ইউসুফ কামাল : শনিবার দিন ঠিক হলো সোনারগাঁও যাবো, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি, বাসার ড্রাইভার করিম মিয়াকে বলে রেখেছিলাম সকালে দিকে রওয়ানা দিতে হবে। সকাল সকাল রওয়ানা হবো, আগের রাতে বিদ্যুৎ এসে থাকলো আমার বাসায়, অত সকালে বাসাবো থেকে আসতে ওর অনেক সমস্যা হয়। ঠিক হলো বুলা সকাল আট’টায় হলের সামনে রেডী হয়ে থাকবে, ওখান থেকে ওঁকে তুলে আমরা সোনারগাঁও এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবো। পপুলার থেকে নিজেরা নাস্তা শেষ করে একটা প্যাকেটে দুইটা পরোটা আর একটা ডিম মামলেট একটা প্যাকেটে ভরে নিলাম বুলার জন্য, ও যদি নাস্তা না করতে পারে তাড়াহুড়োর জন্য। তা ছাড়া এমনিতেই খাওয়ার ব্যাপারে ও সব সময়ই উদাসীন। সামসুন্নাহার হলের সামনে গাড়ি আসতেই দেখি বুলা ঠিকই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে নিয়ে রওয়ানা হতেই সাড়ে আট’টা পেরিয়ে গেলো। গাড়িতে উঠতেই পরোটার প্যাকেটটা ওর হাতে দিয়ে বল্লাম, নাস্তা করে নাও। এখনো গরম আছে। আশ্চর্য্য হয়ে আমাকে বল্লো, তুমি বুঝলে কি করে আমি নাস্তা করিনি? বিজ্ঞের হাসি দিয়ে বল্লাম, এত কিছু বুঝি আর এটা বুঝবো না? তোমার কোন জিনিষটা বুঝি না বলো! তোমার সাথে যে খাবারের একটা অঘোষিত যুদ্ধ আছে সেটাও তো আমার জানা। একটা সন্তষ্টির হাসি দিয়ে বল্লো, এই জন্যই তো তোমাকে পছন্দ কর। সেটা কি তুমি বুঝো? বললাম, তুমি আমাকে পছন্দ কর নাকি? জানতাম না তো? পিছনের সীটে বুলা বসতেই সেই প্রিয় ‘প্যারী এলিস’ এর মিষ্টি গন্ধে গাড়িটা ভরে গেলো। আমার টেনে নিঃশ্বাস নেওয়ার ভঙ্গিতেই ও হেসে বল্লো, কোনটা তোমার বেশি প্রিয়, বলতে পারবে? বল্লাম, একটা তো বুঝলাম, আর একটা? হেসে বল্লো, গাড়ি থামাও নেমে যাই তাহলেই বুঝবে, দুইটা কে কে? হেসে বল্লাম, আচ্ছা ঠিক আছে গাড়ি থেকে নামতে হবে না একটাই বেশি প্রিয়। খুশী তো!

