ইউসুফ কামাল : দেখতে দেখতে দুই মাস পার হয়ে গেলো আমার আমেরিকায় আসা, আশেপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলো মোটামুটি ঘুরে দেখেছি। লুরে ক্যাভানস্, ভার্জিনিয়া বীচ, ওয়াশিংটন ডিসিসহ অন্যান্য জায়গা দেখার পরে ভাবলাম সমুদ্র-পাহাড়ের ভিতরের দর্শনীয় জায়গাগুলোকে এরা এমনভাবে দর্শনীয় করে রেখেছে যে টুরিস্টরা দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে এ দেশের সৌন্দর্যময় স্থানগুলো অবলোকন করতে। পর্যটকদের টেনে আনার কোন চেষ্টা এরা বাকী রাখে না, প্রাচুর্যের সাথে আধুনিক প্রযুক্তির মিশ্রন ঘটিয়ে নানা রকম চিত্তাকর্ষক স্পট এরা সৃষ্টি করেছে যা দেখতে মানুষকে আসতেই হবে।

টুরিস্টদের আকৃষ্ট করার নানাবিধ পন্থা প্রয়োগে এরা খুবই পারংগম। বিশেষ করে লুরে ক্যাভানস্, মাটির নীচের গুহায় বরফকে ক্রীষ্টাল আকারে সজ্জিত করে-সেটার তাপমাত্রা ক্রীষ্টাল উপযোগী করে রাখার মুন্সিয়ানা নিখুঁত করে সম্পন্ন করেছে এরা। সঠিক তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে রেখেছে, যার ফলশ্রুতিতে বরফের উপর কোন বিরুপ প্রভাব পড়ে না আর তার ফলশ্রুতিতে সামান্যতম বরফও গলে না।

এত দূরে এসেছি উপরন্তু বন্ধুর কাছে যাবো না তাই হয় নাকি, মনের কথা মেয়ে’কে বলতেই এক কথাতেই সে সমর্থন করলো। ফোন করে কানাডাগামী গ্রেহাউন্ড বাসের টিকিট বুক করে দিলো। পরেরদিন বিকেল পাঁচটায় গ্রেহাউন্ড কোম্পানীর নিজস্ব বাস ষ্ট্যান্ড ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বাসে রওয়ানা হলাম টরেন্টোর উদ্দেশ্যে। গাড়ী নিউইয়র্ক ছাড়া আরো দুই/তিনটা স্টপেজে থেমে যাত্রী ওঠানামা করলো। সারা রাত পাড়ি দিয়ে সকালে বাফেলো পার হয়ে কানাডার বর্ডারে গিয়ে বাস থামলো। বাস থেকে নেমে সবাই পাসপোর্ট, গ্রীন কার্ড দেখিয়ে কানাডার ভ‚মিতে ঢোকার অনুমতি সংগ্রহ করলো। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আমার গ্রীন কার্ড দেখে প্রয়োজনীয় দুএকটা কথা জিজ্ঞাসা করে ছেড়ে দিলো, খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার ঐ একই বাসে চড়ে কানাডার মূল ভ‚খন্ড টরেন্টোয় প্রবেশ করলাম। অহেতুক কোন রকম সময় নষ্ট না করার বিষয়ে এরা যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

বিচিত্র অনুভ‚তি নিয়ে ঘন্টা দুই টরেন্টো অভিমুখে গাড়ী চলার পর নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামলো, নতুন জায়গা নতুন কৌতুহল মনের মধ্যে। বাস থেকে নেমে ফোনে বন্ধুকে আমার পৌঁছার সংবাদ জানালাম, দু’জনই বেশ উত্তেজিত। বল্লো, ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ঠিকানা বল্লেই সে নিয়ে আসবে। আমি বাসার সামনে থাকবো, সমস্যা নাই। সমস্যা হলে অবশ্যই ফোন করবা। ইয়েলো ক্যাব দাঁড়িয়ে ছিলো, শিখ গাড়ী চালককে ঠিকানা বলতেই সে নেমে দরোজা খুলে লাগেজ গাড়িতে তুলে নিলো। ড্রাইভার সীটে বসে ম্যাপের বই খুলে বসলো (তখনও জিপিএস সম্বলিত ফোন চালু হয়নি, অবশ্য আমেরিকায় টমটম ম্যাপ বক্স চালু হয়েছে দেখেছি অল্প বিস্তর)। বেশ অস্বস্থিবোধ করছিলাম, আবার ভুল ঠিকানায় নিয়ে যাচ্ছে না তো! মিনিট কুড়ি চলার পর দূরে একটা রাস্তার ফুটপাতে বন্ধু বিদ্যুৎকে দাঁড়ানো দেখলাম, বুঝলাম চলে এসেছি। মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে ঠিক বন্ধুর কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো, ইংরেজীতে আমাকে বল্লো, এটাই আপনার গন্তব্যস্থল। ড্রাইভার গাড়ী থেকে নেমে গাড়ীর ট্রাংক থেকে লাগেজ বের করে আমার হাতে দিলো। মিটার দেখে ভাড়া নিয়ে চলে গেলো। দীর্ঘ দিনের বিরতিতে বন্ধুর সাথে দেখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু যার সাথে জড়িয়ে আছে হাজারো স্মৃতি। বিশেষ করে ‘৭৫ এর ১৫ই আগষ্টের কাল রাত্রির পূর্ব ও পরবর্তি সময়ের দু:খ বিজড়িত নানা অবিশ্বাস্য ঘটনাবলী। রাতে আমার বকশিবাজারের বাসায় থেকে ভোরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে না পারার দু:খজনক ঘটনা। অমনি হাজারো টুকরো ঘটনা জড়িয়ে আছে আমাদের দু’জনের মধ্যে। সেই ‘৭২ থেকে অদ্যাবধি এক সপ্তাহও মনে হয় আমাদের বাক্য বিনিময় বন্ধ থাকেনি। কাছেই বিদ্যুতের বাসা ১০ মেসি’র ৫ম তলা। ও দূর থেকে হাতের ইশারায় আমাকে দেখিয়ে দিলো।

