ভজন সরকার : একটি বই আমি প্রায়ই পড়ি। বইটির নাম ‘ আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’। লেখক নিরোদ সি চৌধুরী। নিরোদ সি চৌধুরী ভারতে তো বটেই বাংলাদেশেও সমালোচিত, আলোচিত, নন্দিত এবং নিন্দিত লেখক। ভদ্রলোক গত শতকের ৫০’এর দশক থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত লিখে গিয়েছেন। ১০২ বছর বেঁচে ছিলেন। শেষ বই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ৯৯ বছর বয়সে। ১৮৯৭ সালে জন্মেছিলেন। ১৯৯৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছিল ৫৪ বছর বয়সে। The Autobiography of An Unknown Indian বইটি প্রকাশের সাথে সাথে সারা বিশ্বে আলোচিত হয়েছিলেন তাঁর ক্ষুরধার লেখনি এবং বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণের গভীরতার জন্য। প্রথম বইটি প্রকাশের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরোদ সি চৌধুরী ভাষণ দিয়েছেন। বিখ্যাত সব প্রকাশনা থেকে তাঁর বই প্রকাশিত হয়েছে, আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছে। প্রধানত ইংরেজিতেই লিখতেন। ইংরেজিতে লেখা বই ১১টি। বাংলাতেও উল্লেখযোগ্য কিছু বই রচনা করেছেন। বাংলাতে লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম বাঙালি জীবনে রমনী, আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, আত্মঘাতী বাঙালি, আমার দেবোত্তর সম্পত্তি ইত্যাদি।

নিরোদ চন্দ্র চৌধুরী ব্রিটিশ কায়দায় নিরোদ সি চৌধুরী নামেই লিখতেন। তাঁর ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি এবং তীর্যক বাক্যবাণের জন্য ভারতবর্ষে ব্যাপক সমালোচিত ছিলেন। বাংলাদেশেও ৮০-র দশকে কলকাতার দেশ পত্রিকায় “তথাকথিত বাংলাদেশ” লিখে নিজে বিতর্কিত হোন এবং দেশ পত্রিকাও তখন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কলকাতার দেশ পত্রিকার অধিকাংশ পাঠকই তখন বাংলাদেশের। ফলে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরে দেশ পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পত্রিকাটির প্রকাশনা সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিক করতে বাধ্য হোন, যা এখন পর্যন্ত পাক্ষিক পত্রিকা হিসেবেই প্রকাশিত হচ্ছে। এতো সব বলার পেছনের কারণ, নিরোদ সি চৌধুরীর অপ্রিয় বাক্য এবং বিতর্কিত বিষয়বস্তু নির্বাচনকে বোঝানো। অপছন্দ করতে পারেন কিন্তু নিরোদ সি চৌধুরীর প্রজ্ঞা এবং বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অগাধ পান্ডিত্যকে কেউ-ই অস্বীকার করতে পারেননি।

অনেক বিষয়ে সহমত না হয়েও আমি নিরোদ সি চৌধুরীর অনেক বইয়েরই গুনমুগ্ধ পাঠক। তেমনি একটি বই ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’। মূলত বইটি লেখকের আত্মজৈবনিক হলেও বইয়ের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে জীবন সম্পর্কে সারা পৃথিবীর মনীষীদের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাচেতনা। সেই সাথে নিরোদবাবুর ঘাত-প্রতিঘাতময় জীবনের অভিজ্ঞতা। এক কথায় শতবর্ষী এই মানুষটির বেড়ে ওঠার খুঁটিনাটি জানার সাথে সাথে বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে প্রায় পুরো শতকের সমাজ এবং শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা মেলে এই বইটি পড়ে। সেই সাথে মানুষের জীবনযাপনের অন্তর্নিহিত একটা নিগূঢ় তত্ত¡ পাওয়া যায়। হয়ত অনেকেই এই ধারণার সাথে একমত না হ’তে পারি কিন্তু অবজ্ঞা করে পাশে সরিয়ে রাখার তেমন সুযোগ নেই নিরোদ বাবুর কোনো লেখাই।

নিরোদ বাবু তাঁর বইটিতে বলেছেন, মানুষের জীবন কি-ভাবে দেবোত্তর সম্পত্তি, সে কথা। যাদের দেবোত্তর সম্পত্তি সম্পর্কে ধারণা আছে তাঁরা জানেন, দেবোত্তর সম্পত্তি হলো ধর্মীয় কাজ সম্পাদন করার নিমিত্তে দানকৃত সম্পত্তি, যার ভোগদখলের অধিকার আছে কিন্তু বিক্রি কিংবা হস্তান্তরের অধিকার নেই। ইসলাম ধর্মে দেবোত্তর সম্পত্তির মতোই ওয়াকফ সম্পত্তি বলে একটি বিষয় আছে। দু’টোর নিয়মাবলি ও উদ্দেশ মূলত এক ও অভিন্ন।

