ইউসুফ কামাল : মানুষের জীবনটা কত বিচিত্র! কত সংগ্রাম, কত চড়াই উৎড়াই, কত ঘাত প্রতিঘাত মিলে মিশে এই জীবন। এর মধ্যেই কেউ কেউ একসময় পৌঁছে যায় তার ইপ্সিত লক্ষ্যে, আবার কেউ হয়তো তাও পারে না মুখ থুবড়ে পড়ে যায় চলতে চলতে। পরিকল্পিত জীবনের চেহারা কত জন দেখতে পায়? কতজন সুখী হয় জীবনে, সুখ জিনিষটাই বা কি? সুখের সংজ্ঞাটাও একেক জনের কাছে একেক রকম। সারাজীবনে নেশাগ্রস্থভাবে অর্থ আয় করেও কিন্তু পরিণতিতে মানুষের ঘাড়ে চড়েই পর পাড়ে যাত্রা করতে হয়। এ যেন সেই হ্যামিলনের বংশীবাদকের পরিণতি। অদৃশ্য কিন্তু মহাশক্তিধর বাঁশীর সুরে ছুটে চলা পথে পিছনে ফেলে রেখে যায় আপন মানুষ, আপন সৃষ্টি সব কিছু। অধিকাংশের জীবনের শেষ ছবিটা বিষন্ন বিকেলের মতো হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শেষ পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। সারা জীবন দাপটের সাথে মাটি কাপিয়ে চলা মানুষগুলো কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই শ্রেণীর মানুষগুলো কখনোই তাদের সারাজীবনের লালিত নীতি আদর্শের স্বপ্নগুলো থেকে বিচ্যুত হয় না। এলাকায় মোটামুটি ঘনিষ্ঠভাবে তখন রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। একদিন রাতে বিশেষ বাহিনীর লিডার আমাদের নেতাকে প্রস্তাব দিলেন তাদের গাড়িতে আমাদের কাউকে দিয়ে প্রতি পক্ষকে ধরার ব্যাপারে সাহায্য করতে। প্রত্যুত্তরে ঐ বাহিনীর লিডারকে দারুনভাবে অপমানিত হতে হয়েছিল। দুর্দান্ত ক্ষমতাধর ঐ মানুষগুলিও আমাদের বলিষ্ঠ নেতার কথা শুনে তার সামনে মাথা নীচু করে বসে ছিলেন। যা এখনো ভুলিনি, ভুলতে পারিনি তার দৃঢ় মানসিকতার কথা। জীবনের শেষ প্রহরে স্ত্রীর পৈতৃক অংশে পাওয়া একটা ফ্লাটেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। নাই কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স নাই জমি জমা। ডাক্তারী পেশায় সারা জীবন নিয়োজিত থেকে জীবন সায়াহ্নের এই সংগ্রামী মানুষটির স্ত্রীর মৃত্যুর পর আজ নি:সংগ জীবন নৌকার একক যাত্রী। আলাপ করতে করতে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লে আছিরকে বলতেন সবাইকে একটা করে ভিটামিন ‘লারগাটিল’ খেতে দাও।

খাওয়ার পরে কেনো জানি শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতো। দুপুরে খাওয়ার পরেই অঘোর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়তাম। পরে বুঝেছিলাম ওটা আদৌ ভিটামিন ছিলো না। কখনই কোনো বাজে কাজের সমর্থন করতেন না। বেশ কয়েক মাস পর ঢাকা থেকে বাড়িতে গেছি বন্ধু আওলাদ বল্লো চলো মিষ্টি খেয়ে আসি। তেওয়ারীর দোকানে বসে চমচম খেয়ে চলে আসলাম, আমি টাকা টাকা দিয়ে চাইলে আওলাদ দিতে দিলো না, বল্লো, লাগবে না চলো। মালিক ভয়ে কিছুই বল্লো না, পরে সেই ঘটনা নেতার কানে যাওয়া মাত্র আছিরকে দিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিলেন। বল্লেন যখন মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করবে আমাকে বলবে। আর তেওয়ারীও জানতো আমরা উনার লোক। কিন্তু ঐ ঘটনার পরে আর আমাদের মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছেও করতো না।
