ঋতু মীর : ‘The heart of wisdom is tolerance’

১।
‘Go behind!’- কর্কশ কণ্ঠের উচ্চস্বর চিৎকারে চমকে উঠে সত্যবতী। বুকের ভেতর ভয়ে ধড়াস করে উঠে। ঠিক সামনে শুকনা পাতলা প্যাকাঠি স্বাস্থ্যের রাগান্বিত মুখ মহিলা দাঁড়ানো। চেহারায় তাকে ইষ্ট ইউরোপিয়ান বলে আন্দাজ করে সত্যবতী। মুখের চামড়ায় কণ্ঠের দিগুণ কর্কশ ভাব। চোখের ভাষায় জগতের নানা বিতৃষ্ণা আর অভিযোগের সংলাপ। এত লিকলিকে স্বাস্থ্য নিয়ে কণ্ঠে এত জোর কোথা থেকে আসে ভেবে পায় না সত্যবতী। এখানে নতুন অভিবাসী হিসেবে সত্যবতী তখন প্রতিনিয়ত শিখছে। বাংলা ভাষাকে জোর ঢেকুর তুলে একেবারে অন্তঃস্থলের নিচে গভীরে পাঠিয়ে দিয়ে ঠেকে ঠেকে শিখছে ইংরেজি। ধাতস্থ হচ্ছে ক্যানাডিয়ান স্টাইলে ইংরেজি উচ্চারণ, colloquial, প্রথা, আচার আচরণের সাথে খাপ খাওয়ানোর নানারকম সুচারু কৌশলে। গাড়ি চালায় না বলে পাবলিক ট্র্যান্সপোর্টে তার নির্ভরশীলতা প্রায় শতভাগ। বয়সের এই প্রান্তে এই দেশে এসেই ভূগোলের ‘ম্যাপ’ দেখার স্কিলটাই প্রথমে রপ্ত করেছে সে। এখন বাসের নাম্বার দেখলেই রাস্তার নাম, থামার ষ্টেশন, টাইম টেবিল ইত্যাদি সে মুখস্ত বলে দিতে পারে। ভ্যাবাচেকা খাওয়া সত্যবতী বাস্তবে আছড়ে পড়ে- আবার সেই কর্কশ কণ্ঠ ‘go behind’! এবার হাত তুলে তর্জনী প্রদর্শন করে বাসের অপেক্ষার লাইনের শেষ প্রান্ত দেখাচ্ছে। ওইখানে যাও! ওইখানে দাঁড়াও বুঝলে? ‘বিহাইন্ড’ শব্দটার উচ্চারণ ‘বাহাইন্ড’ কানে খট করে লাগে। তাহলে কি এরপর থেকে শব্দটা এভাবেই উচ্চারণ করবে সত্যবতী? হাজার হলেও একজন চামড়া সাদা যখন এভাবে বলছে! নিজের দাঁড়ানোর অবস্থান চকিতে দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয় সত্যবতী। সেতো লাইন বরাবর অবস্থানেই আছে। বাস আসার পর যাত্রী নামা এবং ওঠার সময়ে লম্বা লাইনটা একটা ছোট খাট কোলাহলে পরিণত হয় প্রায়শই। একটু ধাক্কাধাক্কি তো হয়েই যায় মাঝে মাঝে। সবার মধ্যেই যেন সিট দখলের একটা প্রবণতা থাকে। এই ব্যস্ত সময়েও সত্যবতীর মন স্মৃতির জানালায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি চত্বরের সামনে ছাত্রছাত্রীদের জন্য চালু বাসে বন্ধুদের জন্য সিট দখলে সে ছিল মহা পারদর্শী। ভিড় ঠেলে এঁকেবেঁকে বাসে উঠে দুই সিট দখল করে তৃতীয় সিটে পা তুলে দখলদারী চলতো। বন্ধুরা জায়গা মত বসলেই সে নেমে গিয়ে রিক্সা নিয়ে বাসায় যাবে এই ছিল উদ্দেশ্য। এইরকম তোয়াক্কা না করা, দস্তুর মত ঘেমে নেয়ে যাওয়া মাস্তানীতে মাঝে মাঝে মহা বিপাকেও পড়তে হত সত্যবতীকে। কখনো তড়িঘড়ি নামার আগেই বাস ছেড়ে দিত। কখনো বাস ড্রাইভারের স্নেহ মাখা তিরস্কারে আর এমন করবে না বলে পণ করত সে। আজ তো গোটা সত্যবতীই বদলে গেছে। এখন সে নিয়ম মানা সুবোধ নাগরিক। অথচ বিনা কারণে ওই প্যাকাঠি তাকে ধমকাচ্ছে কেন? অন্তঃস্থলে লুকিয়ে রাখা জোড়ালো একটা বাংলা শব্দ স্থান, কাল, পাত্র ভুলে ধুম করে জিহ্বার আগায় চলে আসে – ‘কেন’? বাকিটা ঝগড়ার সুরে বাংলিশ ইংরেজিতেই বলে সত্যবতী- ‘আমি একদম ঠিক আছি’, ‘আমাকে দেখে তোমার গা জ্বললে তুমি যাও না পিছনে’! ততক্ষণে বাসের ভিতরে দুজনেই। ‘যত্তসব টিপিক্যাল ইমিগ্রান্ট জুটেছে এইদেশে’। বিড়বিড় করে পার্শ্ববর্তিনীর কান ভারী করে নিজ মন্তব্যে- সমর্থন খুঁজে মহিলা।

