ডঃ বাহারুল হক : রাত দশটা। আমার জায়গা হলো প্রথম শ্রেনীর একটা কেবিনে। অবশ্য কেবিনে আমি একা নই। আরেকজন যাত্রী আছেন। শীতের রাত। পরিপাটি বিছানা। আমার পছন্দ হলো কেবিনটা। আমার পাশের যাত্রীর সাথে কথা বললাম। তিনি একজন ব্যাবসায়ী। মনিপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। ব্যাবসার কাজে তিনি বোম্বে যাচ্ছেন। বয়স্ক ভদ্রলোক। কথা বার্তা বলে যে সময় পার করবো সে ধরনের কেউ না। আমি আমার বিছানায় চিত শুয়ে পড়লাম। ভাজ করা সাদা কম্বলটা খুলে টেনে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিলাম। দুই চোখ খোলা। কত কথা যে মনে পড়ছে! আমার কেবিনমেট মনিপুরী ভদ্রলোক পত্রিকা পড়ছেন। ফলে লাইট অন। তিনি পত্রিকাটা রেখে ওয়াশরুমে গেলেন। ফিরে এলেন। এসে ব্যাগ খুলে একটা মাঝারি সাইজের চেপ্টা বোতল বের করলেন। এবার মুখে আকর্ণ একটা হাসি মুখে টেনে আমাকে বললেন- আপনি কি ড্রিংক করেন? আমি না বলে আবার চুপ হয়ে গেলাম।

তিনি বললেন- কিছু মনে করবেন না; ঘুমানোর আগে ড্রিংক করা আমার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। আমি শুনলাম কিন্তু কিছু বললাম না। আমি আর কি বলবো? তিনি অল্প অল্প করে পানীয় মুখে ঢালছেন আর গিলছেন। আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ওয়াশরুমে গেলাম। ওয়াশরুম থেকে ফিরার পথে কর্তব্যরত এটেন্ডেন্টের সাথে কথা বললাম। তাকে আমার কেবিন নং বললাম। তারপর আমার কেবিনের পরিবেশ কি রকম তা অবহিত করে তাকে আমার কেবিনের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে বললাম। এটেনডেন্ট একটু হেসে আমাকে বললেন- আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন; কোন অসুবিধা হবে না।

আমি কেবিনে প্রবেশ করেই মনিপুরী ভদ্রলোককে বললাম- রাত অনেক হয়েছে। এবার ঘুমানো দরকার। আমি আমার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। তিনি আলোটা নিবিয়ে দিলেন। ট্রেন চলছে। বিশেষ ছন্দে দুলছে। ঘুমও আসছে। বোম্বের পথে ধাবমান বিরাট ট্রেনে রাত গেল; পরদিন দুপুর থেকে যাত্রীরা আশা করছে বোম্বে আর বেশি দুরে নয়। আমাকে বোম্বে গিয়ে উঠতে হবে দক্ষিণ ভারতের অন্য এক ট্রেনে (সম্ভবতঃ আহমেদাবাদ এক্সপ্রেস)। আমি আমাদের এটেনডেন্টের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলাম। তিনি আমাকে বোম্বে সেন্ট্রাল স্টেশনে না গিয়ে দাদার স্টেশনে নেমে যেতে পরামর্শ দিলেন। আহমেদাবাদ এক্সপ্রেস দাদার হয়ে যাবে।

এটেনডেন্টের পরামর্শ মত আমি দাদার নেমে গেলাম। ট্রেন বোম্বে সেন্ট্রাল থেকে আসবে। অতএব, আমি অনেক সময় পাব। জানলাম দক্ষিণ ভারতের ট্রেনের খাবার নাকি আমাদের ভালো লাগবে না। ফলে রাতে খাওয়ার জন্য আমি আমার পছন্দমত কিছু খাবার কিনে নিলাম। বিকেল পাঁচটায় আহমেদাবাদ এক্সপ্রেস এসে থামলো দাদার স্টেশনে। আমি আমার বাক্সপেট্রা নিয়ে উঠে বসলাম আমার নির্দিস্ট সিটে।

