মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

আটত্রিশ.
আমার এই সব কাজকর্মের কারণে কানাডিয়ান পার্কস এন্ড ওয়াইল্ডারনেস সোসাইটি (সিপিএডব্লিউএস) তাদের উত্তর পশ্চিম টেরিটরির নাহান্নী ন্যাশনাল পার্ক রিজার্ভ’কে রক্ষা করার জন্য আমাকে ‘নাহান্নী ফরএভার’ প্রচারণার সামনের সারিতে নিয়ে এসেছিল। বেশ কয়েকজন পরিবেশবাদী আর সাংবাদিকের সাথে নাহান্নী নদীর মোহনায় এক ডিংগী নৌকার সফরের পর আমি সারা দেশ ঘুরে সিপিএডবিøউএস এর প্রচারণার জন্য বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছিলাম।

সত্যি কথা বলতে কি, সেই সময় আমি যুব সমাজের জন্য অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পরিবেশ বিষয়ক বেশ কিছু কনফারেন্স এ বক্তৃতা দেবার জন্য বারে বারে ডাক পাচ্ছিলাম। যদিও আমার জীবনের শিক্ষা ও ‘কাতিমাভিক’ এ ওতপ্রোতভাবে কাজ করার ফলে এই বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা আমি বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করতে পেরেছিলাম এবং এসব বিষয়ে কথা বলাটা আমার ভালোই লাগতো, কিন্তু তারপরও আমার মনে হয়েছিল এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ বিষয়ে আমার আরো গভীর জ্ঞান নেয়া প্রয়োজন। ফলে ২০০৫ এর শরতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আমাকে আবার পড়াশুনায় ফিরে যেতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত থেকেই আমি ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ ভূগোলের স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হয়ে গেলাম।
সেই শরতেই আমি এক ‘স্পিকিং এজেন্সী’র শরণাপন্ন হলাম যাতে এই যে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলার জন্য আমার কাছে যে পরিমাণ অনুরোধ আসছে সেটার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য তারা যেন আমাকে সহযোগিতা করে। এই বক্তৃতা দেবার জন্য অর্থ নেয়ার ব্যাপারে আমি ঘোরতর বিরোধী ছিলাম, কিন্তু সেগুলোর যথার্থ আয়োজন, ব্যবস্থাপনা ও কিছু জিনিসপত্রের জন্য আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন পড়তো। সেই সময় আমি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম, সাধারণ মানুষের সামনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলার ক্ষমতা কত বেশী ক্ষমতাধর হতে পারে, বিশেষ করে কোনো ভালো কাজে তহবিল সংগ্রহের সময় এটা খুব ভালোভাবেই বুঝা যেতো। একজন ভালো বক্তার জন্য সহজেই একটা ঘর মানুষে ভরে ওঠে আর যে কোনো সেবামূলক কাজের জন্য নিমিষেই প্রচুর টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। আর স্পন্সররা যখন দেখে এমন কোনো অনুষ্ঠানে প্রচুর মানুষের সমাগম হচ্ছে, তখন তারা আরো বেশি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। সেই সাথে একজন ভালো আর জ্ঞানী বক্তা যে কোনো পেশাগত কনফারেন্সকে সফল করার জন্য যেসব তথ্য উপাত্ত সবার সামনে উপাস্থাপন করে তা থেকে উপস্থিত সবাই তাদের জানার জগতটাকে বাড়িয়ে নিতে পারে। অনেক কনফারেন্সেই ভালো এক বক্তাকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টা সেই আয়োজনের খাওয়া দাওয়া, হল ভাড়া অথবা সংগীতের ব্যবস্থা করার মত খরচের একটা খাত হিসেবেই ধরা হয়।

অবশ্যই মানুষ আর সমাজের মঙ্গল চিন্তা করেই আমি কোনো সম্মানী ছাড়াই আমার এই বক্তৃতা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার এই বক্তৃতা পর্বটা শুরু হয়েছিল সেই ‘কাতিমাভিক’ থেকে শীতকালীন খেলাধুলার নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা তৈরী করা আর নাহান্নী’কে রক্ষা করা মাধ্যমে। এটা আমার কাছে পরম এক আনন্দ আর দায়িত্ব বলে মনে হতো। ফলে যখনই সময় সুযোগ আসতো, তখনই আমি সারা দেশ ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম, ঐ দিনগুলোতে যখন কোনো শহরের কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে কোনো অনুষ্ঠানে যেতাম তখন আমি প্রায়ই স্থানীয় স্কুলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতাম এবং স্কুল কর্তপক্ষ প্রায়ই আমাকে বিনা পয়সায় ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান করতে অনুরোধ করতো, আমি কখনো তাদের সেই আহ্বানকে অসম্মান করিনি, আমি সব সময় সানন্দে তাদের প্রস্তাবে রাজি হতাম। সত্যি বলতে কি, আমি ঐ ধরনের কাজে প্রচুর আনন্দ পেতাম।

