মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

তেপান্ন.
২০০৭ এর ফেব্রুয়ারিতে আমি যখন পাপিনিউ থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, তখন একদিন সোফি আমাকে কাছে ডেকে মেঝেতে বসতে বললো। সে সোফায় আর আমি মেঝেতে। ব্যাপারটা এমন যে আমার ওমনভাবে বসার ফলে আমার কানটা তার পেটের কাছে গিয়ে ঠেকেছে। তারপর সে তার পেটটা আমাকে দেখিয়ে বলেছিলো, ‘তুমি পাপিনিউ’তে যা করতে যাচ্ছো, তা আমাদের জীবনের চলার গতির মধ্যে এক পরিবর্তন নিয়ে আসছে। কিন্তু এখানে যা আছে, তা কিন্তু আমাদের জীবনের এক নতুন দিককে উম্মোচন করতে যাচ্ছে।’

সে আমাকে তার মা হবার নমুনা দেখালো। বাড়ীতেই সে পাঁচবার পরীক্ষা করে দেখেছে সে মা হতে যাচ্ছে। গর্ভবতী হওয়ার পরীক্ষার নমুনা হিসেবে সেই ‘বøæ প্লাস’ চিহ্ন আমাকে দেখালো। সোফির কথা শুনে আর তার মা হবার নমুনা দেখে আমি মুহূর্তের মধ্যে আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়লাম। আমি সারাজীবনেই যে পাওয়া’টাকে সবচেয়ে বেশী মূল্য দিয়েছি, তা হচ্ছে আমার বাবা হওয়া। হয়তো আমার ভিতর এই চাওয়াটা গড়ে উঠেছিল আমার অসাধারণ সুন্দর বাবার পিতৃত্বের অনুভূতি দেখে। আমাদের তিন ভাইকে পেয়ে বাবা যেমন এক পরম আনন্দ পেতেন, ঠিক আমিও চাইতাম আমি যেন আমার সন্তানদের কাছ থেকে তেমন আনন্দ উপভোগ করতে পারি। আমাদের সেই বিয়ের দিন থেকেই সোফি আর আমি প্রচণ্ডভাবে মা-বাবা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। সেই সময়, আমি যখন ভাবতাম বা কল্পনা করতাম যে আমি বাবা হয়েছি, সেই ভাবনা আর কল্পনা আমার মধ্যে এক অন্যরকম উচ্ছ¡াস নিয়ে আনতো।

আমার জীবনের এই মোড় ঘুরানোর ব্যাপারগুলো কমবেশি সব এক সাথেই আসতে শুরু করে। আমি সোফির মধ্যে এমন এক সঙ্গীকে পেয়েছিলাম যার সাথে আমার জীবনের সবকিছুকেই ভাগাভাগি করে নেয়া যায়। আমি রাজনীতি করতে এসে দেখেছিলাম, এর মধ্য দিয়েই আমি মানুষের কাজে লাগতে পারবো। আর এখন আমরা এমন এক পরিবার তৈরী করে ফেলেছি, যা থেকে আমি বেঁচে থাকা আর ভালো কিছু করার এক প্রবল অনুপ্রেরণা পাবো।

জ্যাভিয়ার জেমস ট্রুডো ২০০৭ এর ১৮ই অক্টোবরে আমাদের ঘর আলো করে আসলো। বাবা বেঁচে থাকলে সেই দিনই আমরা বাবার আটাশিতম জন্মদিন পালন করতাম। জ্যাভিয়ারের মাঝের নামে আমার নানা সিনক্লেয়ারের নামের ছোঁয়া ছিল। জন্মের পরে সবুজ চোখ আর মমতাময়ী মায়ের কোলে সেই তুলতুলে নাদুস নুদুস বাচ্চাটাকে খুবই সুখী দেখাতো। সেই সময় আমি শুধু ভাবতাম, সে যেন শক্ত আর দাপুটে হয়ে বড় হয়, যে মাঠ আর পানির সব খেলাধূলায় একেবারে নির্ভিক থাকবে, কিন্তু একই সাথে নতুন কোন পরিস্থিতি আর নতুন কোন মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে একটু লাজুকতা দেখাবে।
এর ষোল মাস পরে ২০০৯ এর ১৫ই ফেব্রæয়ারিতে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান এলা-গ্রেস মার্গারেট ট্রæডোর জন্ম হয়। এলাকে দেখেই মনে হতো এক আলো আর প্রশান্তি নিয়ে সে এসেছে, কিন্তু একই সাথে তার মধ্যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞতা আর দূরন্তপনার যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তাতে সে সহজেই বাড়ীর সব কাজ কর্মের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। আর সেই এলাকে পেয়ে তার বাবার কি হয়েছিল, সেটাও একটু বলা দরকার। খুব সহজ সরলভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, সে আমাকে কাছে পেলেই আনন্দ ভালোবাসায় তার ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে আকড়ে ধরতো যা আমাকে পৃথিবীর এক অকহতব্য আনন্দের স্বাদ পেতে সাহায্য করে।

জ্যাভিয়ার যখন জন্মেছিল, তখন আমি লিবারেল পার্টির একজন প্রার্থী, যদিও সেই নির্বাচন হতে তখনো এক বছর বাকী ছিল। সেই সময় আমি আমার নির্বাচনী কাজকর্ম থেকে কয়েক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছিলাম এবং বেশ কয়েক মাস পর আমি সারা সময় শুধুই বাসার সব কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। আর যখন এলা-গ্রেস জন্মেছিল, তখন আমি অনভিজ্ঞ এক নতুন এমপি। সে জন্মেছিল বৃহস্পতিবারে, তারপর তাকে নিয়ে শনিবারে আমরা বাসায় এসেছিলাম। সেই শনিবারের পরের মঙ্গলবার বিকেলে এক গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভুটির জন্য আমাকে অটোয়ায় ফিরতে হয়েছিল। সেই সময় আমার পিতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে মাত্র সাড়ে চার দিনের ছুটি পেয়েছিলাম, ওর মধ্যে দুই দিনই ছিল সপ্তাহন্তের ছুটি।

