ফরিদ আহমেদ : ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে ক্রাকডাউনে নামে পাকিস্তান আর্মি। মধ্যরাতের পরেই দেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর বাসভবন থেকে বন্দি করে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের বেশিরভাগই দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেন ভারতে।

এই নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ভারতে গঠিত প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। সদ্য স্বাধীন ঘোষিত দেশটার মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করতে হয়েছে তাঁকে। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সকলের সাহায্য, সহযোগিতা এবং আনুগত্য প্রয়োজন ছিলো তাঁর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তিনি সেটা পাননি।

দলীয় নেতৃত্বের অনেকেই মনে করতেন তাঁরাই আসলে প্রধানমন্ত্রী হবার যোগ্য, তাজউদ্দীন আহমদ না। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খন্দকার মোশতাক এবং মিজানুর রহমান চৌধুরী। এর বাইরেও অধ্যাপক ইউসুফ আলী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, জহুর আহমেদ চৌধুরীরাও তাঁর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এতো সব প্রতিপক্ষ, সমালোচনা সহ্য করেও তাঁকে তাঁর কাজ করে যেতে হয়েছে।

তবে, এঁরা নয়, তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ মণি এবং ছাত্রলীগের নেতারা। শেখ মণি কোলকাতা গিয়েই তাজউদ্দীন আহমদকে প্রতারক হিসাবে সাব্যস্ত করেছিলেন। তাঁর দাবি ছিলো, শেখ মুজিবকে নিয়েই ভারতে আসার কথা ছিলো তাজউদ্দীন আহমদের। এজন্য সুটকেস রেডি করে শেখ মুজিব অপেক্ষা করছিলেন তাঁর ধানমন্ডির বাসায়। কিন্তু, নিজে প্রধানমন্ত্রী হবেন, এই লোভে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে ফেলে রেখে একা চলে আসেন ভারতে। তাজউদ্দীন একজন প্রতারক, প্রবাসী সরকার গঠনের বৈধতা তাঁর নেই।

শেখ মণি এবং তাঁর দলবলের এই অভিযোগের প্রতি ভারত সরকার কোনো কর্ণপাত করেনি। তারা তাজউদ্দীন আহমদকেই বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে নিয়েছিলো। ভারত মেনে নিলেও, শেখ মণিরা এটাকে মেনে নিতে পারেননি। তাজউদ্দীনকে যতো ধরনের যন্ত্রণা দেওয়া সম্ভব, তার সবই তাঁরা দিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁকে অপসারণের নানা প্রচেষ্টাও চালিয়েছিলেন তাঁরা। বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে দেরাদুনে আলাদা করে মুজিববাহিনী নামে একটা মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীও গড়ে তোলেন তাঁরা। শেখ মণির সাথে সিরাজুল আলম খান, আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ জড়িত ছিলেন এই কাজে।

