হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আজ একটু অন্য প্রসঙ্গ। আমি সুবিস্তৃত তীর্যকাকার বালুকা বেলায় বিচরণ করছি। সূর্যাস্ত দেখি। ঢেউয়ের শব্দ শুনি। ঝাউগাছের ঝুপড়িতে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দে শিউরে উঠি। আমি কল্পনায় সাদা ঘোড়া হাঁকিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকি। বিরামহীন।

কখনও বা সামান্য বিরতিতে সটান শুয়ে পড়ি ভেজা বালুতে। আমি প্রেমিক পুরুষ হলে হয়তো বালুতে নাম লিখতাম; মানে, আমার আর প্রেয়সীর নামের আদ্যাক্ষর। তবে বাস্তবে আমি প্রেমিক নই। কল্পনায় আমি এখনও প্রেমিক। আমার একজন প্রেমিকা আছে। তার সাথে মনে মনে সংলাপ চালাই। সেই সংলাপ শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজিক সংলাপ। কখনও বা তা স্বগত সংলাপ?ভগ্ন, ঝড়ের পাখির মতো বিধ্বস্ত অনির্দিষ্ট ডানা ঝাপ্টানো।

আজ আমার লেখালেখি সম্পর্র্কে কিছু বলব। দেখতে দেখতে আমার লেখালেখির বয়স যৌবন পার হয়ে প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগুচ্ছে। লিখে গেছি শুধু; আমি জনপ্রিয় লেখক হবো?এমন ভাবনা আমার মনে কখনও ঠাঁই পায়নি। এই পর্যন্ত বহু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও অনুবাদ প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। ইংরেজিতেও অনেক লেখা প্রকাশ করেছি। বই প্রকাশিত হয়েছে। আমার নামের আগে ‘জনপ্রিয় লেখক’ কথাটা যোগ হয়নি। যোগ হবার মতো আরও অনেক শক্তিশালী শব্দ আছে বাংলাতে বা ইংরেজিতে। নোবেল ও ম্যানবুকারসহ অনেক মূল্যবান পুরস্কারপ্রাপ্ত কানাডীয় লেখিকা অ্যালিস মানরোকে অথবা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কানাডীয় লেখিকা মার্গারেট অ্যাটউডকে অজস্র বিশেষণে বিশেষায়িত করেও তাদেরকে হয়তো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যাবে না। কিছু কিছু বিষয় আছে বোধ ও উপলব্ধির। মানরো বা অ্যাটউডকে পাঠ করতে হলে পশুর মতো বোধশক্তি আয়ত্ব করতে হবে। আর তা সম্ভব প্রচুর পাঠের মাধ্যমে।

আমাদের দেশের বিশেষ কয়েকজন জনপ্রিয় ধারার ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের কিছু পাঠক আছে, আছে টার্গেট গ্রæপ। এই টার্গেট সামনে রেখে লিখলে লেখা সরস হবে না তা নিশ্চিত আমি। সরস মনে হবে তাদের কাছে, যারা শুধুমাত্র তাদের ‘প্রিয়’ লেখকদের লেখার বাইরে খুব একটা বেশি কিছু পড়ে না।

ছোটো গল্পকার বা ঔপনাসিক, প্রাবন্ধিক কিংবা সমালোচক অথবা সাংবাদিক, যারা তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে দেশকালের গন্ডি পেরিয়ে গেছেন, তাদেরকে কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত না করে শুধুমাত্র ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক বললেই চলে। কেউ কেউ রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান তার সৃষ্টিকর্মের জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে তারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠেন। উদাহরণত, শ্রীলংকার এক সাংবাদিক রাজাপাকসেকে তেলমর্দন করে, প্রাপ্তিযোগ্যতারও বেশি প্রশংসা করে নানা ফায়দা লুটে ও পুরস্কার হাতিয়ে নিয়ে তিনি এখন বিক্ষুদ্ধ জনরোষের তোপের মুখে পড়েছেন।

একজন লেখক বা সাংবাদিককে সৎ ও সত্যবাদী হতে হয়। দূরদর্শিতা থাকতে হয়। প্রয়োজনে তাকে ভবিষ্যতদ্রংষ্টাও হতে হয়।

সৎ ও সততার আকাল বয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশে। সব চলছে উল্টো স্রোতে। সেই অশুভ ছায়া পড়েছে সাহিত্য জগতেও। দিন যত গড়াচ্ছে, দুর্নীতি ও অসততা তেমনি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে।

একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বৈরশাসক এরশাদও ‘কবি’ ছিলেন। ঈদসংখ্যা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিন/দিবস উপলক্ষে তার কবিতা প্রকাশ হতো পত্রপত্রিকায়। এখন হয় না কেন? তখন যারা তাকে কবি বলে মেনে নিয়েছিলেন, এখন তাদের মনোগতির পরিবর্তন হলো কেন? নাকি মৃত জনেরা কবি হতে পারেন না! তাহলে রবি ঠাকুর-নজরুল-জীবনানন্দ-শামসুর রাহমান প্রমুখ দেহত্যাগকারীদের ভবিষ্যত কী হবে?

কাউকে আঘাত করা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার আজকের কাজ হচ্ছে, লেখার মানের চাইতে লেখকের সংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া?এই ম্যাসেজটা দেয়া। বিশেষত, একুশে বইমেলায় এই প্রবণতা দেখি যে, অনেকে রাতারাতি লেখক বনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বই প্রকাশ করছে, যারা আগে কখনও লেখেনি বা কোনোদিন কোনোভাবে লেখক সত্ত¡া তাদের মাঝে জেগে ওঠেনি। তাদের উদ্দেশ্য রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া।

বিষয়টা এভাবে ভাবা যেতে পারে যে, অসংখ্য মানহীন বইয়ের চাপে ভালো বইগুলো পিছলে যেতে পারে। কারণ বইমেলায় সব ক্রেতারাই কিন্তু খুব শিক্ষিত না বা ভালো মন্দ যাচাইর তাদের ক্ষমতা নেই। তারা ভালো জাত ও সরস লেখা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
টাকাপয়সার জোরে ঝকঝকে প্রচ্ছদ আর মানসম্মত ছাপা হলেই তা কিন্তু বই হয়ে যায় না। বিভ্রান্তিটা এখানেই সৃষ্টি হয়। তাছাড়া, পয়সার জোরে এই সমস্ত লেখকেরা প্রচার, প্রসার করে। আর মেলায় সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকাভুক্তি হয়ে বুঝাতে চায় যে, তারা একান্ত সাহিত্যসেবী ও দেশজাতির উন্নয়নে বই লিখছে রাত জেগে।

হাসান আজিজুল হককে কেউ কখনও জনপ্রিয় সাহিত্যিক বা লেখক বলেননি। বলার দরকার পড়েনি; কেননা, তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। তার ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ সেই ষাটের দশক থেকে আজও পর্যন্ত তেমনি বহুলপঠিত ও আদৃত রয়ে গেছে। বাংলা সাহিত্যের একটি স্থায়ী সম্পদ এই গল্পগ্রন্থ।

আমার লেখার বিষয়বস্তু, মান ও আঙ্গিকগত দিক নিয়ে বিরূপ সমালোচনা কখনও হয়নি। গঠনমূলক সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু আমার মান নিয়ে কখনও কোনো প্রশ্নের সম্মুখিন হইনি। আড়ালে-আবডালে কেউ কিছু বলে থাকতে পারে; সেটা আমার অজানা। আমি সাফাই গাইছি না। প্রসঙ্গক্রমে কথাটা টানলাম। নাম ছড়ানোর জন্যও বলিনি কথাটা। ফুল ফুটলে তার সুগন্ধ তো ছড়াবেই।

আমি কয়েকবছর আগে ঢাকায় একটা সাহিত্য আড্ডায় গিয়েছিলাম। কেউ কেউ এখন শিখেছে ন্যানো গল্প টার্মটি। অনেকে আবার ‘হাইকু’ লিখছেন। এসব লেখার মান বিচার করার টেকনিক আমার জানা নেই। যারা জানেন, তাদেরকে অনুরোধ করছি, এগুলো জাজ করুন। সুস্পষ্ট মন্তব্য বা বক্তব্য দিন। ন্যানো গল্পের মান নির্ধারণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিষয়টা জাদুবাস্তবতা বা উত্তরাধুনিকতার সংজ্ঞা যাচাই করার মতো। এতবড় পন্ডিত আমি নই।

আমি অনেকটা নির্বাক হয়ে ছিলাম সেই আড্ডায়। একটা কথাই মনে হয়েছিল- ‘Where ignorance is bliss it is folly to be wise.’

