বনানী : একটা উদীয়মান দেশের কাঠামো তৈরিতে দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অনর্ষিকার্য। এটা একটি অবধারিত সত্য যে, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে একটি ঘুমন্ত জাতির বিবেককে। সাহিত্যিক হয়ে তাঁদের রচনাবলীর মাধ্যমে, সাংবাদিক হয়ে তাঁদের শানিত কলমে, শিল্পী হয়ে তাঁদের গানের সুরে, শিক্ষক হয়ে তাঁদের জ্ঞান বিতরণে, চিকিৎসক হয়ে তাঁদের সেবার মাধ্যমে এবং সম্মিলিতভাবে তাঁরা সাধারণ জনগণের সান্নিধ্যে এসে দেশ তথা সামগ্রিক কল্যাণ সাধন করে যান তাঁরা। তাই একটি জাতিকে মেধা শূন্য করে দেওয়ার প্রথম উপায় হলো দেশটিকে বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়া এবং বুদ্ধিহীন পশ্চিম পাকিস্তানিরাও এই চিরন্তন সত্যকে উপলব্ধি করেছিল। তাই পশ্চিম পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের নীল নকশা তৈরী করে অপারেশন সার্চ লাইট অনুসারে হিন্দুবিহীন, বুদ্ধিজীবী বিহীন একটি মুসলিম রাষ্ট্র তৈরির অপচেষ্টা করেছিল। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন তারা বুঝতে পারলো যে যুদ্ধে জয়ী হওয়া আর সম্ভব নয় তখন এই দেশটির শিক্ষাগত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকগুলিকে চিরতরে দুর্বল করার পরিকল্পনা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসক এবং মননসমৃদ্ধ মানুষদের হত্যা করতে শুরু করে।

“নিহত বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাগত তালিকা হলো : শিক্ষাবিদ -৯৯১, চিকিৎসক-৪৯, সাংবাদিক-১৩, আইনজীবী-৪২” (সংগৃহিত : দিলীপ মজুমদার, কলকাতা, সিনিয়র ফেলোশিপ প্রাপ্ত গবেষক, বাঙালি বুদ্ধিজীবীর রাজনীতি)। এছাড়া শিল্পী, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব ও অন্যান্য-১৬ জন। দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে এখনো পর্যন্ত এসব বুদ্ধিজীবীদের বিশদ বর্ণনাসহ কোনো পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত হয় নাই। যাই হোক, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর এর ১২ তারিখ থেকে ১৯৭২ এর জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ডক্টর সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ডক্টর ফজলে রাব্বী, ডক্টর মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহমেদ, ডক্টর আব্দুল আলিম, ডক্টর আনোয়ার পাশা, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, সাংবাদিক নিজামুদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, চলচিত্রকার জহির রায়হান, হুমায়ুন কবির, সাজিদুল হাসান, ডক্টর হাবিবুর রহমান, এম. মুর্তজা, অনুদ্ভৈপায়ণ ভট্টাচার্য, ডক্টর আলিম, ডক্টর মনসুর আলী, ডক্টর আসাদুল হক, ডক্টর নুরুল ইনাম, সিরাজুদ্দিন হোসেন, নজমুল হক সরকার এবং আরো অনান্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।

প্রশ্ন জাগতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানী হায়েনারা কি জানতো কারা এই দেশের সূর্য সন্তান, কারা এই বাংলার বুদ্ধিজীবী? পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যবর্তী দেশ হলো ভারত যেটা ১,৬০০ কিলোমিটার আয়তন দুই দেশের মাঝখানে। এই ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সেটা জানার কথা নয়। পৃথিবীর প্রতিটা জেনোসাইড এর ইতিহাস থেকে জানা যায় যে যুদ্ধে নিরীহ মানুষের হত্যাকাণ্ডের তালিকা সৃষ্টি করে হোম গ্রোন কিছু মানুষ নামেই জীবের মাধ্যমে। আমাদের বাংলাদেশে তারা রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, কিছু বিহারি ও তাদের দোসরদের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা তালিকা প্রস্তুত করে বুদ্ধিজীবী নিধনে। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভে অর্থাৎ মার্চ থেকে মে মাসে আমরা হারাই অধ্যাপক ডক্টর গোবিন্দ চন্দ্র দেব, রণদা প্রাসাদ সাহা, ধীরেন্দ্রনাথ, ডেন্টাল সার্জণ ডক্টর এম. শফী, ডক্টর জোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং আরো অনেক নাম না জানা বুদ্ধিজীবী।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর তাই কি আজ দেশটি মেধা বিহীন রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে? কারণ যখন দেখি শিক্ষিত বুর্জোয়া সমাজ আজ অনেকাংশে নিশ্চুপ। হেফাযত, কাওমী এবং বিভিন্ন সম্মিলিত মাদ্রাসার জন সমুদ্রের মিছিল সাধারণ মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছে ওরা কত সংগঠিত। ওদের কাছে সাধারণ মানুষ কত অসহায়। ওদের প্রতিবাদের কারণে লালন ফকির এবং সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে নারী ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়েছিল। এই অপশক্তি এখন সংখ্যা গুরু আর সাধারণ মানুষ হয়ে গেছে সংখ্যা লঘু। সরকার, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ কোথায়? আর আজ ২০২০ সালে ভাঙা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। কারণ ধর্মকে চাষ করা হচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।

চিটাগাং হিল ট্রাক্টস এর মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা (সামগ্রিক বাংলাদেশের জেলাগুলির চিত্র এর চেয়ে অনেক বেশি হবে নিঃসন্দেহে ২০২০ সাল পর্যন্ত )।
Year Mosque Madrasha
1979 421 4
1982 525 35
1983 529 39
তথ্য সূত্র : শ্রী রবি , “Islamic Expansionism in the Chittagong Hill Tracts.”