আমি নির্বাচনে দাঁড়ানোর পূর্বে সোফির মত ও সমর্থন নিয়ে নিয়েছিলাম, কারণ আমি আমার ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, পরিবার ও পরিবারের সদস্যদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে রাজনীতি করে যাওয়া কত কঠিন একটা কাজ। কিন্তু একই সাথে বাবা আর স্বামীর দায়িত্ব পালন করাটা ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা।

তখন আমার কাছে একটা সাধারণ ও স্বাভাবিক সপ্তাহ বলতে বুঝাতো, সোমবার খুব ভোরে মন্ট্রিয়ল থেকে অটোয়ার পার্লামেন্টে রওনা হওয়া আর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আবার মন্ট্রিয়লের পথে ফিরে আসা। নিজের গাড়ী চালিয়েই আমি এই আসা যাওয়া করতাম। শুক্রবারে আমি সাধারণত আমার নির্বাচনী এলাকার অফিসে সবার সাথে দেখা সাক্ষাত আর আলাপ আলোচনা করতাম। শনিবারটা থাকতো আমার নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া বা বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী কাজকর্মে ব্যস্ত থাকা। আর রবিবারটা আমি চেষ্টা করতাম পরিবারকে দিতে, যদিও সেটা সব সময় সম্ভব হতো না।

আমার এমপি হওয়ার প্রথম বছরে আমি পার্লামেন্ট হিল থেকে পনের মিনিট হাঁটার দূরত্বে একটা দুই বেড রুমের সাজানো গোছানো এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছিলাম। ওটা ভাড়া নেওয়ার কারণ ছিল যদি কোন সপ্তাহে আমার পরিবার অটোয়ায় আসতে চায়, তাহলে সবাই মিলে একসাথে কিছু দিন কাটানো যাবে। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে এপার্টমেন্টটা ভাড়া নিয়েছিলাম সেটা পূরণ হয়নি। কারণ আমাকে পার্লামেন্ট এর কাজকর্মে এত ব্যস্ত থাকতে হতো যে, আর বিভিন্ন সময় ভোটাভুটির জন্য আমি এত বেশী ব্যস্ত থাকতাম যে আমার ঘরে ফেরার কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকতো না। তাছাড়া সোফির সেই অবস্থায় তাকে একটূ সহায়তা করতে পারে এমন বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন সবাই’ই মন্ট্রিয়লে থাকতো। ফলে পরের বছরই আমি সেই এপার্টমেন্ট’টা ছেড়ে দিই এবং যে সময় আমার অটোয়ায় থাকার প্রয়োজন পড়তো, সে সময়টা আমি হোটেলে থাকতে শুরু করি।

ছেলে জ্যাভিয়ার জেমস ট্রুডো আর মেয়ে এলা-গ্রেস মার্গারেট ট্রুডোর এর সাথে জাস্টিন ট্রুডো আর সোফি গ্রেগরী

স্ত্রী আর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থেকে দূরে থাকা সত্যিই খুব কঠিন একটা ব্যাপার। কিন্তু আমি আবার ঐ সময়টার মধ্য একটা ইতিবাচক বিষয় খোঁজার চেষ্টা চালাতাম। প্রতি সপ্তাহে আমি যখন অটোয়া থেকে গাড়ী চালিয়ে আমার পরিবারের কাছে ছুটে আসতাম, তখন সেই গাড়ী চালানো অবস্থায় আমি প্রায়ই নিজের কাছে নিজেকেই কিছু প্রশ্ন করতাম। আমি প্রায় নিজেকে বলতাম, এই যে আমি আমার পরিবার থেকে দূরে থাকছি, সেটা কি ঠিক হচ্ছে ? আমি কি আমার সন্তানদের জন্য একটা ভালো ভবিষ্যত গড়তে যাচ্ছি? অথবা, রাজনীতির মধ্য দিয়ে যে দেশ আর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখছি সেটা কি আমার সন্তান আর তাদের মত অসংখ্য জনের জীবনে মঙ্গল বয়ে আনবে ? আমার মনে এমনও প্রশ্ন জাগতো, আমি কি সস্তা জনপ্রিয়তা আর ক্ষমতার লোভে রাজনীতির খেলায় নিজেকে প্রতিনিয়ত জড়িয়ে ফেলছি ? আমি সত্যি বলছি, আমি সব সময় আমার এই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতাম না, বা বলা যেতে পারে অনেক সময় আমার এই সব প্রশ্নের উত্তর জানাও ছিল না। কিন্তু ঐ সময় এই সব প্রশ্ন আমাকে প্রায় তাড়িত করতো এবং আমি সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বারেবারে নিজের কাজকর্ম ও পদক্ষেপের ভালোমন্দের ব্যাপারটি ঝালিয়ে নিতাম, নিজের কাজের আত্ম সমালোচনা করতাম। বলা যেতে পারে, এই সব প্রশ্ন আর এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে লাগলাম, আমার চলার পথটা কেমন হবে আর কোন পথে এগুলে আমি সত্যি সত্যি আমার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌছতে পারবো। (চলবে)