মানুষের জীবন একটি বিশেষ প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। জন্ম থেকে মৃত্যু, মাঝখানের সময়ে আমাদের জীবন প্রবাহ। এই বহমান জীবন কিভাবে দেবোত্তর সম্পত্তির সাথে তুলনীয়? নিরোদ বাবু বলেছেন, “আমি মানুষকে দান এবং ঋণ গ্রহণকারী বলিয়া মনে করি। এই ঋণ শোধ করাই মানুষের কৃত্য। ইহা না করিলে সে অকৃতজ্ঞ হইবে, বিশ্বাসঘাতক হইবে”।

এই যে বলা হয়েছে “দান এবং ঋণ গ্রহণকারী” মানুষ- এ দান এবং ঋণ কা’দের জন্য এবং কা’দের প্রতি? সেটিই লক্ষ-কোটি টাকা মূল্যের প্রশ্ন। আস্তিক মানুষ মনে করেন অদেখা-অজানা কোনো ঈশ্বরের প্রতি মানুষ দান এবং ঋণ শোধ করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু যাঁরা এই তথাকথিত ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, তাদের দান এবং ঋণ শোধ করার দায়বদ্ধতা থাকে নিজের প্রতি। নিরোদ সি চৌধুরী খুব সুন্দর করে বলেছেন, “বিশ্ব মানুষের কাছে এই দাবী করে যে, বিশ্ব তাহাকে যে-শক্তি দিয়াছে সেই শক্তি দিয়াই বিশ্বের ঋণ শোধ করিবে।” এখানে বিশ্ব বলতে তিনি হয়ত প্রকৃতি, জীব এবং প্রাণীক‚লের কথাই বুঝিয়েছেন।

নিরোদ সি চৌধুরীর এই জীবন ভাবনার সাথে প্রাচীন অনেক ধর্ম এবং বিশ্বাসের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর ভাবনাও অনেকটা এমনই। জীবন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে এবং কবিতায় যা বলেছেন তার সারবস্তুও এ রকমই। আসলে ওই অদেখা-অজানা পারলৌকিক ঈশ্বরের প্রতি অহেতুক ভয়-ভক্তিকে সরিয়ে রাখলে মানুষ ইহজাগতিক শক্তিকে শ্রদ্ধা করতে শেখে। জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুকেই ঈশ্বর জ্ঞানে মান্য করতে শেখে। এ দর্শনটা খুব প্রাচীন এবং সহজাত।

ভারতবর্ষ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে প্রকৃতিকে ঈশ্বর জ্ঞানে প্রার্থনা করার দৃষ্টান্ত পেয়েছি। উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের প্রাচীন উপকথাগুলো শুনলে ভারতবর্ষের উপকথার হুবহু সঙ্কলন মনে করা অস্বাভাবিক নয়। এখানেও আদিবাসীদের উপকথাগুলো মানুষের জীবন ধারণের সাথে সম্পৃক্ত। তাই তো লেক বা সাগরের পাড়ের আদিবাসীদের সব উপকথা জলকে কেন্দ্র করে। যেমন পাহাড়ি উপকথা পাহাড় বা জংগল কেন্দ্রিক। আমি আশ্চর্য হয়েছি, শিকার করার সময় শিকারী পশুদেরকে কিভাবে সম্মান জানানো হয় সে কথা জেনে। একবার কানাডার ফার্স্টনেশন্স ওজেবয় আদিবাসীর কথা শুনে মনে হচ্ছিল আমি রামায়ণের বনবাস পর্বের কথাই শুনছি। অথচ প্রাচীনকালে এই দুই মহাদেশের সাথে কোনো যোগসূত্র থাকা কোনোমতেই সম্ভব ছিল না। তাহ’লে এই মিল কোথা থেকে এসেছে?

প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই যে সহজাত প্রবৃত্তিগত মিল, তার কথাই নিরোদ সি চৌধুরী ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’ বইয়ে লিখেছেন। ঈশ্বর বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী প্রতিটি মানুষের এই বইটি পড়া আবশ্যিক। জীবনে কিছুই হলো না ব’লে হা-পিত্যিস করা মানুষদের তো বটেই, যারা নিজেদের অবহেলায় নিজের প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভার অবমূল্যায়ন এবং অবহেলা করেন তাদেরই বইটি বেশী বেশী পড়া উচিত।

(ভজন সরকারঃ কবি,কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা )