ইউসুফ কামাল : মন আমার পাগলা ঘাড়া রে
কই থাইক্যা কই লইয়া যাস
তোর আচরণ প্রভুর মতন আমি ক্রীতদাস।
(কুদ্দুস বয়াতী)
মনের কাছে সব মানুষই বাঁধা, মনের কাছে মানুষ সত্যিই ক্রীতদাস। একমাত্র এই একটা জিনিষ যার গতি-শব্দ, আলো, বিদ্যুত এর চেয়েও দ্রুত গতি সম্পন্ন। মানুষের মন নিমিষে লক্ষ মাইল দূরে কখন যে কোথায় চলে যায় সেটা পরিমাপ করাই সম্ভব না। মরুভূমি অঞ্চল থেকে এন্টারটিকা মহাদেশের বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের দূরবর্তি স্থানে, কোথাও এর গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় কি? মন থেকে কিছু জিনিষ হয়তো সাময়িকভাবে মুছে যায় কিন্তু তার ভিতরের সংবেদনশীল অংশটুকু কখনোই অবলোপিত হয় না। এমনকি কুদ্দুস বয়াতী নিজেও কি কখনোই বুঝতে পেরেছিলেন লক্ষ কোটি মানুষের মনের কথা উনি কত সহজভাবে বলে গেলেন? ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ায় জন্ম নেওয়া একটা স্বল্পশিক্ষিত প্রায় অপরিচিত গ্রাম্য বয়াতীকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করে দিয়েছিলেন আর এক কিংবদন্তী সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ। এর আগে অবশ্য কিছুটা পরিচিত হয়েছিলেন অভিনেতা আফজাল হোসেনের মাধ্যমে।

হুমায়ুন আহমেদ নিজেও বৃহত্তর ময়মনসিংহের লোক হিসাবে সাথে পরিচিত ছিলেন। প্রাথমিক গণশিক্ষার প্রচারণার অংশ হিসাবে গ্রাম্য মানুষের কাছে সহজবোধ্য করার জন্যে কুদ্দুস বয়াতীকে নিয়ে গাওয়া ‘এই দিন দিন না আরো দিন আছে’ ধরনের কয়েকটা গান চিত্রায়িত করেন। এর পর থেকেই আকাশচুম্বি পরিচিত হয়ে ওঠেন। সারাদেশের একটা সিংহভাগ মানুষের মাঝে একটা জায়গা করে নেন এই কুদ্দুস বয়াতী। মাত্র ১২ বছর বয়স থেকে গান গাওয়া শুরু করে তার সুদীর্ঘ জীবনে ১২/১৩ বার আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ সফর করেন। কুদ্দুস বয়াতীকে এই অবস্থায় আনার বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে যেয়ে হুমায়ুন আহমেদ এক জায়গায় বলেছিলেন, প্রোগ্রাম করার জন্য বয়াতীকে উনার নিজের বাসায় এনে রেখেছিলেন। দুই/তিন দিন পর নিজের ড্রয়িং রুমে আর ঢুকতে পারতেন না, বিড়ির উত্কট গন্ধে, সহ্য করতে না পেরে পরে বেনসন এর প্যাকেট কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও নাকি বয়াতী লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি খেতো, বেনসনে তার নেশা যেতো না। আর সেই মানুষটাই যুগান্তকারী কিছু গান গেয়ে সারাদেশ ব্যাপী এমন কি দেশের বাইরেও যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন। সত্যিই যুগের পর যুগ পার হওয়ার পরও কি কেউ পারে তার জীবনের স্বর্ণালী দিনগুলো ভূলতে? পাগলা ঘোড়ার মতোই মনটাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় যোজন যোজন দূরে।

