ভজন সরকার : (১)
পাশ্চাত্য ও প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের একটি আশ্চর্য মিল আছে; তা হ’ল উপাখ্যানের নায়কেরা অতি উন্নত ঐশ্বর্যময় অবস্থা থেকে নিদারুণ দুঃখে পতিত হন এবং অত্যন্ত গ্লানির মধ্যে অন্তিমযাত্রা করেন।
আর উপাখ্যানের নায়ক চিহ্নিত করার একটি সমাধানসূত্রও এটি।
তাই দেখা যায় মহাভারতে যুধিষ্ঠিরই নায়ক। কেননা, মহাভারতের মহাপ্রস্থান ভাগে চার পান্ডব ভ্রাতা আর দ্রৌপদীর পতন ও মৃত্যু হয় এবং যুধিষ্ঠির নিঃসংগ অবস্থায় একাকী অন্তিমযাত্রায় গমন করেন।

রামায়ণে রামেরও একই পরিণতি। সীতার পাতালে প্রবেশ ও লক্ষণের সরযূর জলে দেহ বিসর্জনের পরে কিন্তু রামকে একাকীত্বের অভিশাপের মধ্যে দিয়েই বৈকুন্ঠে গমন করতে হয়েছিল।

একই ভাবে পাশ্চাত্য সাহিত্যে ট্রাজেডির মহাসমাবেশ হলো “The Monk’s Tale”; লিখেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের জনক “Geoffrey Chaucer (1343-1400 A.D)”। সেখানেও খুব সুন্দর একটি সংজ্ঞা আছে মধ্যযুগীয় ইংরেজিতে লেখা। আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি এখানে :
Tragedie is to seyn a certyn storie,
As olde books maken us memorie,
of hym that stood in great prosperitie
And is yfallen out of high degree,
Into myserie , and endeth wrechedly.

ইতিহাসের নায়ক-খলনায়কেরা কিন্তু এ সাহিত্যপাঠ থেকে বিন্দুমাত্র শিক্ষা নেয়নি। তারা বারবার নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতা দিয়ে অন্যকে নায়ক বানিয়ে দিয়েছ। নিজেরাও ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।

(২)
ইতিহাসের এবং মহাকাব্যের কথা যখন আসলো তখন দেখা যাক যুগে যুগে মহাকাব্যের চরিত্রগুলো চিত্রায়ণ হয়েছে কিভাবে? কিভাবে মানুষ ক্রমে ক্রমে নিজকে ছোট করে দেবতাকেই বড় করেছে?
অনেকেই বলেন মহাভারত মহাকাব্য হিসেবে পৃথিবীর আর সমস্ত মহাকাব্যের বহু ঊর্ধ্বে। অনেক পণ্ডিত বিষয়গাম্ভীর্য, বর্ণনাশৈলী, চরিত্রসৃষ্টিসহ নানা কাব্যবিচারে মহাভারতের পরেই ইলিয়াড, অডিসি, রামায়ণ, প্যারাডাইস লস্ট, রঘুবংশ, নিবেলুংগেনলিড (জার্মান) কিংবা গিলগামেশ (সুমেরীয়) অথবা স্ক্যান্ডেনেভিয়ার গদ্য এড্ডা- কে স্থান দিয়ে থাকেন।

অথচ মহাভারতের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ শ্লোক (প্রায় পঁচিশ হাজারের মতো) কাব্যবিচারে উৎকর্ষ। বাকী দুই-তৃতীয়াংশের কাব্যমূল্য নিতান্তই সাধারণ।
এই এক-তৃতীয়াংশে আছে ক্ষত্রিয়কাহিনি এবং চিরন্তন নৈতিককাহিনি। পন্ডিতেরা বলেন এই অংশটুকুই রচিত হয়েছিল প্রায় দুই/তিন শত বছর ধরে ( খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক)। আর এখানেই আছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কাহিনি ও নীতিকথা। মহাভারতের যা মাহাত্ম তা বর্ণিত হয়েছে এ অংশেই।

