শারমীন শরীফ : ১৯৫১ সালে বাগেরহাটে বাসরকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সংগ্রামী নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা হালিমা খাতুন। কৃষক ওয়াহেদ আলি মীর ও আয়াতুন্নেসার কন্যা হালিমা খাতুন। সাধারণ কৃষক পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায় একই গ্রামের আর এক কৃষক সিরাজ শেখের সাথে। সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির বউ হালিমা স্বামী ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন আর দশটি পরিবারের মত।

হালিমার বয়স তখন ২০ বছর, দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বাসরকাঠি গ্রামে শান্তি কমিটি গঠন করে গ্রামের অসৎ কিছু লোক। একই সাথে গ্রামের অনেক যুবক তখন যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে, চারিদিকে থমথমে একটি ভাব। শান্তি কমিটির কল্যাণে গ্রামে পাকবাহিনীরা কয়েকবার এসে ঘুরে গিয়েছে বাসরকাঠি গ্রামে এর মধ্যে। অস্বস্তিকার এক ভয় নিয়ে তখন গ্রামবাসীর দিন কাটছিল। শান্তি কমিটির লোকেরা পাক বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে ১৯৭১ সালের জুন মাসের ২ তারিখে বাসরকাঠি গ্রামের কান্দিপাড়া বাজারের ব্রিজের উপরে ২০ জন যুবককে মেরে ফেলে, সে যুবকদের মধ্যে ছিল হালিমার সহোদর ভাই, চাচাতো ভাই এবং আরো অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশী। রাজাকার বাহিনীর এই নৃশংসতা গ্রামবাসীকে স্তব্ধ করে দেয়। তরুণী হালিমার মনে জন্ম নেয় এক অদম্য ক্রোধের, শান্তির নামে এই বর্বরতাকে যেকোন ভাবে প্রতিরোধ করার ব্রত নেয় হালিমা।

জুন মাসে বিডিআর-সেনা হাবিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প বসান বাসরকাঠি প্রাইমারি স্কুলে। হালিমার স্বামী সিরাজ শেখ ও তার পরিবারের আরো অনেকেই হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধে যোগদান করে। মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করা, তাদের কাপড় চোপড় ধুয়ে দেয়া, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করা ছাড়াও তথ্য আদান-প্রদানের দায়িত্ব নেন হালিমা এবং এই কাজ করতে করতে পাশাপাশি অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও নেন তিনি। রাত জেগে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাহারা দেন হালিমা। জুলাই মাসের স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে হালিমা সহ আড়াইশো মানুষ অংশ নেয়। রাজাকারেরা পরাজিত হয়ে স্কুল ঘরটি পুড়িয়ে দিলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি ধ্বংস হয়ে যায়। হালিমা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দেন এবং নতুন ক্যাম্প গড়ে তোলেন। ভিখারির ছদ্মবেশে হালিমা মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি পৌঁছে দিতে গিয়ে বাবুরহাটের খালের কাছে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন এবং অকথ্য অত্যাচারের শিকার হন। মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে গেলে রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমণ করে সহযোদ্ধা হালিমাকে উদ্ধার করে।

হালিমা খাতুন

মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সরবরাহের জন্য রাতারাতি জমি থেকে ধান কেটে সেই ধান থেকে চাল বানিয়ে ভাত রান্না করে কলাপাতায় মুড়ে খাল সাতরে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছেন হালিমা। একপর্যায়ে হালিমার বাড়িটিও জ্বালিয়ে দেয় রাজাকাররা, হালিমাসহ বাকি সব মুক্তিযোদ্ধারা তখন বিলের মধ্যে আশ্রয় নেয়। রাজাকার আল বদরদের অত্যাচারের পাশাপাশি নকশাল বাহিনীর অত্যাচারেও তিনি জর্জরিত ছিলেন। নকশাল বাহিনীর একটাই উদ্দেশ্য ছিল হালিমার কাছ থেকে অস্ত্রের সন্ধান নেয়া। হালিমাকে বিবস্ত্র করে বেঁধে দিনের পর দিন শারীরিক নির্যাতন চালায় নকশাল বাহিনী কিন্তু কোনভাবেই তিনি নকশালদেরকে অস্ত্রের সন্ধান দেননি।

যুদ্ধে হালিমার স্বামী সিরাজ শেখ আহত হন এবং পঙ্গু হয়ে যান। স্বাধীনতা উত্তর কালে হালিমা খাতুনদের জন্য কোন সাহায্য সহযোগিতার হাত কেউ বাড়ায়নি। তবে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সম্মাননা জানিয়েছেন।স্বীকৃতিতে বলা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের সাতাশ বছর পর সম্মাননা প্রদানের এই উদ্যোগ মহান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাতীয় পর্যায়ের উদাসীনতার লজ্জা সামান্য পরিমাণে হলেও লাঘব করবে। স্বাধীনতার পর পঙ্গু স্বামী এবং প্রতিবন্ধী এক পুত্রকে নিয়ে অন্যরকম ভয়ানক এক সংগ্রামী জীবনে অবতীর্ণ হতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হালিমা খাতুনকে। এমন অকুতোভয় হাজারো মুক্তিযোদ্ধাকে দেশ কিছুই দিতে পারেনি। ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে, সবকিছু হারিয়ে তারপরে তাঁরা সারাজীবনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই হালিমা খাতুন সহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের।