ইউসুফ কামাল : দশ.
বিষয়টা কয়েকদিন ধরেই চোখে পড়েছে আজকাল আর সবাইকে একসাথে খুব একটা পাই না। সেদিন বিদ্যুতকে বিষয়টা জিজ্ঞাস করতেই সে আকর্ণ একটা হাসি দিয়ে বল্লো, তুমি কি বিষয়টা বোঝো নাই?

মাথা দিয়ে নেতিবাচক ভাব বোঝাতেই বল্লো, আই ই আর এ যাও দেখবে নাসিম সায়েমা বসে আছে, লাইব্রেরীতে যাও দেখবে পরাগ লাকী বসে আছে, মধু বেলা ডিপার্টমেন্ট কমন রুমে, আলম রোজীর খোঁজে জুয়োলজী ডিপার্টমেন্টে। বিষয়টা চোখের সামনে স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিস্কার হয়ে গেলো। আরে তাই তো সবাই তাহলে যার যার মতো জীবনের যোগ বিয়োগের হিসাব মেলাতে এখন থেকেই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে?

দুপুরের ক্লাশ শেষের আগে নাসিম বল্লো, ৩টায় আই ই আর কেন্টিনে কয়েকজন একত্রিত হবো চলে এসো। কথা আছে যে কতজনের পারো নিয়ে আসো। আলম লিটন বিদ্যুতকে নিয়ে গেলাম শরীফ মিয়ার ডেরায়। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি ভবনের সামনে মুখোমুখি দুটো দোকানের অনুমতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এই প্রান্তে রমজান আর ঐ প্রান্তে শরীফ মিয়ার দোকান। রমজান মিয়ার দোকানের কিশোর পেড্রু আবার বিদ্যুত এর দারুন ভক্ত। কেনো যেনো দুজনই দুজনকে খুব পছন্দ করতো। বখশিসের নামে এমনিতেই আধুলিটা সিকিটা অবলীলায় দিয়ে দিতে দেখতাম। চটপটে ছোট একটা ছেলে। আর ঐ কারণেই রমজানের দোকানেই বেশীরভাগ সময়ে চা খেতে হতো। ওর ডাকের মধ্যেই কেমন যেনো একটা মোহনীয়তা ছিলো। স্যার আইস্যা পড়েন।

মোটামুটি কবি সাহিত্যিকের ভীড় এ দিকটাই বেশি। মধুর কেন্টিনের রাজনীতির হুড়োহুড়ির থেকে কবি সাহিত্যিকেরা এই ভিন্নতর পরিবেশকেই যেনো বেছে নিয়েছিলো। মাঝে মাঝেই নির্মলেন্দু গুণ, শিহাব সরকার, আবিদ আজাদ আর রুদ্রের দীর্ঘ সময়ের আড্ডায় চাটনীর মতো রসদ জোগাতো শরীফ মিয়ার তেহারী আর লাল চা। সফদার সিদ্দিকীর অসংলগ্ন চালচলন ও কথাবার্তা তখনই বোঝা যেতো। পরে সে কোলকাতায় চলে যায় এবং কিছুদিন পর সে ওখানেই মারা যায়। সফদার সিদ্দিকিকে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মোটামুটি সবাই চিনতো। কবি ছাড়াও ছাত্রদের মধ্যে গায়ক ও অভিনেতাদেরও আড্ডা এখানেই জমতো। পিযুষ, আল মনসুর, মিতাসহ আরো বেশ কিছু উঠতি শিল্পীদের আনাগোনায় মুখরিত হতো লাইব্রেরি চত্বর।

টিনের চাল আর মুলিবাশের বেড়ার ভিতরে কয়েকটা চেয়ার দিয়ে বসার ব্যবস্থা। খুব কম পয়সায় তেহারী পাওয়া যেতো। এক টাকা প্লেট। তেহারী চা শেষ করে হাঁটা দিলাম নাসিমের সাথে দেখা করতে আই ই আর এ। সর্বসম্মতিক্রমে সবাই এক সিদ্ধান্তে আসলাম একটা সংকলন বের করতে হবে। বন্ধু স্বজন ছাড়াও পরিচিত মহলের কারো কারো লেখা থাকতে পারে।

