হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি বা ইউনেপ বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করার জন্য একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে। মূলত পরিবেশ বিষয়ে বিশ্ববাসীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিই এই দিবস পালনের লক্ষ্য। তার প্রেক্ষিতেই প্রতিবছর বিশ্বের সার্বিক পরিবেশ-স্বাস্থ্য নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দাঁড় করানো হয় থিম বা প্রতিপাদ্য। কখনও সেটা হয় কোনো সুনির্দিষ্ট সমস্যা নিয়ে, কখনও বা বিশ্বজনিন সমস্যা কিংবা কখনও মানবজাতির প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন সমস্যা নিয়ে। অতীতে এরকম বহু বিষয়ের ওপর প্রতিপাদ্য স্থির করে পালিত হয়েছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। সাগর-নদী নিয়ে, অরণ্যকে নিয়ে, জলবায়ু ও জলাভূমিকে কেন্দ্র করে, ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতাকে ঘিরে। এরকম অনেক।

ক্ষুদ্র দ্বীপদেশ নিয়ে ২০১৪ সালে প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘Raise Your Voice, Not the Sea Level.’ সেইবারের প্রতিপাদ্য বিশ্বের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রসমূহকে (স্মল আইল্যান্ড ডেভেলপিং স্টেটস) বা সিডস-কে ঘিরে নির্ধারিত হয়েছিল। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়ন অর্জনে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বৃদ্ধি দ্বীপদেশসমূহের জন্য অভূতপূর্ব এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই বিষয়টি তুলে ধরতেই বেছে নেয়া হয়েছে এমন একটি প্রতিপাদ্যকে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় বিশ্বের কমবেশি সব দেশই ভুগবে, কারণ এটি বায়ুমণ্ডলীয় তথা বৈশ্বিক সমস্যা। তারচেয়েও বড় কথা, ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চললে বিশ্বের দ্বীপদেশগুলো আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রতলে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।

শিল্পবিপ্লব ও বিপ্লব পরবর্তী কার্বন ডাইঅক্সাইড ও ক্ষতিকর বিবিধ গ্যাস ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি অতিমাত্রায় নিঃসরণের ফলে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বব্যাপী সেটার কুফলে কমবেশি বিশ্বের সব দেশ বা জাতিই ভুগছে। বেশি ভুগছে দরিদ্র ও ভৌগোলিকভাবে বেকায়দায় অবস্থিত দেশগুলো, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স বিশ্বের ৫২টি ক্ষুদ্র দ্বীপদেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই দ্বীপরাষ্ট্রসমূহ তিনটি ভৌগোলিক অঞ্চলে বিভক্ত: ক্যারিবিয়ান ও প্যাসিফিক, আফ্রিকা, ভারত মহাসাগর ও ভূ-মধ্য সাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগর। এসবের কতিপয় দেশ আবার স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে। যেমন- ভানুয়াটো, টুভালো, সলোমন আইল্যান্ডস প্রভৃতি। সাগরের স্ফীতি হলে এইসব দেশ সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ অ্যাডেপ্টেশন বা মানিয়ে নেয়া কিংবা সাগরস্ফীতি রোধে সক্ষমতা অর্জন বা সাবধানতা অবলম্বনের মতো সম্পদ বা সামর্থ্য এসব দেশের নেই। উপরন্তু, টেকসই উন্নয়ন অর্জন ও বিশ্বের উন্নত দেশের মর্যাদা পাবার জন্য তাদের প্রচেষ্টা বিঘ্নিত হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধিজনিত সাগর স্ফীতি যে ঘটছে- সেবিষয়ে বিশ্বের জলবায়ু বিজ্ঞানীরা এখন নিশ্চিত। ভবিষ্যতে এই স্ফীতি বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই আঘাত করবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে দ্বীপদেশসমূহকে। বিশেষত মালদ্বীপ বা ভানুয়াটোর মতো দেশ চরম হুমকির মুখে রয়েছে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস মতে, ক্রমাগত উষ্ণতাবৃদ্ধি বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তনসহ অধিক ভারী বৃষ্টি ও ঘন ঘন সাইক্লোন ও হারিক্যানের সৃষ্টি করবে। ফলে ক্ষুদ্র দ্বীপদেশসমূহের পর্যটন শিল্প ধসে পড়বে। তাদের কৃষি ও পশুসম্পদ ধ্বংসের মুখে পড়বে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সাগর পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র দ্বীপদেশসমূহের চারধারে ইতোমধ্যেই উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।

ব্যপ্তির দিক থেকে নিঃসন্দেহে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস এবং ইউনেপ। কী অর্জিত হয়েছে বা কোন্ লক্ষ্যমাত্রাটা অর্জন করার পথে অগ্রসর হয়েছেন বিশ্বের পরিবেশ নীতিনির্ধারকেরা- এই প্রশ্নটি বারবার উঠে আসে। দেখা যাচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট নিরসনের ওপর এতটা বছর ডিবেটই হয়েছে বেশি। কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ বা সংকট নিরসনের সাফল্যজনক কোনো অধ্যায় রচিত হয়নি।

এখন প্রশ্ন হলো, দ্বীপদেশ নিয়ে নাড়াচাড়া হয়েছিল ২০১৪ সালে। আজ থেকে নয়বছর আগে। নয়বছর বা প্রায় একদশক আগে সেই প্রতিপাদ্য বিষয় এখন কাগজে কলমে রয়ে গেছে। এরমধ্যে বহু কপ বা কনফারেন্স অব পার্টিজ অনুষ্ঠিত হয়েছে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে। অনেক নতুন নতুন ধারণা, সমাধান ও ডিবেট হয়েছে। হয়নি শুধু কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে বিশে^র দেশগুলোর, বিশেষত উন্নত দেশের একমত হবার বিষয়টি। দ্বীপদেশ বা হুমকির মুখে থাকা দেশগুলো যতই সবুজায়ন ও অ্যাডেপ্টেশনের দিকে এগিয়ে যাক না কেন, দেশটিই যদি পানির তলে তলিয়ে যায়, তাহলে এসব প্রতিপাদ্য ও সম্মেলন বা আলাপ-আলোচনার প্রয়োজনটা কোথায়?

সম্প্রতি যথারীতি বড় রকমের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হলো কপ ২৭ সম্মেলন। জলবায়ু আলোচনায় যে বিষয়টি সবসময় প্রাধান্য পাওয়ার কথা, অর্থাৎ তাপমাত্রা কমিয়ে এনে জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি কমাতে বিশে^র ধনী ও প্রভাবশালী দেশগুলোর যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেবার কথা, তার সুরাহা এই সম্মেলনেও হয়নি। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, গাছ লাগানো হলো, কিন্তু তার পরিচর্যা করা হলো না। বৈশি^ক তাপমাত্রা কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেই কাজটিই হচ্ছে না। গোড়ায় যে গলদ, তা সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে লালন করা হচ্ছে বিশে^র কতিপয় মহাশক্তিধর দেশগুলোর জন্যই।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ধরে রাখতে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির ব্যাপারে কোনো সমঝোতা হয়নি।

মিশরে কপ-২৭ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে একটি তহবিল গঠন করার বিষয়ে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে বিশ্বের দেশগুলো। কপ ২৬ এ ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ এর যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেখানে দরিদ্র দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি এই সম্মেলনে এলেও কোনো কোনো দেশের জন্য, বিশেষত বাংলাদেশের জন্য খুব কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে। আবার সেই নেগোশিয়েশন, তদ্বির আর আশাহত হবার বিষয়টি তো রয়ে গেল। লস অ্যান্ড ড্যামেজের অর্থ আদায়ে বাংলাদেশকে যে জটিল মেকানিজম ও পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যেতে হবে সেটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তহবিল গঠনে ‘সন্তুষ্ট’ হলেও জলবায়ু মোকাবিলায় কোনো চুক্তি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ঝুঁকিতে থাকা দেশ এবং পরিবেশ কর্মীরা।

শুধুমাত্র সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে যে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে, তা সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে দেখা দিতে পারে দ্বীপদেশসমূহের জন্য। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা রোধকল্পে বিশ্বব্যাপী ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে তা সার্বিকভাবে মানবজাতির কল্যাণ বয়ে আনবে। উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে এখানে পোলার আইসক্যাপ গলে যাবার ফলে ক্যানেডার বিপন্নতার বিষয়টিও বিবেচ্য। ক্যানেডার অনেক অঞ্চল আছে যেগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আটলান্টিক ক্যানেডায় অবস্থিত নোভা স্কোশিয়ার পুরো পূর্ব উপকুল-ইয়ারমাউথ থেকে লুইসবুর্গ, নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের ফরচুন বে ও স্টিভেনভিল, প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড দ্বীপের পুরোটা এবং নিউ ব্রান্সউইকের উত্তর উপকূলেরÑবিশেষত মংকটন এলাকা। সেন্ট লরেন্স সীওয়ে জুড়ে যে এলাকা, তা-ও হুমকির মুখে, বিশেষভাবে কুইবেকের কিছু এলাকা। ক্যানেডার ওয়েস্ট কোস্টের হাইডা গোয়েই দ্বীপসমূহ বিশেষভাবে বিপন্ন, যেমনটি বিপন্ন ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ড উপকূল আর পুরো ভ্যাঙ্কুভার সিটি। বর্ণিত এসব এলাকা ধ্বংসাত্মক জলোচ্ছ¡াসের হুমকির মুখে রয়েছে।

পোলার আইস ক্যাপ অতি দ্রæত গলছে এবং তা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। এ তথ্য জানিয়েছে পোলার আইস ক্যাপের বিভিন্ন পরিমাপ নির্ধারণে বিশ বছরেরও অধিক সময়কাল ধরে পরিচালিত স্যাটেলাইট উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী টিম।

ভূ-প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক দিক হতে ভিন্ন হলেও বিশ্বের দ্বীপদেশগুলো অভিন্ন অর্থনৈতিক ও টেকসই উন্নয়ন প্রবণতা সম্পন্ন। তাদের ভৌগোলিক দূরত্ব, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীলতা-প্রভৃতি অভিন্ন বিষয়াদিতে তারা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করে। আর এই দ্বীপদেশগুলোর জলবায়ু নিয়ন্ত্রিত হয় সাগরের বায়ু ও আবহমণ্ডল দ্বারা। এসব দেশের ভৌগোলিক অবস্থা ও আবহাওয়া আয়ন বায়ু (ট্রেড উইন্ড), যথা-এল্ নিনো ও মনসুন (মৌসুমী বায়ু) দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ট্রপিক্যাল তথা ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোন বা হারিক্যান এসব দ্বীপদেশের বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এরকম জটিল ইকোসিস্টেম ও ভঙ্গুর ভৌগোলিক অবস্থান এবং সর্বোপরি সাগর পৃষ্ঠ বৃদ্ধিতে বিপর্যয়, প্রভৃতি বিবেচনায় জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে সচেতনতা সৃষ্টি এবং বিশ্বের অপরাপর রাষ্ট্রসমূহের উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমুদ্রস্ফীতি বৃদ্ধি রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ- যেমন বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে আনতে বিভিন্ন চুক্তি, মুসাবিদা ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহিত পদক্ষেপসমূহ বাস্তবায়িত করা। তাতে শুধু দ্বীপদেশগুলো বাঁচবে, তা-ই নয়Ñসামগ্রিকভাবে গোটা বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্যে স্থিতিশীলতা আসবে।