হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

আগেও কয়েক দফায় বলেছি, আমাদের জীবনটা ছিল যাযাবরের জীবন। আজ এই ভাড়াবাড়িতে তো কাল ওই বাসায়। আমাদের জন্মস্থান ঢাকায়, তবে আমাদের নিজস্ব কোনো বাড়ি ছিল না। আমার আব্বা অবশ্যি বর্তমান বারিধারার পেছনে একটুকরো জমি কিনেছিলেন পাকিস্তান আমলে। সেটা আবার বিক্রিও করে দেন সম্ভবত ১৯৭৩ সালে। সুতরাং বাড়ির আসবাব ঠ্যালাগাড়ির ক্যারাভানে আমাদের ঢাকার এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত ঘুরাঘুরির দৃশ্য ছিল নিয়মিত।

তবে নয়াপল্টনে অবস্থান করেছিলাম লম্বা সময় ধরে। সেটা পাকিস্তান আমলের শেষদিকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার বাসা বদলে চলে আসি মগবাজারে।

নয়াপল্টনের বাসাটা ছিল ছবির মতো। বাড়ির ভেতরে বিশাল উঠোন। আমগাছ, বড়ই গাছ আর পেয়ারা গাছ ছাড়াও নানা গাছগাছালিতে পূর্ণ ছিল বাড়িটা। নির্জন আর সুনসান। আমাদের বাড়ির লাগোয়া বাড়িটিতে থাকতেন বাড়িওয়ালা। আমাদের উঠোনের বাউন্ডারির ওপাশে ছিল খাস ঢাকাইয়া কুট্টি পরিবার। বিপুল সংখ্যক ভাইবোন তারা। প্রতিবেশী হিসাবে চমৎকার ছিল তারা। বাড়িওয়ালা আর আমাদের মধ্যে ভাড়াটে-বাড়িওয়ালা সম্পর্ক ছিল না। তারা ছিল আত্মীয়ের মতো। আমি মনের সুখে আম-পেয়ারা-বড়ই খেয়ে উজাড় করে ফেলতাম বড় বড় গাছগুলো। তারা কিছু বলত না। বাড়ির উঠোনে ফুল ও সব্জির বাগান করতাম। সারাদিন থাকতাম গাছের ওপর অথবা বনেবাদাড়ে। ঢাকা শহরে বনবাদাড় কোথায়?

ছিল। সর্বত্র বনজঙ্গল ছিল এবং সেখানে আমরা বাঘদাশা কতল করেছি। তখন ঢাকা শহর ছিল হালকাপাতলা, কম কর্মব্যস্ত এবং প্রায় জনবিরল। আমাদের একদিকে ছিল সিএন্ডবি’র বিশাল মাঠ, তারপর রাজারবাগ পুলিসলাইন, ফকিরাপুল বাজার আর অন্যপ্রান্তে বর্তমানে দৈনিক বাংলা মোড়। বর্তমান ডিআইটি এক্সটেনশন রোড তখন কাঁচা রাস্তা ছিল, ডোবা, গাছগাছালিতে পূর্ণ!

ফকিরাপুলের যে দিকটায় হোটেল নূরাণীর অবস্থান, তার সামনে রাস্তার ওপরে যে লেপতোষকের দোকানগুলো, তার ঠিক সামনেই ছিল একটা বিশাল কদম গাছ। আর তার তলে কিছুদিন পরপর এক লোক এসে ভালুকের নাচ দেখাত! স্বপ্নের মতো নয় কি? কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে এদিকে, উল্টোপাশে মানে আমাদের বাসার কয়েকটি বাসার পরে বর্তমান পল্টন ভিআইপি রোড আর ডিআইটি এক্সটেনশন রোডের সংযোগস্থলে ছিল বিখ্যাত আর্টস অন ফটোগ্রাফি। সেখানে তখনকার দিনের বিখ্যাত অনেক তারকা: সুজাতা, কবরী, সুচন্দা, কাজল আবদুল্লাহ, পরে কাজল ইব্রাহীম (বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী) ছবি তুলতে আসতেন। কাজল আপা আবার আমার বড় আপার বান্ধবী ছিলেন এবং তারা থাকতেন আমাদের পাড়াতেই। আমাদের কয়েকটি বাসার পরে। তাদের সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কাজল আপার আব্বা ছিলেন বিখ্যাত ডা. আবদুল্লাহ আর মা ছিলেন বদরুন্নেসা আবদুল্লাহ। তৎকালিন পাকিস্তান টেলিভিশন-এর (পরবর্তীতে বিটিভি) একজন প্রযোজক। কাজল আপারা ছিলেন দুই ভাই এক বোন। তিনিই ছোটো। সবচেয়ে বড় ভাই হাসান, তারপরে টেপু।

