ইউসুফ কামাল : সকালে ঘুম ভাংগতেই বাইরে ঝুম বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে পেলো অভি। জুন মাসের গরম, বৃষ্টি হলে এমনিতেই গরম কমে লাগে তার উপর মাথার উপর চলা ফুল স্পীডের ফ্যানের বাতাস। অভি’র একটু শীত শীতে লাগলো, আরো একটু ঘুমাতে পারতো। ফ্যানটা কমানোর জন্য উঠতে হলো। ঘড়ি দেখলো সকাল আট’টা। ঢাকা যাওয়ার পর সকাল সাতটার মধ্যেই উঠে কেন্টিনে যেয়ে নাস্তা সেরে সাড়ে আট‘টার আগেই ক্লাসের উদ্দ্যেশে বেরিয়ে পরতে হয়। এটাতেই অভি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গতকাল ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির আগের দিন, প্রয়োজনীয় ক্লাস শেষ করে হলে যেয়ে বই পত্র গোছগাছ করে বিকেলের দিকে অভি বাস ধরে বাড়ী চলে এসেছে। কোন রকম বিশ্রাম নেওয়া হয়নি, ক্লান্ত শরীর নিয়ে পরিবারের সবার সাথে কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পরেছিলো নিজের ঘরে নিজের বিছানায়। নিজের বিছানা, অভি’র কাছে সব চেয়ে প্রিয় কয়েকটা জিনিষের মধ্যে একটা।

নিজের বিছানা দেখলেই ওর একটু ঘুমিয়ে নিতে ইচ্ছা করে, এ ইচ্ছাটা ওর ছেলেবেলা থেকেই। মনে হয় বিছানা যেন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অভি এমনিতেই একজন ঘুম প্রিয় মানুষ, ও নিজেও সেটা ভালো করে জানে। কাল সন্ধ্যায় ঢাকার বাস থেকে নেমে অভি আর কোথাও না যেয়ে সোজা বাড়ীতে চলে এসেছিলো। রোজা’র ঈদের লম্বা ছুটিতে বাড়িতে আসার কারণে ব্যাগের ওজন একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিলো, ভারী ব্যাগ নিয়ে আর বন্ধুদের আড্ডায় যাওয়া হয়ে ওঠে নাই। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে বৃষ্টিটা ধরে এলো, জুন মাসের বৃষ্টি বেশি ক্ষন স্থায়ী হলো না। বৃষ্টি থেমে যেতেই অভি বিছানার মায়া ত্যাগ করে উঠে পড়লো, হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে নিলো বাইরে বেরোনোর জন্য। অভি কয়েক দিন ধরেই ভিতরে ভিতরে বেশ তাগিদ অনুভব করছিলো রিয়া’কে দেখার জন্য। রিয়া কেমন আছে? অভি ভাবলো রিয়ার বান্ধবী ছবি’র সাথে দেখা করে রিয়া’র খবর নিলে কেমন হয়! ছবি ছাড়া ও আর তেমন ভালো মাধ্যম খুঁজে পেলো না।

অভি সেই যে প্রথম পরীক্ষার দিন ঢাকা চলে গিয়েছিলো তারপর থেকে রিয়া’র আর কোন খবরই সে জানে না। রিয়া ভালো আছো তো ? ছবি’র বাড়ীর দরোজায় নক্ করতেই ছবি এসে দরোজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ালো। অভিকে দেখেই হেসে জিজ্ঞেস করলো, ভাই ঢাকা থেকে কবে এসেছেন? রিয়া’র সাথে কি দেখা হয়েছে? অভি বল্লো, দেখা করতেই তো আসলাম, তোমার এখানে আছে ভেবেই তো হাজির হয়েছি। ডাক দাও কথা বলে চলে যাই, কতো দিন কথা হয় না। ছবি হেসে বল্লো, দেখা করতে হবে তাইতো, বুঝেছি।

ভিতরে আসেন, আপনি তো আমার বাসায় কখনোই আসেননি। ছবির ঘরটা পরিপাটি করে সাজানো গোছানো, ভালোই লাগলো অভি’র কাছে। ছবি দৌড়ে যেয়ে তাড়াতাড়ি করে চা এনে দিয়ে অভি’র মুখোমুখি বসলো। অভি’র চা খাওয়া শেষ হয়ে গেল অথচ ছবি কোন কথা বলছে না। অভি’র সন্দেহ হলো ছবি যেন কিছু বলতে ইতস্তত বোধ করছে, কিন্তু বলতে পারছে না। অভি ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ছবি তুমি কি কিছু বলতে চাইছো? রিয়া কেমন আছে? ছবি যা বল্লো তা শোনার জন্য অভি মোটেই প্রস্তুত ছিলো না, কথাগুলো শুনে অভি চুপ হয়ে গেলো।

