বিদ্যুৎ সরকার : উ ত্ত রে র জা না লা
১.
ওদের বাসাটা ঠিক আমাদের বাসার উল্টো দিকে। মাঝখান দিয়ে দুই লেনের একটি রাস্তা পূব থেকে চলে গেছে পশ্চিমে। মদ্দা কথা শহরের কেন্দ্র বিন্দু থেকে দূরে এক শহর তলীতে। এ রাস্তা দিয়ে সাধারনত ইঞ্জিন চালিত রিক্সা, অটো রিক্সা আর ইজি বাইকই বেশি চলাচল করে থাকে। অবশ্য মাঝে মধ্যে যে দু-একটা চার চাকার গাড়ি যাতায়াত করে না তা কিন্তু নয়। আমাদের বাসা শহরের এক পাশে থাকায় রাস্তার গুরুত্ব বুঝেই প্রশস্তের পরিমাণটা সে মাফিক করা হয়েছে। কিন্তু গভীর রাত অব্দি এ রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচলের কমতি নেই। কান পাতলেই বাসার পাশের চায়ের দোকানের কোলাহল শুনতে মোটেও অসুবিধে হয় না। রাত বারোটা অব্দি এখানে চা প্রেমিরা বসে আড্ডা দেয়, চা পান করে। শেষ ঘন্টা পর্যন্ত চায়ের ক্যাটলি থেকে বাষ্প বের হয় অনর্গল।

রেডিওতে বারোটার নিউজ শুরু হলেই ঘরে ফেরার পালা। কানাইয়ের সবকিছু গুছিয়ে, ধোয়া-পাকলা শেষ করে তবেই না বাড়ি ফেরা। তাও রাত একটার আগে যাওয়া হয় না কোনদিনই। সকালে দোকান খোলার দায়িত্ব ছোট ভাই সোনাইয়ের। কানাই আসে দুপুর একটায়। এ পর্যন্ত দোকান চালানোর দায়িত্ব সোনাইয়ের উপর। কাঠ কয়লা জ্বালানো, চায়ের জল গরম করা, জলখাবার রেডি করা কম ঝক্কির কাজ না মোটেও। চায়ের দোকানের ইনকাম দিয়ে চার জনের সংসার চলে যাচ্ছে বিন্দাস।

কলেজ ছুটির দিনগুলোতে ও আসে জল খাবার নিতে। লুচি, বুটের ডাল আর আলুর দম। এর বেশি আর কি লাগে এগুলোতেই ক্বাফি! ওর দেখাদেখি আমিও যাই মাঝে মধ্যে যদি একটু আধটু ফাও বাৎচিত করা যায় মন্দ কি?

২.
ওদের বাড়ির উত্তরের জানালাটা আমার একান্ত প্রিয়। যখন খোলা হয় তখন ও’র উপস্থিতির সাক্ষি বহন করে। রাতের বেলায় যতক্ষণ না ঘুমাবে ততক্ষণ সে জানালা অবারিত রাখে। পড়া শেষ হলে গল্পের বই কিংবা রেডিওতে বাংলা হিন্দী গান শোনা নিত্যকার রুটিন। ওর সাথে আমার সবসমই চলে এক ‘কোল্ড ওয়ার’। বিষয়টি আমরা দুজনই ভীষণ ভাবে এনজয় করি। আমরা যারা এ পাড়ায় বসবাস করছি তারা সবাই আদি থেকে সহাবস্থান করে আসছি হৃদ্যতার সাথে, আন্তরিকতার আবর্তে। কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝখানে একটি স্বচ্ছ কাচের দেয়াল অবস্থান করছে সযতনে। আমাদের বেরে উঠা এক সাথে একই ধারায় এক আবহে। প্লে-গ্রæপ থেকে কলেজ অব্দি একই সাথে। এক্কা-দোক্কার ছক থেকে কলেজ প্লে-গ্রাউন্ডের বৃত্তে আমরা দু’জন এক পথে এক সাথে এখনও। কী একটি দ্বিধা কিংবা সংকোচ আমাদের দুজনকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে অথবা পরস্পরকে আগলে রেখেছে আদি থেকেই। আমরা কেন পরস্পরের কাছে আসতে পারি না, যতটা কাছে গেলে নি:শ্বাসের উষ্ণতা অনুভব করা যায়, চোখের দৃষ্টিতে ধানসিড়ি নদীটির গভীরতা জানা যায়।