কাজল আপা আমাদের এতগুলো ছোটো ছোটো ভাইবোনদের মাঝেই অনির্বচনীয় আনন্দ খুঁজে পেতেন আর আমাদের বাসাতেই তার নয়াপল্টনের জীবনের অনেকটা সময় কেটে গেছে। আমাকেসহ আমার সব ছোটো ভাইবোনদের ঈদের দিনে নিজহাতে ড্রেস পরিয়ে দেয়া আর আমাদের সাথে ঈদের খানাপিনায় অংশগ্রহণই তার মূল আনন্দ ছিল। তাদের বাসার সমস্ত আয়োজন আর মেহমানদারি শিকেয় উঠত।

টাইগার নামে কাজল আপার একটা কুকুর ছিল। কুকুরটার গলায় কোনো বেল্ট ছিল না। মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা অন্যান্য কুকুরের মতো টাইগারকেও বড় লোহার চিমটা দিয়ে ধরে ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে কাভার্ড ভ্যানে উঠিয়ে ফেলেছিল। সেই দুঃসংবাদ আমি নিজে দিয়েছিলাম কাজল আপাকে। শুনে কাজল আপার চোখ দিয়ে বন্যার মতো অশ্রুধারা নেমেছিল।
জোনাকি সিনেমা হল থেকে পুলিস হাসপাতালের বাউন্ডারি আর আরেকদিকে রাজারবাগ পুলিসলাইনের শুরু-মাঝখানের পুরো জায়গাটাই বনজঙ্গল আর সিএন্ডবির ইট-রডের ঠাসবুনোট। গাছ আর জঙ্গল। এখানে চড়ে বেড়াত বনবিড়াল, বাঘদাশা, বেজি ও গাছে গাছে কাঠবেড়ালি। এই জায়গাটা ছিল আমার আর আমার সাথীদের বিচরণস্থল। জোনাকি সিনেমা হল সংলগ্ন স্থানটিতে (বর্তমানে পল্টন থানা) ছিল একটা বিশাল পুকুর। এই পুকুরেই ডুবাতে ডুবাতে একসময় শিখে ফেললাম সাঁতার।

হোটেল নূরাণীর মালিক ছিলেন লালমিয়া চেয়ারম্যান। তিনি আগে পানবিড়ি বিক্রি করতেন, পরে টাকাপয়সা জমিয়ে নূরাণীর জায়গাটা ক্রয় করেন এবং পরবর্তীতে হোটেল গড়ে তোলেন। অত্র এলাকায় তার প্রবল দাপট ছিল। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, দেখতে রাগী স্বভাবের মোটামুটি উচ্চতার লালমিয়া চেয়ারম্যানের কয়েকটি ছেলে ছিল-তাদের ক’জনকে আমি চিনতাম। বড় ছেলের নাম ডক্টর, তারপরের জন আওলাদ হোসেন এবং এরপর ঈমান হোসেন। আরও এক বা দুইটি ছেলে ছিল, তাদের নাম মনে নেই। ঈমান হোসেনের সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল।

ডক্টর ভাই একটা ব্যাংক ডাকাতির সময় ধরা পড়েন এবং পরে তার ফাঁসি হয়ে যায়। ছেলের শোকে লালমিয়া চেয়ারম্যান হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাটা ঘটে সম্ভবত ১৯৭৫ (আমরা মগবাজারে থাকতাম) সালে আর ডক্টর ভাইয়ের ফাঁসি কার্যকর হয় সম্ভবত ১৯৭৭ সালে। ততোদিনে আমার বাসা বদল করে নয়াপল্টন জামাতখানা সংলগ্ন একটি চারতলা বাড়ির একতলায় থিতু হলাম।

