ইউসুফ কামাল : জীবনের মূল সূত্র হারিয়ে গেলেও টুকরো কিছু স্মৃতি একত্রিত হয়ে আবার মূল সূত্রের কাছাকাছি নিয়ে আসে। যুদ্ধ শেষে সবাই ফিরে এলো দেশে আর যারা দেশ মাতৃকার জন্য জীবন দিয়ে শহীদ হয়ে গেল, তাদের জন্যে প্রার্থনা করে বাকী সবাই নিজ নিজ পেশায় ফিরে গেল। দেশে ফিরে দেখলাম অনেকেই ফিরে এসেছে আবার তার মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন কারণে আর দেশে ফিরে আসেনি। আমার নিজের মহল্লায় উর্মিলাদের খোঁজ করতে দেখলাম অনেকের মতো ওরাও আর ফিরে আসেনি। ওদের বাড়ী মানুষ জন শূন্য। ওদের ঘড়ের অবস্থাও বেশি ভালো না, ঘড়ের কিছু কিছু জিনিষ পত্র ইতিমধ্যে খোয়া যেতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বেশি দিন রাখা যাবে না, ভাবলাম কিছু একটা করা দরকার। স্থানীয় গণ্যমান্য সবাইকে দিয়ে প্রমিলা আর রফিককে ডেকে আনা হলো। কি করা যায়, নরেশ বাবুর দুই কন্যাই তার আইনগত ওয়ারিশ অতএব সিদ্ধান্তের মালিক তাঁরাই। দীর্ঘ আলোচনার পর সবার সম্মতিতে বড় মেয়ে প্রমিলাকেই বাড়ীর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হলো। তাতে বাড়ীটা রক্ষা পেলো, মালামাল চুরি হওয়াও বন্ধ হলো। উর্মিলাদের বাংলাদেশে না ফেরার কারণের মধ্যে নরেশ বাবুর মানসিক কষ্টের কথা আমার কাছে প্রথম এবং প্রধান কারণ মনে হলো। মেয়ের ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া কোন পিতার পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। উনসত্তর এর আন্দোলন মুখর দিনের এক সকালে সবাই শুনেছিলাম নরেশ বাবুর বড় মেয়ে প্রমিলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় যেতে পারে সবাই এ নিয়ে আলোচনায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবরক্ষক নরেশ গুহ নিরীহ প্রকৃতির মানুষ, দশটা পাঁচটা অফিস আর বাজার করা ছাড়া কোথাও যেতেন না। বাইরের লোকজনের সাথে খুব একটা মিশতেন না। উনি খুব ভেংগে পড়লেন। মাথা নীচু করে অফিসে যাওয়া আসা করতেন, কারো দিকে মুখ তুলেও চাইতেন না। পাড়ার যুবক সবাই লেগে পড়লো প্রমিলার খোঁজে, বাড়ীর সবাই বিমর্ষ মুখে বসে আছে, হঠাৎ করে কোথায় গেলো মেয়েটা! বান্ধবীদের মুখে তালা কেউ কোন কথা বলছে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আসল খবর বেড়িয়ে পড়লো, ওদের গানের শিক্ষক রফিকের সাথে নাকি সর্বশেষ রিক্সায় মজমপুর এর দিক যেতে দেখা গেছে। যোগ ফল সবার বোঝা হয়ে গেলো, গানের সুরের সাথে দু’জনের মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেছে। নরেশ বাবুর শক্ত কথা, কেউ যেন আর ওর কোন খবর না নেয়। প্রমিলার সাথে বাড়ীর কারোই আর কোন যোগাযোগ থাকলো না। আমরাও চলে গেলাম স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ভারতে, নরেশ বাবু তার দ্বিতীয় কন্যা উর্মিলা আর স্ত্রীকে নিয়ে পশ্চিম বাংলার নৈহাটীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।

এর পর পার হয়ে গেল কয়েকটা বছর, আমি স্থায়ীভাবে ঢাকাতে থাকা শুরু করলাম। বছরে দু’এক বার দেশে যেতাম অর্থাৎ কুষ্টিয়ায় যাওয়া হতো আমার। আমার বাড়ী যাওয়ার পথেই উর্মিলাদের বাড়ী পড়তো, মানে বর্তমানে প্রমিলাদের বাড়ী। একবার ওদিক দিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়ে গেলো উর্মিলার কথা, ব্যাডমিন্টন খেলা আর আড় চোখে চাওয়া। খুব জানতে ইচ্ছা হলো উর্মিলার কথা, কেমন আছে ও? প্রমিলা হয়তো বলতে পারবে! একটু দ্বিধান্বিত