দশ হাজার মাইল দূরের হিউস্টনে বসে চার যুগের বেশি সময় পরে কি আমি ভুলতে পারলাম বুলা কে? সেই চঞ্চলা আবেগ ভরা মানুষটা যার সাহচর্যে কেটেছে দিনের পর দিন, তাকে কি ভোলা যায়? সহজ সরল আবেগে ভরা দরদী মনের একটা মানুষ, যার সাহচর্যে আন্দোলিত হতো মন প্রাণ। ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে যেতো টিএসসির ঘাসের গালিচায় বসে মায়াবী স্বপ্নের জাল বুনে। দুপুরের খাবারের জন্য টিএসসি’তে ঢুকলাম, বিদ্যুত খাবারের দুই’টা কুপন কিনে ক্যাফেটেরিয়ার কাউন্টারে জমা দিতে গেছে, আমি টেবিলে বসে আছি। দেখি ক্যাফেটেরিয়ার গেটে দাঁড়িয়ে বুলা, চারিদিকে কাউকে খুঁজছে। দাঁড়িয়ে হাত ইশারা করলাম, খেয়াল করলাম মুখটা কিছু খুঁজে পাওয়ার আনন্দে উজ্বল হয়ে উঠলো। সুন্দর একটা হাসি ফুটে উঠলো মুখে, ত্বরিত গতিতে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো চেয়ারের পাশে। বসতে বল্লাম। বুঝলাম, খাওয়া দাওয়া এখনো হয়নি। মুখটা শুকনো লাগছে। বল্লো, তোমাকে ডিপার্টমেন্টে না দেখে তোমার বন্ধু আলম ভাইকে জিজ্ঞেস করাতে সে বল্লো এখানে থাকতে পারো তাই চলে এলাম, ভালো লাগছিল না, চলে এসেছি। ওঁকে দেখে বিদ্যুত আরেকটা কুপন কেটে কাউন্টারে দিয়ে এসে টেবিলে বসলো। বুলাকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে, চোখমুখ শুকনো কেনো, মন খারাপ? অকপটে স্বীকার করল, হ্যাঁ, ভালো লাগছিলো না। বিদ্যুত যে ওঁকে খুবই স্নেহ করে সেটা আমি জানতাম। মন দিয়ে খাওয়া দেখে বুঝলাম ভালোই ক্ষিধে লেগেছে, হয়তো সকালে ভালো মতো নাস্তাও করেনি। বল্লাম, মনে হয় সকালে ঠিক মতো নাস্তাও করো নাই। মুখটা শুকিয়ে গেছে খেয়ালও তো করো না। রাতে ঠিক মতো ঘুমিয়েছো? আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, হয়তো আমার মনের কথাটা পড়তে চাইলো। মুখটা মলিন করে বল্লো, নাস্তাই তো করিনি। কোনো কিছুর মধ্যেই ওর ভনিতা নাই, অকপটে সত্যি কথাটাই বলে দেয়। ওর সরল বকত্ব্যে মনটা আরো দুর্বল হয়ে পড়লো। বিদ্যুত এর সহজাত স্নেহ ফুটো উঠলো, নাস্তা করো নাই কেনো? বল্লো, এমনিই। ভালো লাগছিলো না।

খাওয়া শেষে বেরিয়ে আসলাম ওখান থেকে। লাঞ্চের পরে সপ্তাহে দুইদিন ক্লাশ থাকতো। সেদিন অফ ছিলো, বুলাকে জিজ্ঞাস করাতে ও বল্লো ,আজকে আর ক্লাশ করবো না, খুব আস্তে করে বল্লো, তোমাদের সাথে ঘুরবো। সীমাকে বলে এসেছি। সীমা মানে ওর সহপাঠী কাম রুম মেট। মাথার মধ্যে নতুন একটা চিন্তা জড়ো হলো, পারিবারিক অশান্তি না তো? নিজের থেকে কিছু না বল্লে তো জিজ্ঞাস করা ঠিক হবে না, তবে ও নিজের থেকেই বলবে বিশ্বাস। আলাদা ধরনের একটা বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিলো ওর উপর, সব কিছুই শেয়ার করে।
হাঁটার কথা উঠতেই বিদ্যুত বল্লো চলো শাহবাগে যাই, বলেই হাঁটা শুরু করে দিলো। মনটা হাল্কা করতে চাইছে ও, জানতে চাইছে বিষয়টা কি। শাহবাগের সিনেরিটায় ঢুকতে যেয়ে চোখাচোখি হয়ে গেলো ম্যানেজার বাসু’দার সাথে। বুলাকে তো চেনেই, বরিশালের মানুষ, বিদ্যুত এর সাথেও ভালো পরিচয়। দোতলার রুমের এক পাশের টেবিলে যেয়ে বসলাম। এ সময় সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা এখানে এসে বসে, কিছুক্ষণ বসে গল্প গুজব করে চলে যায়। চা নিয়ে এলো শরীফ, সবারই মোটামুটি প্রিয় ছেলেটা। যার যার মতো সবাই ওঁকে টিপস্ও দেয়। নাসিম একদিন ওকে পঞ্চাশ পয়সা টিপস দেওয়াতে ও নাসিমকে বলেছিল স্যার কেউ এখনো দেখে নাই, আপনি ফেরত নিয়া নেন। পঞ্চাশ পয়সা খুব কম মনে করেছিল ও। এই নিয়ে পরে আমরা অনেক হাসাহাসি করেছিলাম। সিগারেট কেনার নাম করে আমাদেরকে রেখে বিদ্যুত নীচে নেমে গেলো, আসলে কথা বলার সুযোগ দিয়ে গেলো। সিনোরিটার দোতলাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন, দু’একজন মানুষ প্রায় সময়ই থাকে, দেখলাম বাম পাশে আমারই পরিচিত আসাদ, সাথে তারই সহপাঠী ইকোনোমিকস এর। আমার টেবিলের উল্টোদিকে বুলা তখনো মুখটা মলিন বল্লাম, কি হয়েছে?

