ইউসুফ কামাল : এ কেমন নৈকট্য! মনের মধ্যে সারাক্ষণ অনুরণিত হচ্ছে ওর প্রতিটা মুহূর্তের চলাফেরা, কথাবার্তা। দেখা যাচ্ছে না কিন্তু বোঝা যাচ্ছে – নোঙর ছেড়ে চলে যাওয়া দুরবর্তি জাহাজের মাস্তুলের মতোন, ধীরে ধীরে অসীম নীলিমায় যেন হারিয়ে যাওয়া। একটা শূন্যতা যেন সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরছে, সেলুলয়েডের ফিতার মতো চলতে চলতে যেন হঠাৎ আটকে যায় বিশেষ বিশেষ স্মরণীয় মুহূর্তগুলো। ভেসে আসে শেষ কথাগুলো, কেন আমাকে যেতে দিলে, ধরে রাখতে কি পারতে না? আমি তো যেতে চাইনি। চারিদিকের শূন্যতা যেন ধীরে ধীরে সব কিছু গ্রাস করে ফেলতে চায়। ছক বাঁধা স্বপ্নগুলো যেন তাল লয় কেটে যাওয়া বেসুরো গানের মতো অপাংতেয় হয়ে যাচ্ছে। সদা উচ্ছল একটা মানুষের অভাবে সব কিছুই কি বিলীন হয়ে গেল? যেন শূন্যতার সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে মনের চাপা হাহাকার যা দেখা যায় না কিন্তু সব কিছু ভেংগে চুড়ে চুরমার করে দিয়ে যায়।

পুরনো সেই হ্যালুসিনেশান শব্দটা আবার মনে পড়ে গেল – মস্তিষ্কের মধ্যে কোন বিষয় সব সময় কাজ করলে নাকি হঠাৎ করে চোখের সামনে সেটা উপস্থিতি অনুভব করা যায়। বাংলা ভাষায় যেটাকে বলা হয় মতিভ্রম। সেটা আমার বেলাতেও ঘটলো সেদিন ডিপার্টমেন্টের কড়িডোরে। আলম কে বল্লাম, মনে হলো কড়িডোর দিয়ে বুলা হেঁটে যাচ্ছে। আলম সহানুভূতির স্বরে বল্লো, বন্ধু অমন হতেই পারে। হ্যাঁ তাই হবে, না হলে বুলা এখানে আসবে কেমন করে, আমিই তো ওকে অবচেতন মনে সব সময় খুঁজে বেড়াচ্ছি।
“দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি
তাই চমকিত মন চকিত শ্রবন তৃষিত আকুল আখি”।।

বুলা চলে গেছে চারদিন, একটা শূন্যতা যেন চারিদিকে ছড়িয়ে পরেছে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা কলাভবনে থাকাকালীন সময়ে ইচ্ছে করেই আমার সংগে থাকতো আমিও চেষ্টা করতাম যেন বিমর্ষ না থাকি। দুপুরের পর ক্লাস না থাকলে প্রায়ই বাসায় চলে আসি, বাসায়ই দুপুরের খাওয়া সেরে বাসার রুমেই থাকতাম। বুলার চলে যাওয়াটা আমার জীবনের বাঁধা ধরা রুটিনটাই যেন বদলে দিয়ে গেছে। স্বপ্নের মতো মায়াবী প্রহরগুলো এখন ধরা ছোয়ার বাইরে, ইচ্ছে করলেও যার উপস্থিতি এখন আর সম্ভব নয়। উজ্বল প্রহরগুলো বিমর্ষ কালো আঁধারের মাঝে হারিয়ে গেছে। এটাকে নিয়তি ছাড়া আর কিইবা বলা যেতে পারে! কতগুলো ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেল যে বুঝতে বুঝতেই সময় তার বেরসিক ঘন্টা বাজিয়ে দিলো, ঠেকানোর বিকল্প চিন্তাও যেন করে উঠতে পারলাম না। এত দ্রুত সব কিছু হয়ে গেল। ঐ দিনগুলোতে ক্লাস শেষে বিদ্যুৎকে নিয়ে আলমের হলে দুপুরের খাওয়া শেষে ওদের সাথেই সময় কাটাতাম। মাঝে মাঝে জহুরুল হক হল থেকে সময় কাটাতে চলে যেতাম নিউমার্কেটে বন্ধু নিজামের কাছে। আমাদের দেখলে বন্ধুপ্রিয় নিজাম অসম্ভব খুশী হয়ে উঠতো। ব্যবসার জন্য ও ক্লাস করতে পারতো না আর শেষমেষ পড়াটাও চালিয়ে যাওয়া ওর জন্য দু:সাধ্য হয়ে গেল। সবার সাথে লম্বা গল্পের মধ্য দিয়েই সময়টা কেটে যেত। রাতে বাসায় ফেরার সময় মাঝে মাঝে রাতেও হল থেকেই খেয়ে ফিরতাম। আমি নিজেও জহুরুল হক হলের এ্যাটাচ্ড ছাত্র তাই খাওয়া কোন সমস্যা হতো না। বাসায় ফিরে আর খাওয়ার ঝামেলাও করতে চাইতাম না।

জিলুকে বলে রেখেছিলাম বুলা লন্ডন থেকে ফোন দেবে, বাসায় আমি না থাকলে ও কি বলে সেটা যেন শুনে রাখে। ছয় দিনের দিন সেই বহু আকাঙ্খিত ফোনকলটা এলো, শুক্রবার ছুটির দিন সকাল ন’টার দিকে জিলু ডাকলো, আপনার ফোন। ওর কথাতেই বুঝে ফেলেছি যেয়ে ধরলাম, হাজার মাইল দূর থেকে ইথারে ভেসে এলো আমার সেই পরিচিত কন্ঠস্বর। হ্যালো বলতেই যেন সেই পরিচিত গলার স্বরটা কেঁপে উঠলো বল্লো, কেমন আছো? সেই আবেগ মিশ্রিত স্বর। বল্লাম, কি বলবো- ভালো যে নাই তুমি তো বোঝাই, তোমার পৌঁছানোর সংবাদের জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম। পথে কোন সমস্যা হয়নি তো, তোমার ও খানের সব খবর বলো। বুলার স্বরটা স্বাভাবিক হয়ে এলো, বল্লো, ভালো মতো এসে পৌছেছি। পথে কোন সমস্যা হয়নি, পাশের সীটে এক মধ্যবয়সী মহিলা আমাকে যথেষ্ট সহযোগীতা করেছেন, আমার প্রথম বিমান ভ্রমণ শুনে আমার এমবার্গেশান কার্ডও ফিলাপ করে দিয়েছেন। বাবা’র হাতে তুলে দিয়ে উনি বিদায় নিলেন আমার কাছ থেকে। যাওয়ার সময় বাসার ঠিকানা ফোন নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ রাখতে বলেছেন, সেই সাথে বাবার ফোন নাম্বারও নিয়ে গেছেন। আমাকে পেয়ে বাবা খুবই উৎফুল্ল বাসায় যতক্ষন থাকেন আমাকেই সংগ দেন সেই সাথে বাসার সব কিছু বুঝিয়েও দিচ্ছেন, এতদিনে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। আমাকে নিয়েই ব্যাস্ত থাকেন সব সময়। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বাবা একা একা থেকে সব কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, রান্না করা, ঘর ভ্যাকুম করা, ওয়াশিং ম্যাশিনে কাপড় ধোয়া সব কিছু।

বিদেশে যারা থাকে তারা সবাই নাকি নিজেদের কাজ নিজেরাই করে নেয়। এর মাঝে দুই দিন বাবাই তার ষ্টোরে নিয়ে গিয়েছিলেন, আমাকে খুঁটিনাটি সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বাবা আমাকে নিয়ে সারাক্ষনই ব্যাস্ত থাকেন, সময় পেলেই গাড়িতে আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। বলেছেন আমাকে ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি করে দেবেন ড্রাইভিং শিখতে। তোমার এখানে আসার পর তুমি আমি সারাদিন এক সাথে ঘুরে বেড়াবো। বাবাকে পেয়ে বুলা নতুন পরিবেশে বেশ ভালো আছে বুঝলাম। ভালোই লাগলো যে আমার মতো একাকীত্ব বোধ করছে না। বুলা বল্লো, বাবার ষ্টোরটা মোটামুটি বড়, গ্রোসারী থেকে শুরু করে নানা রকম স্টেশনারী জিনিষও পাওয়া যায়। আমি ষ্টোর থেকেই কলিং কার্ড দিয়ে তোমাকে ফোন দিয়েছি। এখানে আসলে ভালো লাগে, সারাক্ষন মানুষ জনের মধ্যে থাকা যায়, অন্তত একা একা লাগে না। এখানে একজন মানুষেরই খুবই অভাব, একান্ত আপন জন, তোমার মতো সহানুভূতিশীল একজন মানুষের। একান্ত নিজের। তোমার সাথে থেকে কারো উপর নির্ভর করে যে স্বস্তিতে থাকা যায় সেটা বুঝেছি। ভরসা করার মত একজন মানুষের জীবনে খুবই প্রয়োজন। এখন বলো, ক্লাস ঠিক মতো করছো তো? ক্লাস পড়া শুনা ঠিক মতো করবে। মন খারাপ করে থাকবে না, আমি তোমাকে পনের দিন পর পর চিঠি লিখবো। তোমাকে আমি মুহূর্তর জন্যও মন থেকে আলাদা করে ভাবতে পারি না। তুমি আমাকে কথা দাও মন খারাপ করে ঘুরবে না। বন্ধুদের সাথে গল্প করলে মন ভালো থাকে, যতক্ষন সম্ভব সবার সাথে থাকবে। কোন দুশ্চিন্তা করবে না, আমি তো আছিই।

আবারো একটা কাজের দায়িত্ব দিই। যদিও জানি কিছু মনে করবে না – আমার অনার্স পরীক্ষার প্রভিশনাল সার্টিফিকেটের সারটিফায়েড কপি লাগবে ‘যেরেন্টোলজী’র কোর্সে ভর্তি হতে। প্রয়োজনে সীমার সাহায্য নিও। আমার যে কোন ব্যাপারে ও তোমাকে সাহায্য করবে। রেজিষ্টার অপিস থেকে সার্টিফিকেটটা এনে পাঠিয়ে দিও। আগামী চিঠিতে ঠিকানা দিয়ে দিবো। তোমাকে দেওয়ার জন্য সীমার কাছে একটা এনভেলাপ দিয়েছি ওর মধ্যে আমার একাউন্টের চেক বই আছে। তোমার নামে সবগুলো পাতা সই করা। আমার কাজের খরচের জন্য যা লাগে তুলে নিও। এগুলো তো আমার এখন আর কোন কাজেই লাগবে না। চেক বই ও তোমার কাছেই থাক। তুমি আর বাবা ছাড়া এই মুহূর্তে আমার আপন জন আর কেউই নাই।

যখন টাকা লাগে উঠিয়ে নিয়ে নেবে। তুমিই তো আমার এই এ্যাকাউন্টটা খুলে দিয়েছিলে। তোমার কাছে আমি এতো ঋণী যে সেটা বোঝানো যাবে না। সাতদিন পর আবার এই সময় ফোন করবো, তখন কথা হবে। পরীক্ষা দিয়েই কিন্তু তুমি চলে আসছো, এটা মনে রেখো। ফোন শেষ করে ঘরে এসে আবার শুয়ে পরলাম ছুটির দিন কোন কাজ নাই। ঠিক তার পরের দিনই ডিপার্টমেন্টের কড়িডোরে দেখা মিললো সীমার। আমার ক্লাস শেষের জন্য রুমের সামনে কড়িডোরে অপেক্ষা করছিলো এগিয়ে এসে বল্লো, ভাই কথা আছে। এগিয়ে গেলাম কড়িডোরের শেষ মাথায় একটু নির্জনে। এনভেলাপটা এগিয়ে দিয়ে বল্লো, বুলা এটা আপনাকে দিতে বলে গেছে।

ও আমার কাছে আপনার কথা অনেক বলেছে, আপনাকে নিয়ে ওর অনেক ভাবনা চিন্তা, অনেকখানি জড়িয়ে গেছে আপনার সাথে। অনেক বিশ্বাস করে ও আপনাকে, আপনারা সোনারগাঁও বেড়াতে গেছেন আমি জানতাম। আমাকে বলেই গিয়েছিল। নিজে একজন মেয়ে হিসাবে আমি বুঝি ও সত্যিই আপনাকে চেয়েছে। ও চলে যাওয়াতে আমরা কয়েকজন অনেক কষ্ট পেয়েছি। ও হলের ওর ব্যবহার্য সমস্ত জিনিষপত্র সবাইকে দিয়ে গেছে। অমন মানুষ পাওয়া যায় না। খুবই ভালো মনের একটা মানুষ। আপনাকে আমি দুই দিন খুঁজেছি, পাইনি। আপনি ঠিকমতো ক্লাস করেননি বুঝেছি আমি। আপনার মন খারাপ বুঝেছি।

বল্লাম, হ্যাঁ, মন ভালো না তাই আসিনি ঠিক মতো। কাল আমার সাথে ওর কথা হয়েছে। এখন ওর অনার্স পরীক্ষার প্রভিশনাল সার্টিফিকেট এর সার্টিফাইড কপি লাগবে, ওটা নোটারাইজ করে পাঠাতে হবে। তুমি আমাকে একটু সহযোগীতা করো। সীমা বল্লো, রেজিষ্টার অফিসে আমার এক পরিচিত লোক আছে, আমি কবে পাবো কি লাগবে সব জেনে আপনাকে জানাবো, প্রয়োজনে আপনাকে নিয়ে যাবো। আপনি একদম ভাববেন না। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