এই মাদ্রাসাগুলির ভবিষৎ কী? সবাই আমরা চোখ খুলে ঘুমিয়ে আছি। দেশ আজ মেধাবিহীন রাষ্ট্র হলো কি? চারিদিকে শুধু অন্যায়, অবিচার, সামাজিক অপরাধ পাখা মেলেছে এবং তারা আইনের সামনে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেই চলেছে। এই অপরাধকে দমন করার দায়িত্ব কার? মুক্তি কোথায় আমাদের? স্বাধীন দেশে এই অপশক্তির কাছে আমরা শৃঙ্খলিতভাবে বন্দি। আমরা আজ অসহায়। তথাকথিত ধর্মের চাষ আমাদের প্রকৃত ধর্ম থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এই অগুনতি মাদ্রাসাগুলিতে কী হচ্ছে? কে দিচ্ছে এদের লাইসেন্স? এই মাদ্রাসাগুলি থেকে যে ছাত্র ছাত্রীরা পাশ করছে তারা কি অন্যান্য সাধারণ সরকারি বেসরকারি বিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে মেধার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে? যেমন ধরা যাক, যখন তারা উচ্চতর শিক্ষার জন্য চিকিৎসা, কারিগরি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে। এই মাদ্রাসার সিলেবাস কি অন্যান্য বিভাগীয় বোর্ডের সমমান তুল্য? এই মাদ্রাসাতে কি জাতীয় সংগীত বাজানো হয় অন্যান্য বিদ্যালয়গুলির মতো? এসব ভেবে দেখার সময় কি এখনো আসেনি? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে যাচ্ছে এবং যাবে।
এই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর কয়েকটি উক্তির কথা মনে হলো এবং সেগুলি হলো, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বার বার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয় কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে। গানের শব্দ বদল করে রেডিওতে গাওয়া হয়েছে। তারা মুসলমানী করিয়েছেন। এ অধিকার তাদের কে দিল?” ( তথ্য সূত্র :১৯ ৭১ সালের ৪ঠা জানুয়ারী, ঢাকার রমনা গ্রীনে আয়োজিত প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথির ভাষণে এই দুঃখবোধ প্রাকাশ করেন। বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত বক্তৃতা ও বিবৃতি – রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত )।

বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, “একটি জাতিকে পঙ্গু ও পদানত করে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করা (তথ্য সূত্র : বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত বক্তৃতা ও বিবৃতি – রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত )।

বঙ্গবন্ধু সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীদের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলেছিলেন, “বাঙালির স্বাজাত্যবোধকে টুঁটি চেপে হত্যার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বার বার এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর আঘাত হেনেছে, আর তাকে প্রাণ দিয়ে প্রতিহত করেছে এদেশের তরুণরা। কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী স¤প্রদায় ক’জন আছেন?

বিবেকের কাছেই তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে। আপনাদের লেখনী দিয়ে বের হয়ে আসা উচিত ছিল এদেশের গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সন্তান সূর্যসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রচেষ্ঠাই করা হয় নাই। তাঁর কথা বলতে আপনার ভয় পান। কারণ তিনি ছিলেন হিন্দু। এঁদের ইতিহাস লেখা এবং পাঠ করার জন্যে দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাই।” (তথ্য সূত্র : আজাদ, সংগ্রাম, ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯ ৭১)।

দেশ কি আজ বুদ্ধিজীবী শূন্য হয়ে যাওয়ার পথে? চারিদিকে শুধু অন্যায়, অবিচার, তৈলমর্দন, স্বজন প্রীতি, অগুনতি সামাজিক অপরাধ পাখা মেলেছে বাংলার আকাশে, সমাজের প্রতিটা স্তরে, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে।

গত একদশক যাবৎ প্রতি কথার শেষে আমরা ব্যবহার করি আরবি শব্দ। সুপ্রভাত, শুভ অপরাহ্ন, শুভরাত্রি এই সব বাংলা শব্দও হয়তো হারিয়ে যাবে একদিন এবং শুভাশীষ জানাবো আরবি শব্দ দিয়ে। প্রচলিত হবে হয়তো মুখে মুখে কোনো এক আরবি শব্দ বাংলার বিপরীতে। পোশাক ধারণ করেছি নেকাব, হিজাব, বোরকা, আলখেল্লা আর টুপিতে। আমাদের বাংলা কথা এবং লিখাও হয়তো হারিয়ে যাবে একদিন। মুখের ভাষা প্রকাশ করবো আরবিতে এবং মনের ভাব লিখবো আরবিতে।

ভালোবাসি এই বাংলাকে, ভালোবাসি এই মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। এই ভাষার কাছে আমরা ঋণী, এই দেশ মাতার কাছে আমরা ঋণী। ভালো লাগে না কলম ধরতে এই দুর্ভাগা দেশের সমাজের পচনশীলতার দিকটি তুলে ধরতে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নৈতিকতার অবক্ষয় সামাজিক অবক্ষয়ের রূপে পরিণত হয়েছে।

১৯৫২ সালের আন্দোলন ছিল বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি যেখানে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রহসন ছিল পশ্চিম পাকিস্থানীদের। এখন আরবি ভাষা ও সংস্কৃতির ভুত চেপেছে অনেকাংশে আপামর জন সাধারণের মাঝে। এই ভুত নামবে কবে আমাদের ঘাড় থেকে?