আমি সারা দেশ ঘুরে ঘুরে যুব সমাজের সাথে যত বেশি কথা বলতাম, আমি তত বেশি বিভিন্ন সমস্যা দূর করার কাজে নিজেকে একেবারে লীন করে দিতাম আর সেই সমস্যার মূল কারণ অনুধাবনের চেষ্টা চালাতাম। এমন কাজে নিজেকে জড়িত করে আর যুব সমাজের সাথে মতের আদান প্রদান করে আমি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলাম, যুবকরা যে সব বিষয় নিয়ে বেশি চিন্তা করে তা হচ্ছে, শিক্ষা, পরিবেশ আর তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ। তারা চাইতো, এই বিষয়গুলো সবার সামনে গুরুত্বের সাথে উঠে আসুক। সেই সময় আমি এটাও উপলব্ধি করছিলাম, নতুন প্রজন্মের কাজ কর্ম আর চিন্তা চেতনায় একটা ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। আর আমার এটাও ভাবনায় এসেছিল, এই পরিবর্তন চিন্তার মধ্যে একটা নতুন সম্ভাবনার ইংগিত আছে। এমন এক অবস্থা আর পরিবেশের মধ্য দিয়ে এগুতে গিয়েই আমার মাথায় প্রথম রাজনীতির চিন্তাটা এসেছিল।

২০০৬ এর জানুয়ারির নির্বাচনে লিবারেল পার্টি হেরে গেলে নেতৃত্বের আসন থেকে পল মার্টিন’কে সরে যেতে হয়, এবং সেই বসন্তের মধ্যেই লিবারেল পার্টির শীর্ষ নেতা হবার দৌড়ে এগার জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেন। আমি সেই নেতৃত্বের দৌড়ে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, কিন্তু আমার তখন মনে হয়েছিল পরিবেশ ও যুবসমাজ নিয়ে আমি দেশ জুড়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়ে যে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করেছি, সেগুলো লিবারেল পার্টির নেতাদের ভালোভাবে জানানো প্রয়োজন। সেই সাথে লিবারেল পার্টিকে ঢেলে সাজানোর কাজে আমি লাগতে পারি। আমি বিষয়টা নিয়ে সোফির সাথে আলোচনা করি, কারণ আমার মনে হয়েছিল, এ কাজটা খুব সহজ নয়, আর সুদূরপ্রসারী এক ফলের জন্য আমাকে অনেক পথ হাঁটতে হবে। সোফির সাথে কথা বলে আমরা দুজনে মিলে ঠিক করলাম, পথ যতই বন্ধুর হোক না কেনো, এই পথেই আমাকে হাঁটতে হবে। লিবারেল পার্টির এই দুঃসময়ে অবশ্যই আমার করার কিছু আছে। আমার এই তাড়িত করা ভাবনা থেকে আমার এই জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে লিবারেল পার্টিকে ভালোভাবে সংগঠিত করার কাজে লেগে গেলাম।

আমি জানতাম না, আমি কোথায় থেকে শুরু করবো। আমি টম এক্সওর্দী সম্পর্কে অনেক শুনেছিলাম, সেই সাথে বিগত বছরগুলোতে তাঁর সম্পর্কে আমি কিছুটা জেনেওছিলাম, কারণ তিনি ছিলেন আমার বাবার একজন অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা। লিবারেল পার্টিকে নতুনভাবে সাজানোর জন্য যে কমিশন গঠন করা হয়েছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। আমি তাঁর সাথে দেখা করে যুব সমাজ নিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা আর আমি কী করতে চাই তা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছিলাম। পার্টির নেতৃত্বে কে আসবে সে সিদ্ধান্ত তখন প্রায়ই হয়ে গিয়েছিল, তবে অনেকেই চাচ্ছিল, দলের মধ্য নতুন চিন্তা চেতনা আর সময়ের উপযোগী নীতি আর নেতা মনোনীত করতে যাতে দলকে পুরো নতুন ও প্রত্যাশিতভাবে ঢেলে সাজানো যায়।