পায়ে এগিয়ে যেয়ে কড়া নাড়লাম সেই পরিচিত ঘরের দরোজায়। প্রমিলা হয়তো রান্না ঘরে ছিলো একটু পরে দরোজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ালো। চিনতে পারলো, বল্লো, কেমন আছেন? কোথায় থাকেন এখন? কোনদিন কথা হয়নি কিন্তু এখন কোন জড়তা দেখলাম না প্রমিলার মধ্যে। সামনে বসে দীর্ঘ দিনের পরিচিত মানুষের মতো সব কথা বলে গেলো। কন্ঠে আন্তরিকতার ছাপ স্পষ্ট। একই এলাকায় আমরা বড় হয়েছি, কথাবার্তা হয়নি কখনো কিন্তু উভয়ই উভয়ের পরিচিত। তখনকার দিনে এমনই ছিলো, সবাই সবাইকে যথেষ্ট সমীহ করে চলাফেরা করতাম। এলাকার মেয়ে বলে একটু ভিন্ন চোখেই দেখতাম। বল্লো, বাবা এখান থেকে যাওয়ার এক বছরের মাথায় মারা গেছেন, হয়তো আমার উপর কষ্ট পেয়েই। বাবা তো! বাবারা সব সময়ই সন্তানদেরকে বেশি ভালোবাসেন। আমার সন্তান হয়েছে আমি এখন বুঝি, বাবা মা’র কষ্টটা কি? আর উর্মিলা বছর দুই আগে স্কলারশীপ নিয়ে আমেরিকা চলে গেছে ঠিক কোন ষ্টেটে আছে আমি বলতে পারবো না। মা নৈহাটিতে আমার নানা বাড়ীতেই আছে, আমার উপর উনার এখনো রাগ কমেনি। প্রমিলা যোগ করলো, তবে যে যেখানে থাকুক সবাই ভালো থাকুক আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি। চা খেয়ে ওখান থেকে বের হোয়ে আসলাম, হাঁটতে হাঁটতে পুরনো স্মৃতিগুলো নতুন করে আবার মনে ভীড় জমালো। সেই ব্যাডমিন্টন কোর্টে নতুন ছেলেদের খেলা দেখলাম। কোন কিছুই যে কারো জন্য স্থায়ী না, পুরনোদের স্থান নতুনরা দখল করে নেবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখলাম ঠিক যেখানে উর্মিলা দাঁড়িয়ে রোজ আমাদের খেলা দেখতো, পুরনো সেই দিনগুলোতেই যেন হারিয়ে গেলাম। উর্মিলাকে আবার নতুন করে যেন মনে করতে চেষ্ট করলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালের সেই ভয়াল সময়ে ভারত যাওয়ার সময় কোর্ট কুষ্টিয়ার রেল ষ্টেশনে ভীড়ের চাপে বাবা মা ‘র কাছ থেকে উর্মিলার হারিয়ে যাওয়া আবার খুঁজে পাওয়া, দর্শনা থেকে হাঁটা পথে ভারতের ‘গেদে’ ষ্টেশনে পৌঁছানো। ওদের নৈহাটি চলে যাওয়া আর যাওয়ার সময়ের সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ‘বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে’। সব ধীরে ধীরে মনে পড়ে গেলো।

দীর্ঘ জীবনের হাজারো ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে কিছু ঘটনাই তো চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকে, যা মন থেকে কখনোই হারায় না। পুরনো স্মৃতি কি সহজে মানুষ ভুলতে পারে? সেই উর্মিলাকে আবার ফিরে পেলাম হিউষ্টনের মেথডিষ্ট হাসপাতালে আমারই চিকিৎসার সময়। হয়তো ভাগ্যে এমনই লেখা ছিলো না হলে এমন হবে কেন? কোথায় বাংলাদেশের ছোট্ট জেলা শহর কুষ্টিয়া আর কোথায় আমেরিকার তেল সমৃদ্ধ শহর হিউষ্টন। এক যুদ্ধের সময় শেষ দেখা হয়েছিলো, কে জানতো বিদেশের মাটিতে জীবনের এই সন্ধিক্ষনে আবার দেখা হয়ে যাবে। এক যুদ্ধের সময় শেষ দেখা হয়েছিলো পরবর্তিতে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসারত অবস্থায় পুনরায় দেখা হয়ে গেল। কি বিচিত্র সৃষ্টিকর্তার খেলা। জীবন কাহিনী যেন নভেল নাটকের চেয়েও বিচিত্র। কৈশর জীবন থেকে যৌবনের অলিন্দ গলিয়ে ছুটে চলা স্বর্ণালী মুহূর্তগুলোকে সাথী করেই যেন চলার পথকে খুঁজে নিতে হয়। আর এই চলার নামই তো জীবন, আর এমনি ঘটনা প্রায় সবার জীবনেই কম বেশি আছে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