আমি জনপ্রিয় লেখক নই; আবার অ-জনপ্রিয়ও নই। ‘অ-জনপ্রিয়’ কথাটা নেগেটিভ, তাই এভাবে না বলে বলতে চাই- আমি জনপ্রিয় ধারার লেখক নই। আর সেদিকে ধাবিত হবার ইচ্ছেও আমার নেই। একজন জনপ্রিয় লেখককে কাছাকাছি থেকে দেখেছি, জেনেছি। আরো এক ‘জনপ্রিয়’ লেখক আছেন হাল আমলের, যার লেখা মোটেও মানসম্মত মনে হয়নি আমার কাছে। জনপ্রিয় হওয়াটা খারাপ কিছু নয় বরং উঁচুমার্গের বিষয়, যদি তা খাঁটি হয়। জনপ্রিয়তা মাপার দুইটি প্রধান মাপকাঠি আছে, এক মানসম্মত লেখা ও দুই পাঠক আকর্ষণের কায়দাকানুন জানা।

‘জনপ্রিয়’ ধারার লেখকদের মান সম্পর্কে আমার নিজের আর বহু বিদগ্ধজনের বহুবিধ সন্দেহ, আপত্তি ও বিবমিষা রয়েছে। এইসব জনপ্রিয় ধারার লেখকদের কিছু টার্গেট রিডার আছে, মূলত যাদের জন্য তারা জনপ্রিয়। বিরাট একটা টার্গেট রিডার বা ভক্ত থাকার জন্য টিভি, টক শো বা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ও পত্রিকায় শতবার তাদের দেখা যায়। বহু পুরস্কারপ্রাপ্তিও তাদের ভাগ্যে ঘটে। এইসব ‘জনপ্রিয়’ লেখকদের কয়েকজনের পুঁজি নিম্ন উল্লেখ করা করা হলো:
তারা প্রচুর পরিমাণে ভাব ধরেন
তাদের জ্ঞানের ও পড়াশোনার পরিধি নি¤œমানের
সেইসব ঢাকবার জন্য তারা প্রচুর চাপাবাজি করে বেড়ান
তারা নানারকম লবিয়িং করে থাকেন
দরকারি ক্ষেত্রগুলোতে তারা তেল মর্দনের কাজটি করেন
তাদের লেখায় থাকে সস্তা রোমান্স ও রসালো ডায়ালগ
তাদের লেখায় দেশ ও সমাজের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট থাকে না
ধর্মের প্রতি কটাক্ষ করাটা তারা একধরনের স্মার্টনেস মনে করেন
তারা বাকপটু ও তাৎক্ষণিক লেকচারে পারদর্শী
তাদের অনেকেই ভুল ধরতে পারবে না, এমনসব শ্রোতা বা পাঠকের সামনে অনবরত ‘ইংরেজি’ বলতে থাকেন
তারা রাজনৈতিকভাবে আশির্বাদপুষ্ট থাকেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের মতো ভোল পাল্টান
এবং আরো অনেক গুণাবলি

(এগুলো আমার একান্তই নিজস্ব পর্যবেক্ষণ আর এর দায়ভাগও আমার। পাঠকের কোনো পর্যবেক্ষণ থাকলে বা আমি সঠিক বলিনি বলে মনে হলে দয়া করে আমাকে জানাবেন। আর এইসব পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করাটা কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে নয়। তবে অনেকে আঘাতপ্রাপ্ত হবেন বলে আমার আশঙ্কা। কেননা সত্যটা সবসময়ই তেতো হয়। মিঠে হয় না)। বর্ণিত গুণাবলির একটিও আমার মধ্যে বিদ্যমান নেই। অতএব আমি ‘জনপ্রিয়’ লেখক নই। তবে আমি কীরকম লেখক? আর আমার লেখা মানসম্মত, অখাদ্য নাকি অ-পাঠযোগ্য? উত্তরটুকু সহজ। আমার লেখা অখাদ্য হলে দীর্ঘ তিনযুগেরও বেশি সময় ধরে লেখা চালিয়ে যেতাম না। অনেক আগেই ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলে সাহিত্যভুবনকে বাই-বাই বা অ্যাডিয়ো বলে পালিয়ে যেতাম।

কারুর সার্টিফিকেট নিয়ে আমি আমার লেখার মান যাচাইয়ে আগ্রহী নই। আর পাঠকের কথা বলছেন? ভারটুকু পাঠকের ঘাড়েই চাপিয়ে দিলাম।