তাৎক্ষনিকভাবে বলার মতো কোন কথাই সে খুঁজে পেলো না। শুধু বল্লো, এতো তাড়াতাড়ি কেন? ছবি একটু চিন্তা করে বল্লো, পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পরেই রিয়া’র বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাইছে ওর বাবা মা। পাত্র দেখা শুরু হয়ে গিয়েছে মাস খানেক ধরেই। হয়তো আর এক মাস পরেই পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়ে যাবে, আর তার পরেই সম্ভবত: বিয়ের কাজটা সেরে ফেলবে ওর পরিবার। পরিবারে ওরা অনেকগুলো ভাই বোন। এক মাত্র ছেলেকে ঢাকায় রেখে ওর পরিবার তার পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন, ছেলের পিছনে অনেক খরচ। ছোট খাটো সরকারী চাকুরী জীবি ওদের বাবা, সীমিত উপার্জন দিয়ে সবার পড়ালেখার খরচ চালাতে পারবেন না। তাই পরিবারের সবাই এক সাথে বসে রিয়া’র বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর রিয়া’রও এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিইবা করার আছে? অভি কি বলবে, ভেবে চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ। ছবি ও মাথা নীচু করে বসে আছে, ঘরের মধ্যে একটা নিস্তব্ধ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

অস্বস্তিকর পরিবেশটা কাটাতে অভি বল্লো, ছবি আমি উঠি পরে দেখা হবে। ছবিও হঠাৎ করেই যেন স্থবির হয়ে গেছে।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো মুখে অস্ফুট স্বরে শুধু বল্লো, আচ্ছা। ছবির বাসা থেকে বেরিয়ে এসে অভি’র মনে হলো একটু হাঁটি, হাঁটলে হয়তো ভালো লাগবে। কয়েকটা খালি রিক্সা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেল বাজিয়ে জানান দিলো। অভি ওদিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটতে লাগলো। কি করবে অভি, এটা তো জীবনের বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। লেখাপড়ার শেষ প্রান্তে তো এখনও সে পৌঁছাতেই পারে নাই তাহলে কি হবে? রিয়া’র মুখের দিকে তাকিয়ে সে কি বলবে? ভালোবেসে দায়িত্ব নেবার মতো সামর্থ তো অভি’র এখনো হয়নি, তাহলে? এই তা’হলের সদুত্তর তো অভি’র এখনো জানা নাই। রিয়া’র পক্ষেই বা এখন বিকল্প চিন্তা করার মতো কিছু আছে কি? পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে সে এখন কি করে যাবে? অভি’র চিন্তার সীমারেখা বেশি দূর এগোতে পারলো না, রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি অভি, কি করবে সে এখন? দুই দিন পর অভি’র সাথে দেখা হলো ছবি’র । সম্ভবত কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলো মার্কেটে, রিক্সা দাঁড় করিয়ে পরের দিন সকাল দশ’টায় বাসায় আসতে বলে ছবি বিদায় নিলো। অভি বুঝলো রিয়া আসবে, অভি কি বলবে? ভেবে সারাদিন কাটিয়ে দিলো। এখন ওর কি করা উচিত?

পরদিন ইচ্ছা করেই একটু দেরী করে অভি ছবি’র বাসার দরোজায় নক্ করলো। ঘরে ঢুকেই দেখলো রিয়া শান্ত ভাবে বসে আছে চেয়ারে, ছবি দরোজা বন্ধ করে ওর পাশের চেয়ারে যেয়ে বসলো। কারো চোখে মুখেই অভি কোন রকম অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পেলো না। অভি দেখলো রিয়া ওর দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে কিছু যেন দেখছে, চোখ মুখের অবস্থা স্বাভাবিক।

রিয়া’র এই চেহারা দেখে ভিতরে ভিতরে অভি কিছুটা অবাকই হলো। ¤øান হেসে রিয়া বল্লো, খুব চিন্তায় পড়ে গেছো তাই না? এতো চিন্তা করছো কেন? ছবি আমাকে সব কিছুই বলেছে। তোমার মলিন চেহারা দেখে আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগছে, মন খারাপ করে থেকো না। আমার কিছু হবে না। আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করো না, আমি ভালোই থাকবো। মন দিয়ে পড়া শোনা করো, আমার জন্য তোমার জীবন শুরুতেই বাধার মধ্যে পড়ুক সেটা আমি চাই না। আমি সব সময়ই তোমার ভালো চাই। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাবো বলো!

অভি গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে দেখলো রিয়া’কে, বয়সের চেয়েও রিয়াকে এখন অনেক বড় মনে হলো। খুঁজে পেতে পেতে চেষ্টা করলো ওর মনের ভাষা। হঠাৎ করেই রিয়াকে ওর কাছে দূর্বোধ্য মনে হলো।
এখন তাহলে কি করতে চাইছে রিয়া? (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেল সিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