যকলাপ সবসময়ই সঠিক বলে মনে হয়। হলের অন্য রুমেও অন্য বন্ধুরা থাকে, যার কারণে আমার অনেক সময় এই হলেই কাটতো। দিনের পর দিন অনেক স্মৃতি এই হলের সাথেই জড়িয়ে আছে। বেশি দেরী হয়ে গেলে হল থেকে রাতের খাবারের পর্বটা শেষ করেই বাসার পথে রিক্সা ধরতাম। দিনে যেখানেই থাকি রাতে ঠিকই বাসায় ঘুমাতাম। নিজের বিছানা না হলে কখনোই ঘুম আসতো না, যে অভ্যাস এখনো তেমনিই আছে, তা সে যতো ভালো বিছানাই হোক না কেনো।

শাহবাগ মার্কেটের সিনোরিটা রেস্তোরাঁর বাসু দা ইতিমধ্যেই পরিচিত জন হয়ে গিয়েছিলেন ঘন ঘন বুলাকে নিয়ে উনার রেস্টুরেন্টে বসার কারণে। দীর্ঘ সময় বসে গল্প করলেও উনি সেটা সহজভাবে মেনে নিয়েছিলেন সেটা অন্য কারণে। নিজে বরিশালের মানুষ, বুলার বাড়ি বরিশাল শুনতেই চিনে ফেল্লেন শহরের নথুল্লাবাদ এ দুজনেরই বাড়ি। কাছাকাছি না হলেও পাশাপাশি মহল্লাতেই উভয়ের বাড়ি। ছোট্ট শহরের কত জনই বা মানুষ, মফস্বল শহরের মানুষের মন মানসিকতা তখনও আন্তরিকতার পর্যায়েই ছিলো। মোটামুটি সবাই কোনো না কোনোভাবেই পরিচিত হয়ে যায়। সহজভাবেই চিনে ফেলেছিলেন বুলার পরিবারকে। ওর বাবা স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের থেকেই আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ‘কেয়ার’ এ ভালো পদে চাকুরী করতেন। দেশ স্বাধীনের পরে ঐ সংস্থাই তাকে পোস্টিং দিয়ে জেনেভায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে লন্ডনে পোস্টিং ছিল পরে অবসর নেওয়ার পর ওখানেই বড় একটা স্টোরের মালিক, সুবিধা মতো সময়ে হয়তো পরিবারকেও নিয়ে যাবেন ওখানে। একা একাই থাকেন। বসু দার সাথে বুলার একদিনের আলাপ চারিতায় জেনেছিলাম বরিশাল শহরের বাড়িতে তখন ওর মা ওর বড় ভাইয়ের সাথে থাকেন। বুলাকে নিয়ে কোনো দিন বিকেলে হল থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম শাহবাগের সিনোরিটায়, কোনো দিন আবার রমনা পার্কের সেই বড় ইউক্যালিপটাস এর নীচের সেই প্রিয় বেঞ্চটায়। কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার সন্ধ্যার আগেই হলে ফিরে আসতাম। ব্যাক্তিগতভাবে বুলা খুবই আনন্দ উচ্ছ¡ল মনের মানুষ ছিলো। প্রায় সব সময়ই মুখে হাসি লেগেই থাকতো। বিশেষ করে দেখা হলেই অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বলতো, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রেখেছি? মনটা বেশি রকমের ভালো থাকলে নীচু স্বরে পছন্দের গান গাইতো। অসম্ভব ভালো গানের গলা ছিলো, দুইজন এক সাথে থাকলে ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে গাইতো, বুঝতো আমি ওর গান পছন্দ করি। সহজাত শিল্পীর একটা বৈশিষ্ট ছিলো ওর মধ্যে। আমিও কেন জানি ওর গান গাওয়ার ভংগিটাও দারুণ উপভোগ করতাম। এত গভীরভাবে গাইতো যে মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে যেতাম। মনে হতো ওর মনের গভীর থেকে গানের বাণীগুলো যেনো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিক। সেদিন ও গাইছিলো,
আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বাতাসের মতো
সে যে ছুয়ে গেলো….

বল্লাম তুমি এত কষ্টের গান গাও কেনো? কতক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর খুব ধীরে ধীরে বল্লো, ছোট কষ্ট পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বড় কষ্ট সহজেই সহ্য হয়ে যায়। মন দিয়ে ওর গান শোনা দেখলেই ওর চোখ মুখে একটা আত্মতৃপ্তির ছায়া ফুটে উঠতো, গানগুলোও তখন যেন আরো বেশি হ্রদয়স্পর্শী হয়ে উঠতো। মাঝে মাঝে মনে হতো আমার ভালো লাগানোর জন্য দু’একটা গান বেশি করেই গাইতো।
সুন্দর সেই মূহূর্তগুলো যেন সোনার খাঁচার মধ্যেই বন্দী হয়ে থাকতো সারা দিনের কর্ম ব্যাস্ততার মাঝেও। সমস্ত সময়ই মনের ভিতর অনুরণিত হতে থাকে।
(চলবে)
হিউস্টোন, টেক্সাস