ফরিদুর রহমান : ক্রোয়েশিয়ার একটা ফিল্ম স্কুলের প্রশিক্ষণার্থীদের দলগত প্রযোজনা স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘দ্য সুপ’ দিয়ে শুরু হলো দিনের ছবি দেখা। এক রাতে একটি স্কুলের ছাত্রাবাসে বিদ্যুৎ চলে যায়। নতুন আসা এক ছাত্রের খিদে পেলে সে আধো অন্ধকারে ডাইনিং হলে ঢুকে পড়ে। সেখানে বাবুর্চি তাকে একবাটি গরম স্যুপ খেতে দেন। স্যুপ খেয়ে ছেলেটি ঘরে ফিরে আসে। পরদিন সকালে বর্তমান স্টাফদের কাছে ছেলেটি জানতে পারে, যে কুক রাতে তাকে স্যুপ পরিবেশন করেছিলেন, বহুবছর আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। খুব সাদামাটা ভৌতিক গল্প, কিন্তু চমৎকার প্রোডাকশন। একটি সাধারণ গল্প ফিল্ম স্কুলের ছাত্রদের হাতে পড়ে একটি উৎসবে দেখাবার মতো ছবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আরো কয়েকটি ছোট ছবি দেখার পরে লাঞ্চব্রেকের সময় হলে পেপে জিজ্ঞেস করলো, খেতে যাবো কিনা! বললাম, ‘বললাম খেতে যাবো নিশ্চয়ই। কিন্তু এগারোটা রেস্টুরেন্টের মধ্যে নতুন একটাতে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে গতরাতে ধরা খেয়েছি।’ ওর প্রশ্নের উত্তরে রেস্টুরেন্টের নাম বলতে না পারলেও খাবারের নাম বললাম, ‘ইতালিয়ান পাস্তা! মনে হচ্ছিল আধা সেদ্ধ ময়দা চিবিয়ে খাচ্ছি!’

পেপে বললো, ‘তুমি গ্রিসে এসে ইতালির খাবার খেতে গেলে সমস্যা হতেই পারে। চলো তোমাকে আজ এমন জায়গায় নিয়ে যাবো, যেখানে লটস অফ চয়েস এবং তুমি মোটেও হতাশ হবে না। তবে একটু বেশি হাঁটতে হবে।’
শহর যতো বড় তাতে কতদূরই বা যেতে হবে, অতএব হাঁটতে কোনো আপত্তি নেই। পেপে, লোলা, আলবার্তো এবং আরো একজন স্প্যানিশ মহিলা ফিল্মমেকারসহ পুরোনো পরিচিত সবগুলো রেস্টুরেন্ট পেরিয়ে একটু সামনে এগিয়ে যেখানে পৌঁছলাম, তার নাম উচ্চারণ করে বলা আমার সাধ্যের বাইরে। তবে মনে রাখার জন্যে রোমান হরফের সাথে মিলে যায় নামের এমন একটা অংশ বের করে ফেলেছি আর তা হলো ‘জয় জাকারিয়া!’ রেস্টুরেন্টের ভেতরটা রীতিমতো প্রাচীন সাজ সজ্জায় ঠাসা। হলদে রঙের দেয়ালে সম্ভবত রেস্তোরা মালিকের জীবিত মৃত চৌদ্দ পুরুষের ছবি বাধাই করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের পুরোনো জমিদার বাড়ির অনেক উঁঁচু সিলিংয়ে যেমন তাল গাছের বা কাঠের তীর-বর্গা দেখা যায় তেমন তীর বর্গা থেকে ঝাড়বাতি ছাড়াও ঝুলছে গম, রশুন এবং অন্য কোনো ফসল ও শুকনো ফুলের গোছা। প্রাচীনকালের বিশাল দেয়াল ঘড়ি এবং ঢালের মতো তামার তৈরি চক্র ইত্যাদির ফাঁকে শোভা পাচ্ছে অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পোস্টার। কাঠের তৈরি পুরোনো ধাঁচের চেয়ার টেবিলের টেবিলগুলো মোটা কাপড়ের টেবলকথে ঢাকা।