যুব সমাজের অনুষ্ঠানে যৌবনে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো

সেই গ্রীষ্মে আমি এবং আমার সহকর্মীরা সারা দেশ চষে বেড়াতে লাগলাম। আমরা এই ঘুরে ঘুরে রাজনীতি, বিশেষ করে লিবারেল পার্টির প্রতি যুব সমাজের কি ধরনের দৃষ্টিভংগী সেটা জানার চেষ্টা করছিলাম। সে সময় আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল, সারা দেশ ঘুরে যুব স¤প্রদায়ের মতামতগুলো ভালোভাবে জেনে সেই কমিশনে একটা রিপোর্ট পেশ করা, আর এই রিপোর্টের ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাতে পরবর্তী নির্বাচনে যুব সমাজের অধিকাংশ ভোট লিবারেল পার্টিতে এসে পড়ে। কিন্তু শত শত যুবকের সাথে কথা বলে আমি যে সিদ্ধান্তে এসেছিলাম তা হচ্ছে, আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এই সমাজকে লিবারেল পার্টিতে ভোট দেবার জন্য উদ্ধুদ্ধ করা নয়, বরং প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাদের ভোট দেবার জন্য উদ্ধুদ্ধ করানো, সেটা যে কাউকেই হতে পারে। সেই রিপোর্টে আমার ও আমার সহকর্মীদের মূল প্রস্তাবনা ছিল, পার্টির যে বিষয়টার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে, নির্বাচনের প্রতি যুবসমাজের যে অনীহা আছে তা দূর করা, আর তাদেরকে নির্বাচনে অংশ নেবার জন্য উদ্ধুদ্ধ করা। তারা লিবারেল পার্টিকে ভোট দিক আর নাই দিক, কিন্তু লিবারেল পার্টির জন্য যদি তারা ভোট কেন্দ্রে আসে এবং তাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের ভোট দেয়া শুরু করে তাহলে সেটা হবে পার্টির একটা বড় বিজয়।

সারা কানাডায় সমাজের জন্য কাজ পাগল অনেক যুবকর্মী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে এদের অধিকাংশই রাজনৈতিক কোনো দলের সাথে যুক্ত হবার পরিবর্তে বেসরকারী সংস্থার কাজের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে রাখে। আমরা আমাদের রিপোর্টে লিখেছিলাম, ‘সমাজের পরিবর্তনের জন্য যুবকরা নিজেদের মত করে পদক্ষেপ নিতে ভালোবাসে, কিন্তু সমাজের পরিবর্তনে সরকারী বা কোনো সম্মিলিত উদ্যেগের প্রতি তাদের আস্থাটা অনেক কম।’ আমরা আরো উল্লেখ করেছিলাম, পরিবেশ রক্ষায় যে কোনো পরিবেশবান্ধব কাজ করার জন্য ওরা যেমন নিজেরাই এগিয়ে আসে, কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে তারা তেমন কোনো আগ্রহ দেখায় না। ভোট দেবার বিষয়টা তারা তেমন গুরুত্বের সাথে দেখেও না। তারা মনে করে, তারা যখন কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা এনজিও’র হয়ে কাজ করে, অথবা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে কাজ করে তখন সেখানে তাদের অংশগ্রহণটা কিছুটা দৃশ্যমান হয়ে উঠে আর তাদের মনে হয় তাদের সংশ্লিষ্টতা উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ অবদান রাখছে। কিন্তু যখন তারা ভোট দিতে যায় অথবা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়, তখন তারা মনে করে, তারা একটা প্রক্রিয়ার সাথে নিজেদের যুক্ত করছে যেটা একদিন কোনো পরিবর্তন আনতেও পারে আবার নাও পারে, এই পরির্বতনের ফলাফল নিয়ে তারা নিশ্চিত হতে পারে না, বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে বিবেচ্য। কারণ, কোনো দল ক্ষমতায় গেলে শাসন করা নিয়েই দলের নেতারা নিজেদের ব্যস্ত রাখে। আমরা আমাদের রিপোর্টটা শেষ করেছিলাম এই বাক্যটা লিখে- ‘যুব সমাজকে যদি প্রত্যক্ষভাবে এক্ষেত্রে যুক্ত করা না হয়, তাহলে এই যে দিন দিন ভোটার সংখ্যা কমে যাচ্ছে তা আগামীতে আরো খারাপের দিকে যাবে।’ (চলবে)