শারমীন শরীফ : প্রকৃতি খুবই খেয়ালি! দু’হাত পেতে তাঁর কাছে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকলেও কিছু হবে না, যতক্ষণে না তাঁর মতি হবে। তাঁর যখন দেবার, তখন না চাইলেও সে দেবে। অযাচিত ভাবেই দেবে, সে সুখই হোক আর দুঃখই হোক, গ্রহীতার ধারণ ক্ষমতা নিয়ে তাঁর কোন মাথা ব্যাথা নেই। চাওয়া এবং পাওয়ার মাঝে বিস্তর ব্যাবধান। যখন যেটা প্রয়োজন নেই তখন হয়ত সেটা সামনে এসে হাজির হল, এখন সেটা নেব কি নেব না বা সেটা দিয়ে কি করব সে একান্তই আমাদের নিজস্ব সমস্যা। একটা সময় মনে হত ইশ, আমার যদি হীরের গয়না থাকত! হীরের কথা যখন ভুলে খেয়ে বসে আছি বা অনেকদিন পেরিয়ে যখন হীরের আর কোন গুরুত্বই নেই তখন হয়ত আমার সামর্থ্য হল বা কোনো কেরামতিতে সেটা হাজির হল সামনে কিন্তু তখন তো ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছে। সবার ক্ষেত্রে হয়ত ব্যাপারটা সমান নয়, অথবা উদাহরণটা সঠিক হয়নি।

আচ্ছা ধরুন যাকে মনে মনে বছর বছর ধরে খুঁজছেন, সে অসময়ে সম্মুখে এসে দাঁড়াল তখন কি করবেন? প্রকৃতির এই খেয়ালের কাছে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী, পৃথিবীর কোনো বিজ্ঞান এই রহস্যের সমাধান করতে পারবে বলে মনে হয় না, আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কোন ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে ঘটানো সম্ভব নয় মনে হয়। আমার জীবনে কোন কিছু সহজে আসেনি বা এখনো যা চাই সেটা পেয়েছি বলে মনে হয় না। আবার এও ভাবি আমাদের চাওয়ার যেমন শেষ নেই তেমনি চাওয়াগুলোও বয়সের সাথে পরিবর্তিত হয়ে যায়। আবার খেয়ালি মনের চাওয়ার জন্য বয়স কোন ফ্যাক্টর নয়, এদের চাওয়া বাতাসের গতির থেকেও দ্রæত পরিবর্তিত হয়। বেচারা প্রকৃতি হয়ত কুলিয়ে উঠতে পারে না। অনেক সময় মনে হয় আমরা আমাদের নিজেদের ভুলগুলো অন্য কারো ঘাড়ে চাপানোর চেস্টা করি, কাউকে খুঁজে না পেলে তখন অজানা কোন কিছুর ঘাড়ে চাপিয়ে দেই। যে ব্যাপারগুলোর উপরে আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, সেগুলো রহস্যের মাঝেই থেকে যায়।

সবাই তো আর আমার মত বসে বসে চাওয়া পাওয়ার হিসেব করে না, বা সময়ও নেই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর সব মানুষের জীবনে এমন কোন মুহূর্ত এসে যায় যখন সব বিশ্বাস কেমন তালগোল পাঁকিয়ে যায়। তখন অজানা কোন কিছুর উপরে ভরসা করতে ইচ্ছে করে। মনে হয় কোন দৈব শক্তি এসে সব ঠিক করে দিক।

সময় সব কিছু ঠিক করে দেয় আর এই ব্যাপ্তির মাঝে হারিয়েও যায় অনেক কিছু। মনির ভাই আমার জীবনে কেউ নন আবার তিনি আমার জীবনের একটি মাইল ফলকও বটে।
ভালবাসার বীজটি সেখানেই প্রথম রোপিত হয়েছিল যদিও সেটা অংকুরেই মরে গিয়েছিল কিন্তু লোক চক্ষুর অন্তরালে আমার হৃদয়ে সেটা অনেক গভীরে প্রোথিত ছিল, সযতেœ সেটা রাখা ছিল কোন একটি গোপন বাক্সে। আমার ব্যস্ত জীবনে সেখানে আমি কখনো উঁকি দিয়েও দেখিনি। একটা বয়সের পড়ে তাঁর কথা থেকে থেকেই মনে পড়ত কিন্তু তখন আমি দেশ ছেড়ে অনেক দূরে, ইচ্ছে হলেও যোগাযোগ করতে পারিনি। দূরে বসে জেনেছি তিনি সংসার করেছেন, দু’সন্তানের পিতা হয়েছেন, জেনে স্বস্তি পেয়েছি এবং সাথে আমার বান্ধবী এও জানিয়েছিল যে তিনি উচ্ছন্নে গিয়েছেন এবং বউ বাচ্চারা খুশি নয়। ওনার উচ্ছন্নে (?) যাবার জন্য কেন যেন সব সময়ে নিজেকে দায়ী মনে হত। আবার এও মনে হত তাঁর নিজের জীবনের চাবি তো তাঁর হাতেই ছিল, সাহস করলে বা ইচ্ছে করলেই তিনি ইতিবাচক ভাবে বদলে নিতে পারতেন নিজেকে, নিলেন না কেন? তাঁর বখে যাবার দায়িত্ব আমি কেন নিতে যাব? বখে যাবার বীজ ভেতরেই প্রোথিত থাকে উনি সেটা লালন-পালন করে বড় করেছেন মাত্র, সেখানে আমার কোন দায় নেই, কিন্তু মনের কোণার খচখচানি রয়েই গেল।
চোখের আড়াল হলেই নাকি মনের আড়াল হয়ে যায়! যায় কি? হয়ত ধুলো পড়ে যায়, কিন্তু মুছে যায় না। উনি কেউ না হয়েও আমার জীবনে প্রচন্ডভাবে নেই হয়ে থেকে গিয়েছেন। আমি অস্বীকার করে গিয়েছি বছরের পর বছর।