জাতীয় প্রতিরোধ

এখানে শুধু ম্যেনু দেখে নয়, আমাদের দেশের লঞ্চঘাটের কিংবা পুরোনো ঢাকার অনেক রেস্টুরেন্টে যেমন সামনে সাজানো খাবার দেখে অর্ডার দেবার ব্যবস্থা আছে, তেমনি সব সাজানো। তবে রেস্টুরেন্টের সামনে নয়, মাঝের দেয়ালের মাঝামাঝি কাউন্টারের সামনে কাচ দিয়ে ঘেরা তাকে জানা অজানা খাবার সাজানো। কিছু খাবার ফাস্টফুডের মতো আর কিছু অর্ডার দিলে তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। একটি ডিসপ্লে ট্রে দেখে মনে হলো এতো আমাদের আলু দিয়ে রান্না করা গরুর মাংসের ঝোল। সঙ্গে ভাতের ব্যবস্থা নেই, তা না থাক নানা ধরনের ব্রেড তো আছেই। গ্রিক বিফকারি উইথ পটেটোর সাথে ব্রেড ছাড়াও টেবিলে এলো সবুজ রঙের গ্রিক বিয়ারের বোতল মিথোস। ডেনমার্কের বিশ্বখ্যাত কার্লসবার্গ গ্রæপের গ্রিক প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক ব্রæয়ারির মিথোস মাত্র এক দশকেই ইউরোপ আমেরিকা ছাড়িয়ে কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে গেছে। এতো দূর বিস্তৃত যার খ্যাতি, অলিম্পিয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এসে সেই অলিম্পিক ব্রæয়ারির মিথোসের স্বাদ না নিয়ে ফিরে যাওয়াটা কোনো কাজর কথা নয়। অতএব আমার বিলের সাথে বাড়তি দুই ইউরো যোগ করতে কোনো মনোকষ্ট হলো না।

‘জয় জাকারিয়া’ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোবার পরে আলবার্তো তার স্পেশাল ইফেক্ট ওয়ার্কশপে প্রশিক্ষণ দিতে কনফারেন্স হলের দিকে পা বাড়ালো। লোলা আর আর পেপে হোটেলে ফিরবে। পেপে জিজ্ঞেস করলো, ‘যাবে নাকি হোটেলের দিকে?’

আমি ভেবে দেখলাম পিরগস শহরের তো কিছুই এখনো দেখা হলো না। আজ বৃষ্টি নেই, রোদটাও বেশ মিষ্টি। বিকেল পর্যন্ত বরং দুই একটা দর্শনীয় জায়গা ঘুরে আসা যাক। বললাম, ‘আমার স্ত্রী সঙ্গে থাকলে হয়তো হোটেলে ফিরতে চাইতাম। তা যখন নেই, ঘুরে ফিরে সন্ধ্যায় এ্যাপোলো থিয়েটারে আসবো।’
পিরগস শহরের প্রধান সড়কে হাঁটলে একটা ছোট্ট সড়ক দ্বীপে তলোয়ার হাতে যাঁকে দাঁড়িয়ে থাকে দেখা যায়, তিনি একদজন জাঁদরেল জেনারেল। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গ্রিসের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সেনাধ্যক্ষ জেনারেল থিওডর কলোকত্রোনিস ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে কোরিনথিয়ার ছোট্ট গ্রাম দেরভেনাকিয়ার যুদ্ধে মাহমুদ পাশার তুর্কি বাহিনিকে পরাস্ত করেন। সে যুগে জেনারেলরা লড়তেন ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে, কাজেই জেনারেল কলোকত্রোনিস তাঁর যুদ্ধজয়ের পুরস্কার হিসাবে রোদ বৃষ্টি তুষারপাত উপেক্ষা করে পিরগস শহরের একটি মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

ন্যাশনাল ব্যাংকের সামনে ভাস্কর্য

এই মোড় থেকে শহরের ভেতরে অলিম্পিয়া হোটেলের দিকে না এগিয়ে বাঁ দিকের একটা পথ ধরে অনেকটা আন্দাজেই নগরীর কেন্দ্রস্থল টাউন স্কয়ারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ইউরোপের যে কোনো শহরে এসে প্রথম দিনেই সাধারণত টাউন স্কয়ার দেখা হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কয়েকশ বছরের পুরোনো টাউন স্কয়ারকে ঘিরেই ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অতীত ও বর্তমানের কিছু নিদর্শন ছড়িয়ে থাকে। চার্চ কেন্দ্রীক জনপ্রশাসন ব্যবস্থার কারণে অনিবার্যভাবেই এক বা একাধিক গির্জার দেখা মেলে টাউন স্কয়ারে। পিরগস টাউন স্কয়ারকে অবশ্য বলা হয় সেন্টাল স্কয়ার। নাম যাই হোক এই বিশাল চত্বরেই রয়েছে শহরের অন্যতম প্রধান উপাসনালয় সেইন্ট নিকোলাস চার্চ। মধ্যযুগের অর্থডক্স গির্জাটি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ার বছর পাঁচেক পরে পুননির্মাণ করা হয়েছে। শীর্ষে দুদিকে দুটি ঘণ্টাঘর এবং মাঝখানের স্তম্ভসহ শ্বেতশুভ্র এই ভবনটি নির্মাণশৈলীর দিক থেকে সাধারণ হলেও ভেতরটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। গির্জার অভ্যন্তরে নানা ধরনের ধন সম্পদ জড়ো করার ব্যাপারে ধর্মধারীদের কোনো কার্পন্য কখনোই ছিল না।

পিরগস সেন্ট্রাল স্কোয়ারের মাঝ বরাবর সড়ক দ্বীপের মতো বেশ কয়েকটি বাধানো চত্বরে গাছের সারি ছাড়াও রয়েছে ফুলে কেয়ারি এবং একটি ফোয়ারা। একদিকে নগরবাসীর জমায়েতের জন্য টাউনহল বেশ কয়েকটি অস্থায়ী রেস্তোরাঁ এবং অন্যদিকে পিরগস পৌর কর্তৃপক্ষের দপ্তর এবং প্রতœতাত্তি¡ক জাদুঘর। এই কেন্দ্রীয় চত্বরে নিত্য দিনই শহরের কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মতো সৃজনশীল মানুষের আড্ডা জমে। নানা উপলক্ষে কনসার্ট বা মেলার মতো আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এখানে। রাজনৈতিক জনসভা কিংবা কোনো প্রতিবাদী জন সমাবেশে পিরগস শহরের সব মানুষ সমবেত হলেও এখানে স্থান সংকুলানের সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।

পিরগসের মেয়রের নিমন্ত্রণে মিউনিসিপ্যালিটি এবং অর্কিওলজিক্যাল
মিউজিয়াম পরিদর্শনের অফিসিয়াল কর্মসূচি আছে বলে সেদিকে না গিয়ে স্কোয়ারের শেষ প্রান্তে উদ্যানের দিকে পা বাড়ালাম। পাথরের ¯ø্যাব বসানো দীর্ঘ চত্বর এবং অনেকগুলো সিঁিড় পেরিয়ে সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি মনুমেন্ট। ১৯১২ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত তুর্কি আধিপত্যের বিরুদ্ধে দশ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহিদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে এই স্মৃতিকম্পেøক্স! মজার ব্যাপার, গ্রিকদের বিরুদ্ধে তুরস্কের এই যুদ্ধ জয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মোস্তফা কামাল পাশা, পরবর্তী সময়ে কামাল আতাতুর্ক! নব্য তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল পাশাকে নিয়ে আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম যখন বিজয়োল্লাসে ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই’ লিখছেন তখন গ্রিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটি একটি রক্তক্ষয়ী দখলদারিত্বের যুদ্ধ। পিরগসের শহিদ স্মৃতি কমপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন করে মনে হচ্ছিল, যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলেও চূড়ান্ত বিচারে তা সব সময়েই মানবিক বিপর্যয়ের কারণ।
‘এতনিকি এতিসতাসি’ বা জাতীয় প্রতিরোধ নামে আরো একটি বড় মনুমেন্ট রয়েছে উদ্যানের উত্তর-পূর্ব কোণে। কালো পাথরে তৈরি এই স্মারক ভাস্কর্যটি বেশ জটিল একটি শিল্পকর্ম বলে মনে হয়েছে। কেন্দ্রীয় চত্বর উদ্যানে আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির আবক্ষ মূর্তির সাথেই রয়েছে ডাইনোসিয়াস করকোলিসের আবক্ষ মূর্তি। এথেন্স চিকিৎসা বিদ্যায় লেখাপড়া করে পিরগসে ফিরে তিনি কিছুদিন ডাক্তারি করেছেন। তারপরে রাজনীতি শুরু করে খুব কম বয়সে পিরগসের মেয়র এবং মধ্য বয়সে ইলিয়া প্রদেশের পার্লামেন্ট মেম্বারও হয়েছিলেন। কিন্তু কে বা কারা যেনো করকোলিসের মুখে আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছে। আসলে চিকিৎসক রাজনীতিকদের কপালই খারাপ। আমাদের দেশেও একজন খাতিমান চিকিৎসক রাজনীতিবিদকে রেলগেটে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি নিশ্চিত আমাদের সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এই রাজনীতিবিদের আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হলে পরদিন মূর্তির বেদী শুদ্ধো উৎপাটিত হয়ে যাবে। এখানে অন্য দুটি ভাস্কর্যের মধ্যে রাজনীতিবিদ এথনেসিয়াস কানেলোপুলাসের পরিচয় পেলেও চত্বরের একমাত্র নারীমূর্তি এলেনি মিত্রপোলু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারিনি।