আমাদের সেই প্রিয় ব্যাক্তিত্ব প্রথম জীবনে চিকিৎসক হিসাবে প্রচুর সুনাম কুড়ানোর পর জীবনের দ্বিতীয় অংশে হলেন রাজনীতিবিদ। ক্লাশ শেষ করে আলমের হলে দুপুরে খেয়ে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই চলে যেতাম নিউ মার্কেটে, সাথে থাকতো বিদ্যুৎ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের তখন নিউমার্কেটে টুকিটাকি কেনাকাটার পাশাপাশি ঘুরে বেড়ানোটা একটা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় ছিলো। কলেজ রেস্টুরেন্টে চা খাওয়ার সাথে সাথে সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎও হয়ে যেতো। মোটামুটি ঐ জায়গাটা একটা মিটিং পয়েন্টও বলা চলতো। ঢাকা নিউমার্কেট ১৯৫৪ সালে শেষ হওয়ার পর তখনকার চীফ মিনিষ্টার নুরুল আমিন এর উদ্বোধন করেন। ৩৫ একর জমির উপর গড়ে উঠে এই বিশাল স্থাপনা। আজিমপুর, ধানমন্ডি ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মানুষের কেনাকাটার জন্যই এটা মুলত: গড়ে ওঠে।

নিউমার্কেটে ঢোকার সময় একদিন মুখামুখি দেখা হয়ে গেলো বুলা আর সীমার সাথে, ওরা কেনাকাটা শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। সেটা আমাদের পরিচয়ের দিন দুই পরের দিকে সম্ভবত:। বই খাতা কিনতেই এসেছিলো, হাতে খাতার প্যাকেট। কাছে এসে দাঁড়ালো বল্লাম, কতক্ষণ এসেছো, কেনাকাটা শেষ? বল্লো, এই তো একটু আগেই, খাতা কলম কিনলাম। বল্লাম, এক্ষুনি চলে যাবে না একটু থাকবে? না গেলে চলো চা খাই। চোখ মুখে খুশীর ছোয়া দেখে বুঝলাম ও থাকতেই চাইবে, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। তখনো বুলার সাথে সম্পর্কটা প্রাথমিক পর্যায় পেরোয় নাই। সবে শুরু তবে গভীরতার দিকে অগ্রসর হবে সেটা বোঝা যাচ্ছিলো বুলার নম্র পরিমিত আচরণ দেখে। আন্তরিকতার পর্যায়ে পৌঁছতে একটু সময় লাগার কারণ হয়তো আমি ওর চেয়ে অল্প একটু সিনিয়র ছিলাম সেটাই কারণ। যেই কারণে ও একটু সময়ও নিয়েছিলো, কোন ভাবেই যাতে আমি ওর সম্মন্ধে কোনো বিরুপ ধারনা না করি। নিজের ব্যাক্তিত্ব ও সন্মানের বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ থাকার কারণে সম্পর্কটাও একটা ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছিলো। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সম্পর্কের গভীরতাও আসে না।
কলেজ রেষ্টুরেন্টে না বসে পাশের লিবার্টিতে বসলাম। একটু নিরিবিলি পরিবেশ, পরিবার নিয়ে নিউমার্কেটে আসলে সবাই তখন এখানে বসতো। আলম বিদ্যুৎ ঢুকলো না বল্লো তোমরা চা খাও, আমরা একটু ঘুরি। চপ্ আর চা অর্ডার দিয়ে বল্লাম, সকালে তো ডিপার্টমেন্টে দেখা হলো কথা বল্লে না যে? আমার কথায় মনে হয় একটু থতমত খেয়ে গেলো। সরাসরি তাকিয়ে বল্লো, বলতে চেয়েছিলাম পরে ভাবলাম আপনি আবার কিছু মনে করেন কিনা তাই সবার সামনে কথা বলিনি। বুঝলাম জড়তা এখনো কাটা শুরু হয় নাই, হয়তো একটু সময় লাগবে। বুলার সাথে প্রথম দিকের পরিচয়েই বুঝেছিলাম ওর পরিমার্জিত ব্যাবহারের নমুনা। যা কারো প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র