২।
দ্রুত পায়ে বাসের উঁচু সিটে নিজের প্রিয় জায়গা দখল করে বসে সত্যবতী। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সামনে তাকায়। বাসের চারপাশে চোখ ঘুরে এসে কর্কশ কণ্ঠীর ব্যাজার মুখে দৃষ্টি থামে। আরে! সে তো প্রায় ভুলেই বসেছিল একটু আগের ঘটনা। কিন্তু ওই মুখে যে এখনো নানা সমস্যার থই থই তুফান। সন্ধানী চোখে মুখটা দেখে সত্যবতী। গোটা শরীর মুখ জুড়ে যেন অসহ্য এক অসহনীয়তার ভাব। সুখ যেন এক অচিন পাখী ওই জীবনে। কখনোই বুঝি ভুল করেও ওর মনের ডালে এসে বসেনি! এই যে ক্ষণিকেই ধৈর্য হারিয়ে অচেনা কারও সাথে অসামঞ্জস্য আচরণ তাই বা কেন? সবাই তো নিজ গন্তব্যেই যাবে এবং সেটা বাস ছাড়ার নির্দিষ্ট সময়েই। হয়তো একটু আগে বা পড়ে। হয়তো দাঁড়িয়ে বা বসে। হয়তো প্রচণ্ড ভিড়ে ঘাম ভেজা দুর্গন্ধ শুকতে শুকতে। যাত্রার সময়টাতো আর অনন্তকাল নয়। তাহলে কেন এই ধৈর্যের অভাব? নিজের আচরণকেও বিশ্লেষণ করে সত্যবতী। সেই বা কেন ধৈর্য হারিয়ে এমন প্রতিক্রিয়া দেখালো? সহনশীলতার প্রশ্নে তারও কি নীরব থাকাই উচিত ছিল না এই ক্ষেত্রে? তাৎক্ষণিক রাগের উত্তেজনায় যে বাক্যে ইংরেজি প্র্যাকটিস করলো তা কি সত্যিই শ্রুতিমধুর? আর তার জন্য ‘টিপিক্যাল ইমিগ্রান্ট’-এর মত অসম রেসিস্ট কথাটাও যে শুনতে হোল! ‘ইষ্ট ইউরোপিয়ান’ এমন একটা হিংসা ভরা কাল্পনিক তকমা মহিলার গায়ে সেঁটে দিয়ে সেও কি একটু judgemental হয়ে পড়েনি? জানো জোনাকি! আদ্যপান্ত ঘটনা বিশ্লেষণ করে সত্যবতী- anger এবং intolerance এর মত বিষয়ই কিন্তু মানুষকে, তার পরিস্থিতিকে বোঝার ক্ষেত্রে প্রকৃত বাধা। শোন জোনাকি! ‘Compassion and tolerance are not a sign of weakness, but a sign of strength’- এটা কেবল মনে মনে মানার বিষয় নয় কিন্তু, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তা চর্চারও বিষয়। ‘গ্রহণ’, ‘সহিষ্ণুতা’, ‘ক্ষমা’ এসবের মত অসম্ভব সুন্দর ডিভাইন বিষয়গুলো আমাদের অনাকাক্সিক্ষত আচরণকে প্রতিনিয়ত সংশোধন করে শেখার সুযোগ করে দেয়। Thought এবং action এর ক্ষেত্রে যৌক্তিক বা rational হওয়াটা যেমন জরুরি তেমনি শত্রু এবং মিত্র সব ক্ষেত্রেই আচরণে টলারেন্স থাকাটা আরও জরুরি। তাছাড়া ভুলে গেলে চলবে না যে, শান্তির শুরুটাই কিন্তু সহিষ্ণুতা বা টলারেন্স থেকে। সত্যবতীর কথার একমাত্র মনোযোগী শ্রোতা জোনাকি অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে হাসে- দ্যাখো সত্য! সব ক্ষেত্রেই টলারেন্স হয়তো সম্ভব নয়। আমি বলছি না যে, তুমি মহিলার সাথে ঠিক আচরণটাই করেছো। তবে পথে ঘাটে বা সমাজ সংসারে বিষাক্ত কিছু মানুষের abusive আচরণের সাথে ঠিক কতখানি ‘টলারেন্স’ তুমি দেখাবে সে প্রশ্নে কিন্তু সত্যিই বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। দ্যাখো সত্য! বাসে ড্রাইভারের কাঁচ ঘেরা সিটের পাশে লেখা থাকে ‘জিরো টলারেন্স’। বাস চালক অনেক সময়েই যাত্রী দ্বারা অযাচিতভাবে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনার কবলে পড়ছে। সেক্ষেত্রে আচরণ বিধিমালা নির্ধারণ না করলে গোটা সিস্টেম যে ভেঙ্গে পড়বে! যাই হোক, ধৈর্য ধরে সভ্য হয়ে অনেকক্ষণ তোমার কথা শুনছি সত্য! এবার মুচমুচে স্বাদের সমুচা খাওয়াও দেখি! এই মুহূর্তে ‘টলারেন্স’ এর অন্য একটা সংজ্ঞা মনে আসছে আমার- আসলে টলারেন্স হলো সমাজে সভ্যতার স্বাদ! ঠিক কিনা বলো! অনাবিল হাসে জোনাকি, সেই সাথে সত্যবতীও! (চলবে)

Ritu Mir, Teacher, Toronto District School Board, Toronto, ritu.mir9@gmail.com