জানি, সে নেই
আসলেই কি নেই?
কিন্তু আমি জানি সে আছে,
আরো প্রকট আরো কাছে।

এই অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পাবার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এই পূর্ণ বয়সে এসে একজন দায়িত্বশীল মানুষের মত তাঁর কাছে আরেকবার ক্ষমা চাইবো। তখনো যোগাযোগের মাধ্যম চিঠিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমি ওনার ঠিকানাও জানতাম না আর পনেরো বছর পরে চিঠি লিখে কি ক্ষমা চাইবো? তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যখন দেশে যাব তখন বরিশাল গিয়ে গুলজার ভাইকে বলব ওনাকে ডাকার জন্য এবং সামনে বসে আমি নির্ভয়ে ওনার কাছে ক্ষমা চাইবো।

প্রকৃতি যেমন অসময়ে অনেক কিছু দেয়, আবার কখনো একেবারেই দেয় না। ২০০০ সালের কোন এক বৈশাখী ঝড়ের শেষে রাত ১টার কিছু পরে তিনি হাঁটছিলেন। যেখানে তিনি আমাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন সেই গলির বাঁক দিয়ে তিনি হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। ভীষণ ঝড়ে গাছের অনেক ডালপালা ভেঙ্গে ছড়িয়ে ছিল চারিদিকে। ভেজা অন্ধকার সেই রাতে তিনি যখন হাঁটছিলেন তখন নাকি ভীষণ রকম মাতাল ছিলেন। ভাঙ্গা ডালে জড়িয়েছিল ইলেকট্রিসিটির ছেঁড়া তার। সেই ঝড়ের রাতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি জড়িয়ে নিয়েছিলেন মৃত্যুকে, যে মোড়ে আমার সাথে শেষ দেখা সেই মোড়ে দাঁড়িয়েছিল মৃত্যুদূত। আমি যখন রুনুর চিঠিতে পেয়েছিলাম তাঁর মৃত্যু সংবাদ, বজ্রাহত হয়ে আমিও বসেছিলাম অনেকক্ষণ। কেঁদেছিলাম কি? না, মনে হয়, কাঁদিনি! ভেতরটা শুকিয়ে গিয়েছিল। ক্ষমা চাওয়া আর হল না, সে সুযোগটা প্রকৃতি আমাকে দিল না। অনেককিছু বলব ভেবেছিলাম কিন্তু কিছুই বলা হলনা। বুকের ভেতরে ছোট্ট যে ঘরে তাঁর বাস সেখানে সাজিয়েছি তাঁর সমাধি আর সাথে চাপা দিয়েছি সব না বলা কথাগুলো। কলেজ ছুটিতে মোড়ের বাঁকে সেই এক ঝলক দেখাই ছিল তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা। তিনি মরে গিয়ে বেঁচেছেন আর আমি কি থেকে বেঁচেছি জানি না। প্রকৃতি হয়ত চায়নি আমি নতুন করে আবার নিজের কবর খুঁড়ি। আমি হয়ত তাঁকে ভালোবাসিনি কিন্তু তাঁর ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না।

মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় মগজের ছুইচটা অফ করে দেই। ইচ্ছে করে সব কিছু আঁধার করে আমিও নেই হয়ে যাই খানিক্ষনের জন্য, কিন্তু নিজের কাছে কি নেই হয়ে থাকা যায়? অস্বিত্ব জানান দেয়, সে আছে, প্রবল না হলেও উজ্জ্বল রুপে সে আছে! জীবন ও জগৎ বস্তু বটে কিন্তু সে সহজ বস্তু নয়, সে ভীষণ জটিল বস্তু। জীবন জানান দেয় সে এক অজ্ঞেয় রহস্যের আঁধার, এক মহা শক্তির উৎস, শূণ্য থেকে যার শুরু আর শূণ্যেই শেষ।