পরের সপ্তায় যথারীতি সংকলনের নাম ও সাব্যস্ত হয়ে গেলো। নীলিমার নীলক্ষেত। নামের কৃতিত্ব অনেকটা নাসিমেরই বলা চলে। বন্ধুদের প্রেম, ভালোবাসা, অনুরাগের প্রতিশ্রæতি তেই যেন এ প্রয়াস….
নীলিমা আমাদের ভালোবাসা নীলক্ষেত আমাদের অভিবাস
নীলিমার নীলক্ষেত আমাদের গোপন অনুরাগের বিলম্বিত উচ্চারণ।

বন্ধু কবি শিহাব সরকার, বন্ধু আবিদ আজাদ, বন্ধু মাকিদ হায়দার ও নির্মলেন্দু গুণসহ আরো প্রায় পঁচিশ জনের কবিতা সংগ্রহ হয়ে গেলো। প্রচ্ছদের বিষয়ে ভিন্নধর্মি একটা সিদ্ধান্ত ছিলো সেটা হলো এক্সরে প্লেট দিতে করতে পারলে ভালো হয়। যুক্তি হলো এটা রিদয়ের এক্সরে তাই এক্সরে প্লেট দিতে পারলে সর্বোত্তোম। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে এতো প্লেট, অনেক ভেবে মনে হলো এ সিদ্ধান্ত থেকে হয়তো ফিরে আসতে হবে। শেষ মুহূর্তে আমার কাছে হতাশার কথাটা শুনে এগিয়ে এলেন মাহাবুব ভাই। আমাদের রাজবাড়ীর প্রায়াত বিশেষ বন্ধু ও বড় ভাই।

বিষয়টা উনাকে বলতেই হেসে বল্লেন, এটা কোনো বিষয়ই নয়। ত্বরিত গতিতে ১০০ টাকার বিনিময়ে হাসপাতালের বয়কে দিয়ে এক গাট্টি পুরনো এক্সরে প্লেট আনিয়ে দিলেন। স্বল্প সময়ে সমস্যার সমাধানে সবাই খুশী। যথাসময়ে সংকলন বেরিয়ে গেলো। মাহাবুব ভাইয়ের মতো একজন পরোপোকারী মানুষটিও কেনো যেনো খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই হারিয়ে গেছে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। সেই কষ্টটা এখনো মনের মধ্যে নাড়া দেয়। মানুষের সহজাত স্বভাবগুলো স্বযত্নে লালন করলেই মনে হয় একদিন সেগুলো বৃক্ষের মত ডাল লতা পাতায় শোভা দেয়। সেই ছাত্রাবস্থায়ের কবিতা প্রীতি নাসিমের যেন ধ্যান ধারণা। যেটা সে এখনো সযত্নে লালন করে চলেছে।

সেই আই ই আর এর প্রেমিক যুগল নাসিম সায়মা এখন পুত্রকন্যা নিয়ে আমেরিকার বোস্টনের স্থায়ী বাসিন্দা। সেখানে তার পরিচয় বাঙালি কবি। অবশ্য কবিতার সাইজ অনেক ছোট ছোট হওয়াতে আমরা তাকে অনেক সময় মিনি কবিতার কবি বলেও সম্বোধন করি।
বছর তিনেক আগে এক পড়ন্ত দুপুরে উত্তরার বাসা থেকে রাজবাড়ী রওনা হলাম। বিশমাইল হয়ে বাম দিয়ে আরিচার রাস্তায় উঠবো। বিশমাইল এসে হঠাত করেই মান্নানের কথা মনে হলো। কতদিন মনে করেছি একটু দেখা করে যাবো কেমন আছে মান্নান মমতা। ড্রাইভারকে বল্লাম একটা চা’র দোকানে দাঁড়াতে, ওখানেই সম্ভবত ওদের খবর পাবো। অমর আমার ড্রাইভার একটা চারা কাঁঠাল গাছের পাশে ছায়ায় গাড়িটা রাখলো। ছোট্ট একটা দোকান মুলত: চা সিগ্রেট পাওয়া যায় বুঝলাম। শহরতলীর দোকানে এই সময়েও ৭/৮ জন মানুষ বসে আছে। দোকানীকে দুই কাপ চা দিতে বলে বল্লাম, ‘ভাই দেওয়ান মান্নানকে কোথায় পাবো বলতে পারেন’? আমার কথায় যেন হঠাত করেই সবার মধ্যে একটা ছন্দপতন হয়ে গেলো। সবার চুপ করে যাওয়াটা কেমন যেন একটু বেমানান মনে হলো। দোকানীর চা বানানোটাও হঠাত করে থেমে গেলো। আমার মুখের দিয়ে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো, স্যার আপনি কি আমাদের স্যারের বন্ধু ছিলেন? চমকে উঠলাম প্রশ্নে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, ও কোথায়? দোকানের সবাই আমার মুখের দিকে উত্সুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নিজেকে কেমন যেন ভিন্নতর মনে হতে লাগলো। চায়ের কাপটা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বল্লো, মান্নান স্যার গত সপ্তাহে মারা গেছেন, পরশু দিনে উনার কবর হয়েছে এখানে উনাদের পারিবারিক গোরস্থানে। চায়ের কাপ মুখের কাছে নিয়েও আবার ফিরিয়ে নিলাম। হতভম্ভের মতো জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছিলো ওর?