শাহবাগের কোহিনুর থেকে বিদ্যুৎ কয়েকটা সিংগারা আর চপ নিয়ে এলো। ঘুরতে ঘুরতে সবারই ক্ষিধে লেগে যাবে আর তখনই এটা কাজে দেবে। ওর সিদ্ধান্তটা আমার কাছে ভালোই লাগলো। আজ বুলাকে উৎফুল্লই লাগছে, রাতের ঘুমও ভালোই হয়েছে মনে হলো। তাছাড়া বেড়ানো জিনিষটার মধ্যেই একটা ভালো লাগা বোধ কাজ করে সব সময় সবার মধ্যেই। আর সেটাও হয়তো উৎফুল্লতার একটা কারণ। দুপুরের খাবারের বিষয় কি করা যায় বিদ্যুৎকে জিজ্ঞেস করতেই ড্রাইভার করিম মিয়া বল্লো, ভাইজান পানাম সিটিতে ঢোকার সময় মেইন রোডের উপরে ভালো খাবার হোটেল আছে, মিষ্টির দোকানও পাইবেন। চিন্তা কইরেন না। খাঁটি ঢাকাইয়া মানুষ করিম মিয়া, লালবাগের ছাপড়া মসজিদ এলাকায় ওর নিজস্ব বাড়ি। খুবই বিশ্বস্ত ও ভালো মানুষ। নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও এর বড় নগর, খাস নগর ও পানাম নগর (মূলত: এগুলোকে মৌজা বলা যেতে পারে) এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিলো সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ও আকর্ষণীয়। ৪৫০ বছর আগে বারো ভূইয়ার দলপতি ঈশা খা ১৫ শতকে বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন এই সোনারগাঁও-এ। সোনারগাঁও এর অধীনেই সর্বমোট ২০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই পানাম সিটি। সকালে রওয়ানা হওয়ায় দশ’টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পানাম সিটিতে। বান্ধবীদের কাছে পানাম এর গল্প ও পত্রিকার ছবিগুলো বাস্তবে দেখে বুলা রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়লো। ওর মধ্যে বিগত কয়েকদিনের মলিন চেহারা আজকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না, চোখে মুখে একটা খুশীর ঝিলিকও লক্ষ্য করলাম। বল্লো, ছবিতে তো এমনই দেখেছি, বোঝা যাচ্ছে এখানের পরিবেশ একসময় জমজমাটই ছিলো। বল্লাম, এই পানাম সিটি ছিলো বাংলার মসলিনের প্রধান ক্রয় বিক্রয়ের স্থল। পানাম সিটিকে মসলিন ও অন্যান্য তাত শিল্পের তীর্থ নগরীও বলা হতো এক সময়। এখন অনেকে আবার এই কারণেই পানাম সিটিকে “হারানো নগরী” বলে থাকেন।

পঞ্চদশ শতক থেকে মুলত: ব্যাবসায়ী, জমিদাররা এখানে বাস করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত এটা এক সমৃদ্ধশালী, উচ্চবিত্তশীল জনজীবনপূর্ণ এলাকা ছিলো। রাস্তার দুই পাশে মসজিদ, মন্দির, টাকশাল, দরবার কক্ষ, নাচঘর, সরাইখানা প্রভৃতির সরব উপস্থিতি এখনো টের পাওয়া যায়। প্রধান সড়কের এক পাশে গাড়ি থেকে নেমে করিম মিয়াকে ভালো একটা জায়গা দেখে গাড়ি রাখতে বল্লাম। সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে চারিপাশ দেখতে শুরু করলাম। ৫ মিটার চওড়া ৬০০ মিটার লম্বা রাস্তার দুপাশে সারি সারি একতলা, দুই তলা ও তিন তলা ভবন। এখানকার নির্মাণশৈলীতে মোঘল স্থাপত্যের সাথে ব্রিটিশ স্থাপত্য মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কিছু ভবনে যদিও কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে কিন্তু অধিকাংশই পূর্বের চেহারা নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। শুনলাম, এমনি ৫২টা ভবন এখনো এমনিভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
মেঘনা নদী থেকে একটি খাল পুরো পানাম সিটির নৌ যোগাযোগ এখনো অব্যাহত রেখেছে। পর্যটকদের জন্য খালের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, ভ্রমণ পিয়াসুদের জন্য কিছু নৌকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। নৌকা দেখে মনে হয় সবারই নৌকায় চড়তে ইচ্ছা করলো, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুলার কিছু বলার আগেই বল্লাম, চড়বে? ও হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। দরদাম ঠিক করে বিদ্যুৎ ঘন্টা চুক্তিতে নৌকা ঠিক করে ফেল্লো। এই সমস্ত স্থানে কথাবার্তা আগে ভাগেই ঠিক করে নেওয়া উচিত না হলে পরে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। ঘন্টাখানেক নৌকায় ঘোরার পর বিদ্যুৎকে সিংগারার কথা মনে করিয়ে দিতেই ও ব্যাগ থেকে সিংগারার প্যাকেটটা বুলার হাতে দিলো। ও প্যাকেট খুলে মাঝিসহ সবাইকে একটা করে চপ আর সিংগারা হাতে ধরিয়ে দিলো। খাওয়ারভাবে মনে হলো সবারই যেন হাল্কা ক্ষুধা লেগেছে।