এখন যেখানে পল্টন সুপারমার্কেট সেখানে ছিল ব্যাটারি রিপেয়ার, রিচার্জ ও বিক্রির সারি সারি দোকান ও একটা বিশাল পুকুর। উল্টোপাশে পলওয়েল মার্কেট বহু আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। তৎকালিন একজন মেধাবী পুলিস অফিসার এই মার্কেটের নামকরণ করেন পুলিস ওয়েলফেয়ার মার্কেট- সংক্ষেপে পলওয়েল। জোনাকি সিনেমার পুকুর, পল্টন সুপারমার্কেটের পুকুরগুলো নানাজাতের মাছে পরিপূর্ণ ছিল। বর্ষার সময় পুকুর ওভারফ্লো করে মাছগুলো ছড়িয়ে পড়ত নানাদিকে। ফলে প্রবল বর্ষার সময় আমি মাছ ধরেছি পল্টন ভিআইপি রোডের পাকা রাস্তায় দাঁড়িয়েই! সে কতো রকমের মাছ! সরপুঁটি, তেলাপিয়া, পুঁটি, টাকি, এমনকি কই মাছ।

আমাদের বাসাটা ছিল বিশাল। সেমিপাকাÑদালান কিন্তু ওপরে টিনের চাল। এই কারণে বাসাটার একটা ভিন্ন আমেজ ছিল। সামনে পেছনে বারান্দা। বাড়ির সামনেটা ছিল রাস্তামুখি, একটা গলিমতো। পেছনে, ভেতরের দিকে বারান্দা আর বিরাট উঠোন। আমাদের আর বাড়িওয়ালার বাড়ি মিলিয়ে অসংখ্য গাছপালা। আমগাছ, বড়ই গাছ, পেঁপে ও সুপারি গাছ, পেয়ারা ও পেস্তা, আতা এবং আরও কত কী। উঠোনের একপ্রান্তে ছিল টালির ছাতের বিশাল রান্নাঘর।

প্রথম দিকে রান্নাঘর হিসেবে কাজে লাগালেও পরবর্তীতে আমরা মূলবাড়িরই একটা কামরাকে রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করতাম। কারণ বাড়িটায় অনেকগুলো কক্ষ ছিল। উঠোন পেরিয়ে টালির রান্নাঘরে আসা যাওয়ার ধকল কমল। এই রান্নাঘরে আশ্রয় হলো ধনু দাদার। ধনু দাদা ছিলেন অশিক্ষিত। তিনি আব্বার দূরসম্পর্কীয় ভাগ্নে। আব্বা তাকে থাকতে দিলেন এখানে এবং পত্রিকা বিক্রির কাজ জুটিয়ে দিলেন।

আমাদের উঠোনভর্তি ছিল নানাজাতের মৌসুমি ফুল। ফুলের এত সমাহার দেখে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা অনেকেই বিস্মিত হতো, এত হরেক রকমের ফুল ছিল। আমি ফুলের বাগানের বেড়া দেয়ার কাজ সারতাম মোরগফুল গাছ দিয়ে (গাছটার প্রকৃত নাম জানি না, আমরা যে ডাঁটা গাছ খাই সব্জি হিসেবে ঠিক সেইরকম দেখতে, ফুলগুলোও একইরকম-পার্থক্য মোরগফুলগুলো হতো টকটকে লাল)। আমার বাগানে সামান্য পেঁয়াজফুল থেকে শুরু করে সূর্যমুখি ফুল পর্যন্ত ছিল। ছিল ডালিয়া, জিনিয়া, গোলাপ, নানারকমের পাতাবাহার, পাথরকুঁচি, হাসনোহানা, সন্ধ্যামালতী, নয়নতারা, চকোলেটের গন্ধযুক্ত সাদা লিলি, কলাবতী, ক্যাকটাস প্রভৃতি।

আমি এত ফুলের গাছ কোথায় পেতাম! উত্তরটা হলো, চুরি করতাম রমনা পার্ক থেকে। একবারে বেশি চুরি করতাম না। একটি দু’টি করে চারা তুলে নিয়ে আসতাম বড় ঠোঙ্গায় করে। আমার একটা অভ্যেস ছিল, শিক্ষা দেয়া হয়েছিল অন্যের কোনো জিনিস না ধরতে বা কোনো ক্ষতি না করতে। সেটি আমি শৈশব থেকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। কিন্তু ফুলগাছ চুরির অভ্যাসটা আমার কেন হলো সেই ব্যাখ্যা আমি আজও খুঁজে পাইনি।
পরের কোনো এপিসোডে আমি স্মৃতির নয়াপল্টন সম্পর্কে আরও কিছু বলার ইচ্ছে রাখি। আজ এটুকুই।