প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাজউদ্দিন আহমেদ এঁদের শ্রদ্ধা, সম্মান এবং সহযোগিতা তো পানই নি, বরং পদে পদে তাঁরা চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাঁকে অপমান, অবমাননা এবং অপদস্থ করার।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদে বিজয়ী হয়েছিলেন এম, এ, মোহাইমেন। যুদ্ধ শুরু হবার পরেই সীমান্ত অতিক্রম করে কোলকাতায় চলে যান তিনি। মুজিবনগর সরকারকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘ঢাকা আগরতলা মুজিবনগর’ নামে একটা বইও লিখেছেন। সেই বইতে এ’রকম একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন,
“মুজিব বাহিনীর নেতারা তাজউদ্দিন সাহেবকে ভারত সরকার, আওয়ামী লীগ কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সর্বদা হেয় প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করতো। মাঝে মাঝে টাকা-পয়সা, যানবাহন ও বিভিন্ন ধরনের অন্যায় সুযোগ-সুবিধাই যে শুধু দাবী করতো তাই নয়, অনেক সময় ভারতীয় অফিসারদের সামনে তাঁকে লাঞ্ছিত করতেও দ্বিধা করতো না। একদিনের কথা আমার মনে আছে। সন্ধ্যার পর আমি ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে গেলাম তাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে দেখি দোতলার সিঁড়ির গোড়ায় তিনি দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপছেন। তাঁর অনতিদূরে ছাত্রলীগের এক প্রভাবশালী নেতা দাঁড়িয়ে। ইনি বর্তমানে টাঙ্গাইলের জাসদের একজন বিশিষ্ট নেতা ও সংসদ সদস্য। তাজউদ্দিন সাহেব ক্রুদ্ধ স্বরে বলছেন, আমি দিতে পারব না। আর ছাত্রনেতাটি বলছে, আপনাকে দিতেই হবে- আপনি না দেওয়ার কে? আপনি তো একজন ইমপস্টার প্রতারক। তখন তাজউদ্দিন সাহেব রেগে গিয়ে বললেন, ইউ গেট আউট ফ্রম হিয়ার। ছাত্রনেতাটি প্রত্যুত্তরে বললো, হোয়াই শুড আই গেট আউট, ইউ বেটার গেট আউট। এসময় ভারতীয় প্রধান সিকিউরিটি অফিসার, নিরাপত্তা ও অন্যান্য ব্যাপারে নিয়োজিত অফিসার, সিকিউরিটি গার্ড সব মিলিয়ে আট-দশ জন লোক অবাক বিস্ময়ে ঘটনা অবলোকন করছিল। একটা স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর দেশের একজন ছাত্রনেতা বলছে বেরিয়ে যাও। অকল্পনীয় ব্যাপার। এতগুলো বিদেশী লোকের সামনে নিজেদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অপদস্থ হতে দেখে লজ্জায় আমি মুখ তুলতে পারছিলাম না। আমি ভয় করছিলাম চার খলিফার এক খলিফা এই নেতার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হাতাহাতি না হয়ে যায়।”

ছাত্রলীগের এইসব নেতারা দেশের সেই ক্রান্তিকালে কতোখানি সততা নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে আর কতোখানি মৌজ মাস্তিতে মেতেছে, সেটা এক গবেষণার বিষয়। এরা শিয়ালদহ ও হ্যারিসন রোড এলাকার টাওয়ার হোটেল, টাওয়ার লজ, ইন্ডিয়া হোটেল, প্রেসিডেন্সি হোটেলে থাকতো। খরচ বহন করতো প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। স্বেচ্ছায় যতোখানি না, তার চেয়ে বেশি চাপে পড়ে দিতে বাধ্য হতো। এরা তাদের মাস্তানি বিদেশের মাটিতে গিয়েও অব্যাহত রেখেছিলো।

এম, এ, মোহাইমেনের বই থেকেই উদ্ধৃতি দেই। তিনি আরও লিখেছেন,
“বেশ খানিকক্ষণ পর তাঁর কামরায় গিয়ে ব্যাপার কি জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, এরা যখন তখন এসে বলবে টাকা দিন। আলাদা ফান্ড থেকে এদেরকে রীতিমত মাসোহারা দেওয়া হয় হাত-খরচ হিসাবে। এরা অধিকাংশই হোটেলে থাকে এবং হোটেলে থাকা-খাওয়ার খরচ বাংলাদেশ সরকার বহন করে। হাতখরচ হিসাবে যা দেওয়া হয় মাসের জন্য তা যথেষ্ট। তার উপর প্রায়ই আমার নিকট টাকা চেয়ে বসে এবং মাঝে মাঝে আমাকে কিছু দিতে হয়। এই ছেলেটিকে মাত্র কয়েকদিন আগে ১০০ টাকা দিয়েছি, আজ আবার এসে টাকা চাওয়ায় আমি দিতে অস্বীকার করায় কি ব্যবহার করলো নিজের চোখেই তা দেখলেন। বিদেশী এতোগুলি লোকের সামনে অপদস্থ হওয়ায় তাঁর মনে খুবই লেগেছিল। তিনি খুব ধীর-স্থির মানুষ, ভাবাবেগে সহজে বিচলিত হন না। কিন্তু, আজ দেখলাম আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করছিলেন। তাঁর বোধ হয় অপমানে কান্না পাচ্ছিল। তিনি অনেক চেষ্টায় গলা পরিষ্কার করে আমাকে বললেন, এ ভার আমি আর বইতে পারছি না। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি শেখ সাহেব যতশীঘ্র হয় ফিরে আসুক। তাঁর হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি নিষ্কৃতি পেতে চাই।”