টাউন স্কয়ার থেকে বেরোবার মুখেই হাতের ডান দিকে ন্যাশনাল ব্যাংক অফ গ্রিসের পিরগস শাখা। বিশাল করিন্থিয়ান পিলারের উপর তিনতলা সুদৃশ্য ভবনে গ্রিসের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখার প্রবেশ পথে দুটি কালো পাথরের ভাস্কর্য! এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল, কিন্তু প্রস্তর মূর্তি দুটিরই মাথায় হাত! গত কয়েক বছর ধরে গ্রিসের অর্থনীতির যে অবস্থা এই মূর্তি দুটি তারই প্রতীক কিনা বলা মুশকিল। বাংলাদেশে ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গায়েব হয়ে যাওয়া কিংবা খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের শত কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে একদিকে অর্থমন্ত্রী আর অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এমন ভাস্কর্য স্থাপন করলে বেশ লাগসই হতো। অবশ্য বাংলাদেশে জনগণের টাকা পাচার হলে বা ঋণ খেলাপিরা ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করলে সরকারের কিছু আসে যায় না, কাজেই মাথায় হাত পড়লে তা জনগণেরই পড়ে।

সন্ধ্যায়এ্যাপোলা থিয়েটারে প্রথম ছবিটি ছিল এ্যানিমেশন ক্যাটাগরিতে ‘চিকা: দ্য ডগ ইন দ্য ঘেটো’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের এক ছোট্ট শহরে হুকুম জারি হয় ইহুদিরা কোনো কুকুর রাখতে পারবে না। ছোট্ট মিশকা তার চিকা নামের কুকুরটিকে প্রথমে নিজেদের বাড়িতে এবং পরে এক খ্রিস্টান বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে রাখে। যুদ্ধের শেষ দিকে ইহুদিরে আত্মসমর্পনের আদেশ দেয়া হলে মিশকা তার বাবা মাসহ একটা চিলে কোঠায় লুকিয়ে থাকে। কিছুদিন পরে যুদ্ধ শেষে আবার চিকাকে ফিরে পায় মিশকা। চমৎকার এ্যনিমেশনে একটা মানবিক গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘চিকা: দ্য ডগ ইন দ্য ঘেটো’ ছবিতে।