এক কন্যা আর স্ত্রী নিয়ে সুখের সংসার আমার বন্ধুর। সুখের যেনো কোনো ঘাটতি নেই ওখানে, সব সময়ই হাসি খুশীতে ভরপুর। স্বামী স্ত্রী দু’জনই যেন একে অন্যের পরিপূরক, হরিহর আত্মা। রাতভর দু’বন্ধুর গল্প। কত গল্প – এ যেন শেষ না হওয়া গল্পের ফুলঝুড়ি, গল্প তো নয় বলা চলে স্মৃতি চারণ। যার শাখা প্রশাখা বিস্তৃত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের ভালো লাগা সাথীরাও চলে এলো দু’জনের আলাপে। নানা রং বেরং এ জড়ানো ঘটনাবলী উঠে এলো আমাদের দু’জনের আলোচনায়। কে কাকে পছন্দ করে, কে তার পছন্দের মানুষ নিয়ে আইইআর এর ক্যান্টিনের নিরিবিলিতে বসে, এমনি নানা গল্পে রাত প্রায় ভোর হয়ে এলো। কত স্মৃতিময় সেই দিনগুলো টিএসসি’র ক্যাফেটেরিয়ায় দুপুরের লাঞ্চ শেষে পড়ন্ত দুপুরে বসে পড়তাম টিএসসি’র উন্মুক্ত ঘাঁসের লনে। তারপর চলতো অসমাপ্ত গল্প, যা কখনোই শেষ হতো না। কত মিষ্টি মধুর আলাপন, মাঝে মাঝে আলম তার প্রেমিকাসহ আলাপে অংশ নিতো। আবার সন্ধ্যায় যার যার মতো আশ্রয়ে ফিরে যেতাম সবাই। মিষ্টি মধুর স্বপ্ন নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকতাম। আমাদের দিন শেষ হতো পলাশীর বিউটি রেস্টুরেন্ট এ সম্মিলিতভাবে চা খাওয়ার মধ্যে দিয়ে।

পরিচিত নামগুলোও স্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছিলো, আবার ফিরে এলো বন্ধুর আলাপে-যারা ডিপার্টমেন্ট থেকে লেখাপড়া শেষ করে সংসারী হয়েছে। বিদ্যুৎ বল্লো, আর তোমার চশমা ওয়ালী? বল্লাম, আমার মতো ভীরু প্রকৃতির মানুষ, আমার ভলো লাগার কথা তাকে বলতে না পারার গøানির কথা বলে, নতুন করে আমাকে খোঁচা না দিলেও পারতে বন্ধু? বল্লাম, এ যেন চলার পথে হারিয়ে যাওয়া এক পথিকের কাছে পুনরায় সেই পথের সন্ধান জানতে চাওয়া!

আমার কথায় বিদ্যুৎ কথা না বাড়িয়ে শুধু বল্লো, সময়কে তো আমরা ধরে রাখতে পারিনি বন্ধু। পরের দিন সকালে মেয়েকে ফোন করে পৌঁছানোর খবর জানিয়ে বল্লাম, একদিন পর নায়াগ্রা ফল দেখতে যাবো। বিদ্যুৎ যে আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেটা আমার মেয়ে জানে, বল্লাম দুই তিন দিন পরে চলে আসবো। সব শেষে মেয়ে বল্লো গতকাল বারোটায় এম্বুলেন্স’ এর হর্ণের আওয়াজে বাইরে এসে দেখি আমাদের নেইবার বারবারাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। শংকা নিয়ে এগিয়ে গেলাম ও তো একা থাকে, দেখবার তো কেউ নাই, কি হলো হঠাৎ করে। আমাকে দেখে বারবারা ধীর কন্ঠে বল্লো, শরীরটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। একটু খেয়াল রেখো আমার এ দিকটা, ভালো লাগলেই চলে আসবো। সকালে ডায়ালাইসিস নেওয়ার পর থেকেই কেন জানি না ভালো লাগছিলো না।

পার্স খুলে ঘরের চাবি হাতে দিয়ে বল্লো, তোমার কাছে রাখো। আর আমার একটা কাজ করে দিও, আমি দুই দিনের মধ্যে না ফিরলে কাউন্ট্রিতে ফোন করে দিলে ওরা এসে ‘জিমি’কে ওদের জিম্মায় রেখে দেবে। আমি দুদিনের খাবার দিয়ে গিয়েছি।

বুঝলাম বারবারা’র এমারজেন্সী কলে এমবুলেন্স এসে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো, বেচারার এখানে কেউ নেই একদম একা। হঠাৎ করে যদি কিছু হয়ে যায়? (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