দুজন দুই বিভাগে আমি সাইন্স ও আর্টস এ। একই কলেজে হওয়ায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যাবে পরস্পরের সাথে। ক্যাফেটেরিয়া, কমন রুম বা ইনডোর গেইম রুমে। ও মাঝে মাঝে ইনডোর গেইম রুমে আসে টেবিল টেনিস, ক্যারম, দাবা খেলতে। বার্ষিক খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক সপ্তাহে বিভিন্ন ইভেন্টে পার্টিসিপেট করে সেও পুরুস্কৃত হয়েছে কয়েকটিতে। মিক্সড ক্যারম প্রতিযোগিতায় আমাদের কাছে হেরে গিয়ে ভীষণ ভাবে রেগে যায়। আমিও ইচ্ছে করে ওকে খেপিয়ে তুলছিলাম সেদিন। বাৎসরিক কলেজ ম্যাগাজিনে তার একটি ছোটগল্প প্রকাশিত হোয়েছিল, কিশোর প্রেমের গল্প। ভাল হয়েছিল গল্পটি। সুযোগ খুঁজছিলাম কবে কাছে পেয়ে একটু ধন্যবাদ জানাবো লেখাটির জন্য। এতে করে যদি আমার প্রতি তার রাগের পরিমানটা কিছুটা প্রশমিত হয়।

৩.
আজ বেশ কদিন ধরে তাকে কলেজের কোথাও দেখিনা, না ক্যাফেটেরিয়া বা কমন রুমে। কাউকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। কলেজ থেকে ফিরে প্রথমে লক্ষ্য করলাম উত্তরের জানালার দিকে। সত্যিই তো এখানেও সে নেই। তা না হলে কেনই বা জানালাটি বন্ধ থাকবে। পরের দিন এবং তার পরের দিনও জানালা খুলে নাই। কিছুটা অবাকই হলাম এমন করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার জন্য। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ লা -পাত্তা।

রাত গভীর, ঘুম আসছে না কিছুতেই, মশারীর মতো ভাবনাগুলো, দু:খগুলো আমার চার দিকে নেমে আসছে অনবরত। পূর্ণ চাদের স্নিগ্ধতায় প্লাবিত আমার ঘরের চার দেয়াল। আজই প্রথম তার অনুপস্থিতে অহেতুক শূন্যতায় ভরে যাচ্ছে আমার মন। কোত্থেকে এক সুনামি এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমার সকল সুখ। আমি ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি সুনীল সাগরের অতল জলের আহবানে।

অল্পের জন্য এ যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেছি। আঘাৎ এতোটা বিপজ্জনক না হলেও কিছুক্ষণের জন্য আমার কোন জ্ঞান ছিলো না। যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন আমি আমাকে হাসপাতালের বেডে খুঁজে পাই। মাথায় ব্যান্ডেজ। পায়ের অনেকটাই গাড়ির চাকার আঘাতে জখম হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আরও দু’দিন এখানে থাকতে হবে আমাকে।

কখন যে ঘুমিয়ে পরি, হঠাৎ মাথায় ব্যান্ডেজের উপর কারোর হাতের স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি উত্তরের জানালার সেই মুখ। ওর হাত আমার মাথার উপর ব্যান্ডেজ থেকে এখন চুলের ভেতর চলে গেছে।
– আরে তুমি? কোত্থেকে, কেমন করে?
– হুম্, আমি বুলা, তোমার চিরকালের শত্রু।
– মানে কি? আমি কি করলাম যে তুমি আমাকে ‘চির শত্রæ’র তকমা দিচ্ছ?
– প্রথমত, পাশাপাশি থেকেও কেন কাছাকাছি পথ চলতে এতো দ্বিধা, ভয়, সংকোচ?
– আর দ্বিতীয়টি?

– সেদিন ক্যারাম খেলায় তোমাদের কাছে হেরে যাওয়াতে ভীষণভাবে আমাদের ‘টীজ’ করছিলে। ফলে অপমান, অভিমান ও লজ্জায় আমাকে কোথাও না কোথাও চলে যেতে বাধ্য করেছিলে।
– তাই বলে, বলা নেই কওয়া নেই হুট্ করে চলে যেতে হবে এমন করে?
– অপমান বোধ তোমার না থাকতে পারে আমার আছে বলেই চলে গেছি।
– আবার চলে যাবে না তো?
– কেন, আবার অমন কিছু করবে নাকি?
– নেভার এভার গড’স শেক।

– হাত ছুঁয়ে ‘প্রমিজ’ বল।
– ‘প্রমিজ’ ‘প্রমিজ’ শতবার বলতে রাজি কিন্তু তুমিও প্রমিজ কর আর কোন দিন আমার এ হাত ছেড়ে কোথাও হারিয়ে যাবে না?
যাবো না,যাবো না, যাবো না – তিন সত্যি হলো তো?
– থ্যাংকস এ লট বুলা, আই মিসড্ য়্যু সো মাচ। নিশ্চয়ই তোমাদের উত্তরের জানালাটি আজ খুলে দিবে?
– মাই ডিয়ার, অলরেডি ইটস্ ওপেন ফর য়্যু।