রেস্টুরেন্ট জয় জাকারিয়া

ভালো লেগেছে কেরালায় চিত্রায়িত ভারতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘দ্য ট্রাপ’। পিতৃ-মাতৃহীন আট বছর বয়সের কুট্টাপাই তার দাদার সাথে গ্রামে চলে এসেছে। খালে বিলে নৌকায় ঘুরে, একপাল হাঁসের দেখাশোনা করে, মাছ ধরে এবং গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাথে হৈ চৈ খেলাধুলায় দিনগুলো ভালোই কাটছিল তার। শহরে একটা স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগও এসেছিল। কিন্তু দাদা অসুস্থ হয়ে পড়ায় সব উলোট পালোট হয়ে যায়। ছবি উল্লেখযোগ্য দিকগুলো ছিল কেরালার অসাধারণ সুন্দর প্রকৃতির চমৎকার চিত্রায়ণ এবং কুট্টাপাইয়ের চরিত্রে অশান্ত শাহর অভিনয়।

‘দ্য ট্রাপ’ দেখে বেরিয়ে আসার ফলে পরের দুটি ছোট এবং ফরাসি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘চিলড্রেন অফ চান্স’ দেখা হয়নি। তবে এ্যাপোলো থিয়েটারের বাইরে দীর্ঘ আড্ডায় বেশ কয়েকজন পরিচালক প্রযোজকের সাথে পরিচয় হয়েছে। অনেকের নাম ভুলে গেলেও বিভিন্ন কারণে যাকে মনে আছে, সে তিয়ানলিন ঝু। তিয়ানলিন চীন থেকে জার্নালিজমে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল জার্মানিতে। অবশ্য এর আগে চীনে থাকাকালীন চলচ্চিত্র উৎসবে সংগঠক হিসাবে কাজ করতে করতেই চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহ জন্মে। কয়েকটা ছোট প্রামাণ্যচিত্র এবং টেলিভিশন ডকুমেন্টারি তৈরির পরে জার্মানিতে চলে আসে এবং দীর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র ‘কামিং এ্যান্ড গোয়িং’ নির্মাণে হাত দেয় তিয়ানলিন। ‘কামিং এ্যান্ড গোয়িং’ শুধু দৈর্ঘ্যে বড় নয় ছবিটি তৈরি করতে সময়ও লেগেছে প্রায় তিন বছর। চীনের কয়েকটি প্রত্যন্ত গ্রামে এবং কয়েকটি বড় শহরে অনেকদিন ধরে স্যুটিং করতে হয়েছে।

সেইন্ট নিকোলাস গির্জা

তিয়ানলিনকে দেখে প্রথমে কিশোরী বলেই মনে হয়েছিল। মঙ্গোলিয় চেহারার মানুষের এই এক সুবিধা। পঞ্চাশেও পঁচিশ বলে মনে হয়। তিয়ানলিন অবশ্য ত্রিশ পার হয়নি। জিজ্ঞেস করে জানলাম ওর ছবি দেখানো হবে আমলিয়াদায় দুদিন পরে। বললাম, ‘শুধু তোমার ডকুমেন্টারি দেখার জন্যে হলেও আমলিয়াদায় যাবো।’ প্রসঙ্গক্রমে বুলগেরিয়ার এক ঘণ্টার প্রামাণ্যছবি ‘কেমব্রিজ’এর কথা বললো তিয়েনলিন। ফেস্টিভ্যালের দ্বিতীয় দিন আমি যখন এ্যাপোলো থিয়েটারে ‘দ্য ক্রাউন প্রিন্স’ দেখছি তখন আমলিয়াদায় দেখানো হয়ে গেছে বুলগেরিয়ার প্রামাণ্যচিত্র ‘কেমব্রিজ’। এক সাথে তো সব জায়গায় উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়।

রাতে তিয়ানলিন ছাড়াও আরও কয়েকজন মিলে দল ধরে নতুন আর একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। এটির নাম ‘এল গ্রেকো!’ যার অর্থই দ্য গ্রিক! আমাদের হোটেলের সবচেয়ে কাছে চমৎকার এই রেস্টুরেন্টটা এতোদিন চোখে পড়েনি কেন, ভেবে অবাক হলাম। মনে মনে ঠিক করে রাখলাম আর যে কদিন আছি সে কদিন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে ‘এল গ্রেকো’ অথবা ‘জয় জাকারিয়া’র বাইরে আর কোথাও যাচ্ছি না। চলবে…