শুধু বিরোধিতা এবং বিরুদ্ধ প্রচার-প্রচারণা করেই ক্ষান্ত ছিলেন না শেখ মণি এবং তাঁর দলবল। তাজউদ্দীন আহমদের প্রাণনাশের চেষ্টাও শেখ মণি করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ছিলেন ফারুক আজিজ খান। তিনি তাঁর ‘স্প্রিং ১৯৭১’ বইতে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন,
“প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় হুমকি ছিলেন শেখ মুজিবের ভাগনে শেখ মণি । বয়সে তরুণ হলেও অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে হিসেবে নির্বাসিত সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার কেবল তাঁরই আছে। মণি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর জীবনের উপর হুমকি তৈরি করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রাণনাশের জন্য একজন সশস্ত্র তরুণকে পাঠানো হয়েছিল। সে অবশ্য এসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।”
মঈদুল হোসেনও তাঁর বই ‘মূলধারা ৭১’ এ একই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী,
“মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসাবে পরিচয়দানকারী এক যুবক আগ্নেয়াস্ত্রসহ সহসা একদিন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে হাজির হয়ে জানায় যে, তাদের এক নেতা তাজউদ্দীনের প্রাণ সংহারের প্রয়োজন উল্লেখ করা মাত্র স্বেচ্ছায় সে এই দায়িত্ব নিয়ে সেখানে এসেছে, যাতে তাজউদ্দীনের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়। তাজউদ্দিন তখন অফিসে সম্পূর্ণ একা। তাজউদ্দিন কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হয়ে এই যুবক তাঁকে আরও জানায় যে, এ বিষয়ে সে পূর্ণ স্বীকারোক্তি করার জন্য প্রস্তুত এবং কৃত অপরাধের জন্য কর্তৃপক্ষ যদি তার কোন শাস্তি বিধান করেনও, তবু তাতে তার কোন আপত্তি নেই। তাজউদ্দিন আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদের পর অস্ত্র-সমেত যুবকটিকে বিদায় দেন। সেই সময় ‘মুজিব বাহিনী’র বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কোন কোন ইউনিটের এবং আওয়ামী লীগের একাংশের ক্ষোভ ও বিদ্বেষ এতই প্রবল ছিল যে, এই ঘটনা প্রকাশের পর পাছে কোন রক্তক্ষয়ী সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে, তা রোধ করার জন্য তাজউদ্দিন ব্যাপারটিকে সম্পূর্ণ গোপন করেন। কিন্তু সম্ভবত এই ঘটনার পরেই তাজউদ্দিন মনস্থির করেন ‘মুজিব বাহিনী’র স্বতন্ত্র কমান্ড রক্ষার জন্য জঅড -এর প্রশাসনিক প্রয়াসকে নিষ্ক্রিয় করা এবং এই বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে চূড়ান্ত চাপ প্রয়োগের সময় সমুপস্থিত।”

এই তরুণ আত্মসমর্পণ না করে তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যা করতে সামর্থ্য হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন যে ধ্বংস হয়ে যেতো সেটা বলার জন্য খুব বড় বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। যাঁরা ওই সময়কার ইতিহাস গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন, তাঁরা জানেন তাজউদ্দীন আহমদের মতো অমন নিবেদিতপ্রাণ হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য আর কেউ-ই কাজ করেননি।
একটা দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে শুধুমাত্র দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা তাজউদ্দীনকে কঠোর পরিশ্রম করতেই হয়নি, এইসব গুণ্ডা-পাণ্ডা, মাস্তানদের হাতে অপমানিতও হতে হয়েছে নিয়মিত। সেই অপমানের কান্নাকে নিভৃতে লুকিয়ে রেখে হিরণ্ময় এই মানুষটা নীরবে কাজ করে গিয়েছেন আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, আমাদেরকে এক খণ্ড স্বাধীন ভ‚খণ্ড পাইয়ে দেবার জন্য।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন আহমদ সব ষড়যন্ত্র ভেদ করে স্বাধীনতার তরীকে তীরে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁর প্রতি কিছু মানুষের হিংসা-বিদ্বেষকে দূরীভ‚ত করতে পারেননি। দেশ স্বাধীন হবার পরেও তাঁর বিপক্ষে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালের ২৬শে অক্টোবর অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

রাজনৈতিকভাবে এই দিনে হত্যা করা হয় তাঁকে। আর, এর ঠিক এক বছরের মাথায় শারীরিক মৃত্যু ঘটানোয় হয় তাঁর।