গত মাসে মেয়ের কাছে কানাডায় বেড়াতে গিয়েছিলো। ওখানেই হার্ট এ্যাটাক করে, পরে হাসপাতালে মারা যায়। পরশুদিন প্লেনে ডেড বডি আসে আর ঐ দিনই আছর বাদ জানাজা শেষ করে কবর দেওয়া হয়। শরীরটা শিরশির করে উঠলো। কি শুনলাম, প্রাণোচ্ছল একটা মানুষ হঠাত মনে হলো আমার চোখের সামনে থেকে নাই হয়ে গেলো।
খুব আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে চায়ের অর্ধেকটা শেষ করে কাপ নামিয়ে রাখলাম। আর ইচ্ছে করল না খেতে। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিলো, এই পথেই প্রায়ই যাই – একদিন আসলেই তো দেখা হতো। প্রচন্ড একটা অপরাধ বোধ আমার ভিতরে কাজ করতে শুরু করলো। নিজেকে সত্যিই অপরাধী মনে হতে শুরু করলো।

যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে টাকা বের করে চায়ের দাম দিতে গেলাম। নিলো না, বল্লো স্যার লাগবে না। দোকানীর কথায় যেন সম্বিত ফিরে পেলাম, স্যার আপনি আমার ‘বস’ এর বন্ধু। আপনাকে আমি আমার বসের পক্ষ থেকে সামান্য আপ্যায়ন করলাম। চোখটা ভারী হয়ে এলো মনিবের প্রতি ভালোবাসা দেখে। কষ্ট করে মনটা সংযত করলাম। জয়নাল নিজের থেকেই বলে ফেল্লো, আমি ছোটবেলা থেকেই ‘বসের’ কাছে মানুষ। এ দোকানটা উনিই করে দিয়েছিলেন। ছাত্রাবস্থহায় ঢাকা থেকে ফিরেই আমাকে মোটর সাইকেল দিয়ে বলতেন ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে রাখবি। একটু পরেই বেরোবো।
ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। অমর গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে সদর রাস্তায় নিয়ে এলো। এই এলাকারই মানুষ মান্নান। এখানেই জন্ম, এখানেই বেড়ে উঠেছে আবার এখানের মাটিতেই অনন্ত কালের জন্য ঘুমিয়ে থাকলো।

মাঝে মাঝে ভাবি এ জীবন কি আসলেই ছোটো কেউ কি কখনো ভাবতে পারে কখন কার জীবনের পরিসমাপ্তি চলে আসবে? জানলে না হয় সাজিয়ে গুছিয়ে প্রতিটা কাজ শুরু ও শেষ করা যেতো যাতে পরে আর ক্ষোভ দু:খ কষ্ট না থাকে। মনে মনে বল্লাম, হে দয়াময় তুমি সবার জীবনে একটা সুন্দরতম পরিসমাপ্তি দিয়ো।
গাড়ির ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরটা যেন নিস্তেজ হয়ে গেলা। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। মনে পড়লো কালো রংয়ের একটা মোটর বাইকে করে ঘুরে বেড়াতো মান্নান মমতাকে সাথে নিয়ে আর মুখামুখি হলেই একটা সলজ্জ হাসি দিয়ে চলে যেতো।
স্মৃতি তুমি সত্যিই বেদনাময়। মান্নান ইতিহাসের এখানেই সমাপ্তি। (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, উডব্রীজ, ভার্জিনিয়া, আমেরিকা