মহাভারতের বাকী যে অংশ (রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক), যা ব্রাহ্মণ্য সংযোজন নামে পরিচিত, সেখানে কিছু উপাখ্যান যেমন নল-দময়ন্তী, সাবিত্রী-সত্যবান, রামোপাখ্যান, শকুন্তলা ইত্যাদি বাদ দিলে অন্যত্র ছড়িয়ে আছে দেবতার মহিমা, তীর্থমাহাত্ম্য, পতিব্রতাধর্ম, ব্রাহ্মণ্য মহিমাকীর্তণ কিংবা কা’কে তুষ্ট করলে ইহলোক-পরলোকে কি রকম সুখস্বাচ্ছন্দ্য হবে সে বর্ণনা।
“সাহিত্য বিচারে এ অংশের রচনা নিকৃষ্ট” কিন্তু পরবর্তীতে সমাজের ব্রাহ্মণ্য প্রাধান্যের জন্য এ অংশটুকুই পুরাণ সাহিত্য হিসেবে পরিচিত হয়ে এসেছে।
অথচ ক্ষত্রিয়কাহিনি পর্বের সবখানেই যেন মনুষ্যত্বের জয়গান। এমন কথাও আছে, “মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর আর কিছুই নেই”।

দুই হাজার বছর আগে ভারতবর্ষের এক কাব্যকাহিনিতে বলা হয়েছিল, মানুষ কিভাবে গøানি-ক্লেদ ত্যাগ করে আপন অন্তরের তেজে ও বীরত্বে দেবতা হয়ে উঠে সে কাহিনি।
মনে হয় সে কারণেই অদ্যাবধি মহাভারতকেই বলা হয় পৃথিবীর মহাকাব্যের বিচারে শ্রেষ্ঠতম। অথচ সে মহাভারতের উৎসস্থলেই মানুষ ক্রমেক্রমে নিজকে ছোট করে দেবতাকেই সামনে এনেছে।

মানুষকে বড় করে তোলার সুযোগ প্রাচীন ভারত পেয়েছে। বর্তমান ভারতও পেয়েছে। পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশ, তার নাম বাংলাদেশ। কিন্ত সে সুযোগ এই উপমহাদেশ কোনোদিনই গ্রহন করেনি। বরং এই উপমহাদেশ ছাড়িয়ে বহুদূরের সংস্কৃতিকেই অলৌকিক বিশ্বাসে বুকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেছে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ময়ূরপেখম ছেড়ে ডানায় নিতে চেষ্টা করেছে বকপুচ্ছ। সে চেষ্টা অব্যহত আছে এখনো।
ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। কেউ নিয়েছে কি? নেয়নি ব’লেই যুগেযুগে সৃষ্টি হয়েছে ট্রাজেডির নায়ক কিংবা নায়িকা -কখনো ব্যক্তিমানুষ, কখনো গোটা দেশ কিংবা জাতি।

(৩)
বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রের মধ্যে অন্যতম “আগন্তুক” চলচ্চিত্রটি। “আগন্তুক”-কের মূলচরিত্র মনোমোহন মিত্রকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,” আপনি ধর্ম বিশ্বাস করেন?”
মনোমোহন মিত্রের উত্তর ছিল এ রকম,
“যা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, আমি তা বিশ্বাস করি না। আর প্রচলিত ধর্ম তা করেই, ফলে আমি ধর্মও বিশ্বাস করি না”।

পরক্ষণেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “আর ঈশ্বর?”। মনোমোহন মিত্র যা বলেছিলেন তার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় এ রকম যে,
“এই পৃথিবীতে এতো বিভেদ- এতো বৈষম্য; একদিকে প্রযুক্তির এতো অভাবনীয় উন্নতি-অন্যদিকে অসংখ্য মানুষের এতো কষ্টকর জীবন। এইসব দেখে দেখে পরম করুণাময় ঈশ্বরের প্রতিও বিশ্বাস রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে”।
পৃথিবীতে যত রক্তপাত, যত মানবতার অবমাননা হয়েছে, প্রায় সব কিছুর পেছনেই ছিল প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের বিভাজন। তাই ধর্ম আর সে প্রচলিত ধর্মকে মহান করার গালভরা বিশেষণ–সাম্য,শান্তি, অহিংসা; এবং ঈশ্বর- সব কিছুই আসলে মেকি—- শোষণ, শাসন, বিভাজন আর অত্যাচার করার নির্মম অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়?

অথচ ধর্মের মাধ্যমে বিভাজন আর মানবতার চূড়ান্ত পরাজয়ের উপাখ্যান হাতে হাত ধরে চলেছে যুগ যুগ ধরে। এই চলমান ট্র্যাজেডির অন্য নাম ইতিহাস। আর এই ইতিহাসই আমাদের ট্র্যাজিক জীবনের গল্প।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হামিল্টন, ওন্টারিও)