আমার কথায় যেন আষাঢ়ে মেঘটা আরো ঘনীভূত হলো, আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ফর্সা মুখটা ভারী, আমার কথায় সরাসরি চাইলো। বল্লো, মা অসুস্থ। তুমি তো জানো না, মা এর কতো কাছের মানুষ আমি। বড় ভাই কয়েকদিনের জন্য খুলনা গেছে, এর মধ্যে এই অবস্থা। তুমি তো জানো আমার বাপি দীর্ঘ দিন ধরেই বিদেশে থাকে, আমি ছাড়া মা খুবই অসহায়, কি যে হবে? বুঝলাম বিষয়টা। বল্লাম, আগেই বেশি চিন্তা করো না। কি রকম অসুস্থ? তোমার ভাই কবে ফিরবেন? বাসায় কথা বলেছো? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বল্লো, কথা বলা দরকার। বল্লাম, কথা বলার ব্যবস্থা করছি, সম্পূর্ণ অবস্থাটা আগে জেনে নিই তার পরে ব্যবস্থা নেবো। চলো, রমনা টিএন্ডটিতে যাই ওখান থেকে অল্প সময়ে ট্রাঙ্ক কল করা যাবে। বিদ্যুতকে বলে, বুলাকে নিয়ে চলে আসলাম রমনা এক্সচেঞ্জে। দোতলায় এলাকার বড় ভাই আমজাদ সুইচ রুমে চাকরী করেন।

বরিশালের বুলার বাসার নাম্বার দিয়ে ওর মায়ের অসুস্থতার কথাটা বলতেই উনি বল্লেন চিন্তা করো না আমি দেখছি কি করা যায় । উনি কথা বলে এসে বল্লেন, আমার রুমেই বসো, পাঁচ মিনিটেই অপারেটর আমার এই নাম্বারে সংযোগ দিয়ে দেবে। তোমরা চা খাও। মা এর সাথে কথা বলে দেখলাম বুলার মুখ থেকে মেঘের ছায়া কেটে গেলো, বড় ভাই খবর পেয়ে খুলনা থেকে ফিরে এসেছে। আপাতত: কোনো সমস্যা নাই। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে চিন্তা করতে নিষেধ করেছে। দুই/তিন দিনেই আশা করছে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বুলাকে হলে নামাতে হবে। রিক্সায় বল্লাম, এখন কেমন লাগছে? আমার দিকে তাকালো, মুখটা একটু উজ্বল করে হাসলো, ডান হাতে একটা নতুন স্পর্শ টের পেলাম। দু’হাত দিয়ে আমার ডান হাতটা ধরলো। বল্লো, ধন্যবাদ। হাতের বাঁধনে কৃতজ্ঞতার ছাপ পরিস্কার। হলের গেটে নামা পর্যন্ত হাতটা ধরেই রাখলো। ছাড়লো না, কৃতজ্ঞতার প্রতিদান স্বরূপই হয়তো ধরে রাখলো। নামার সময় বল্লো, আসলেই তোমার উপর নির্ভর করা যায়। আমি ভুল মানুষ পাইনি। (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, ইউএসএ