একটু পরে দেখলাম বুলা আড়াল করে প্যাকেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিলোÑ ধরেই দেখলাম প্যাকেটে একটাই সিংগারা অবশিষ্ট রয়েছে- হেসে বল্লাম, ধন্যবাদ, ওটা তোমার জন্যে। তুমিই খেয়ে নাও বলে ওর হাতেই প্যাকেটটা ফিরিয়ে দিলাম। নৌকা থেকে নেমে একটা চায়ের দোকান নজরে পরতেই যেন চা’য়ের নেশা পেয়ে গেল, চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম ৪০০ শত বছরের পুরনো টাকশালের সামনে। সহজেই অনুমান করা যায় কত উন্নত ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা হলে এখানে টাকশালের প্রয়োজনীয়তা হয়েছিলো। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীল এর ব্যবসা আর প্রসিদ্ধ মসলিনের কারবারের জন্য দেশ বিদেশের জনসমাগমের কারণে অত্র এলাকার জৌলুস দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিলো। বাংলার নিয়ন্ত্রণ বৃটিশরা নেওয়ার আগে সালতানাত রাজত্বকালের শেষ পর্যায়ের শাসন কালে এখানকার মুসলিমদের সাথে বারো ভূইয়াদের আধিপত্য বজায় ছিলো। বারো ভূইয়াদের শাসন কাল, ঈশাখা’র রাজত্বকালসহ এই সময়গুলোকেই সোনারগাঁও অঞ্চলের স্বর্ণযুগ বলা হতো। ব্রিটিশের রাজত্বকালের শুরুতেই তখনকার সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের সাথে বিভিন্ন কারণে মতভেদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে মুসলিম প্রধানরা ব্রিটিশদের সাথে অসহযোগীতা শুরু করে, যার ফলশ্রæতিতে ব্রিটিশরা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের (যারা তাদের আজ্ঞাবহ ছিলো) এখানে পুনর্বাসন শুরু করে। আর তখনই মুসলিম সংখ্যা গোষ্ঠীরা এলাকা ত্যাগ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে তাদের ঘড় বাড়িসহ অধিকাংশ স্থাপনাসহ সব কিছু ধংস করে দেওয়া হয়।

কারো জন্যেই কিছু থেমে থাকে না ইতিহাসই তার প্রমাণ। শূন্যস্থান ঠিকই পূরণ হয়ে যায়। ঠিক তখনই ব্রিটিশের সহায়তায় উচ্চবর্ণের হিন্দু ব্যবসায়ীরা এখানে পুনর্বাসিত হয়ে জোরেশোরে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে। এখন যে সমস্ত স্থাপনা দেখা যায় তা ঠিক তখনই গড়ে ওঠে। উন্নত শ্রেণীর মূল্যবান উপকরনাদি দিয়ে তারা দর্শনীয় সমস্ত ভবনাদি নির্মাণ করে করে তোলে। গড়ে তোলে আনন্দ স্ফূর্তির জন্য নাচঘড়, পানশালা প্রভৃতি। তার ও পরবর্তিতে ব্রিটিশের ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজত্বের অবসানের পর অর্থাৎ দেশ বিভাগের পরই এই নতুন সৃষ্ট ব্যবসায়ীদের প্রতিপত্তিও হ্রাস পায়। ধীরে ধীরে তারাও দেশের অন্যান্য স্থানে ও পার্শ্ববর্তী দেশসমুহে চলে যায়, ফলে এই সুরম্য ভবনসমুহ পরিত্যাক্ত হতে শুরু করে।
হাঁটতে হাঁটতে সবাই মোটামুটি ক্লান্ত, বুলা মুখে কিছু না বল্লেও হাঁটতে হাঁটতে বার বার পিছিয়ে পড়ছিলো, বার বার ওড়না দিয়ে ঘাম মুছছে। বুঝলাম ও হাঁটতে পারছে না লজ্জায় আবার কিছু বলতেও পারছে না। এখন সবারই একটু বিশ্রাম দরকার।

দুপুরের রোদের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্ষুধাও যেন বেড়ে চল্লো। গাড়ির উদ্দ্যেশে রওয়ানা দিলাম, ভাবলাম পানাম সিটি’র প্রবেশ মুখের খাবার হোটেলে খেয়ে ওখান থেকে সোনারগাঁও এর অন্যান্য এলাকাগুলো ঘুরে দেখবো। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া ইউএসএ