এবার সাথি হিসেবে পেলাম দিল্লীর এক ছেলেকে। ছেলেটা হাইস্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র। কিন্তু এমন জাতিভেদ প্রথার চরম অনুগামী এবং লজ্জাহীন ছেলে আমি সে পর্যন্ত আর দ্বিতীয়টা দেখি নাই। রাত দশটায় ট্রেন এসে থামলো ওয়াদি জাংশনে। ওয়াদি কর্ণাটকার একটি মস্ত বড় জাংশন স্টেশন। এখান থেকে ছাড়বে বেঙ্গালোরগামী আরেক ট্রেন। আমি সে ট্রেনের যাত্রী। আমি তাই নেমে পড়লাম ওয়াদি স্টেশনে। আমি যাব ঢারওয়াড। বেঙ্গালোরের পথেই পড়বে ঢারওয়াড স্টেশন। আমি বাক্স পেট্রা নিয়ে উঠলাম আমার ট্রেনে। এখন আর কেবিন টেবিন নাই। প্রথম শ্রেনীতে উঠে একটা সিটে বসলাম। ট্রেনের অবস্থা ভাল না। বসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। যাত্রীদের কোন ক্লাস আছে বলে মনে হলোনা। যার যেখানে ইচ্ছা উঠে বসে যাচ্ছে। আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম।

কি ব্যাপার! মালপত্র নিয়ে ঢারওয়াড পৌঁছবোতো নাকি চুরি হয়ে যাবে! রাতদিন এভাবে ট্রেনে চড়ার ধকল আর সহ্য হচ্ছে না। ক্লান্তিতে শরীর ঢলে পড়ার অবস্থা। যাক, ট্রেন ছাড়লো। সকাল সাড়ে সাতটায় ট্রেন এসে থামলো ঢারওয়াড স্টেশনে। আমি নেমে পড়লাম। আমার দীর্ঘ ট্রেন জার্নির সমাপ্তি ঘটলো।

স্টেশনের সদর গেট পার হয়ে বাহিরে এলাম। ভাড়ার জন্য গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। একটা নিতে হবে। দুকদম ফেলে হঠাৎ বাঁ দিকে তাকাতেই চোখে পড়লো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবক্ষ মুর্তি। মুর্তির পাশেই বিষয় লেখা আছে। এ মুহুর্তে সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওসব পড়ার কোন আগ্রহ আমার হলো না। তবে বুঝলাম বাংলা থেকে প্রায় আড়াই হাজার মাইল দুরে কান্নাড়া ভাষাভাষীদের দেশ কর্ণাটকা ট্রেনে চড়ে পার হওয়া কালে হয়তো কবি এই স্টেশনে নেমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এত বড় কবি, বিশ্বজুড়ে যার খ্যাতি, তিনি অখ্যাত এই জনপদে কিছুক্ষণ ছিলেন এটা কি এই অঞ্চলের মানুষদের জন্য কম কথা! বিশ্বকবির এই আগমনকে চির স্মরণীয় করে রাখতে তাই ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ এই ব্যাবস্থা করেছেন। মুর্তি দেখে যেমন আনন্দিত হলাম তেমনি বাঙালী বলে গর্ববোধ ও করলাম। ইচ্ছা হচ্ছিল ডেকে বলি- দেখ এখন কে এসেছে।

আমার সুপারভাইজর প্রফেসর সাইদাপুর আমাকে চিঠি লিখে তার বাসার ঠিকানা জানিয়ে রেখে ছিলেন এবং স্টেশন থেকে সোজা তার বাসায় চলে যেতে বলেছিলেন। তার বাসা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে (কর্ণাটক ইউনিভার্সিটি)। আমি একটা টেক্সি নিলাম। আধা ঘন্টা পর টেক্সি ড্রাইভার আমাকে স্যারের বাসার সামনে নামিয়ে দিল।

সাইদাপুর স্যার যেন আমার অপেক্ষায় ছিলেন। আমার টেক্সির শদ শুনে বেলকনিতে এলেন; আমাকে দেখলেন; এবং তড়িত নিচে নেমে এলেন। বাসায় প্রবেশ করে বসলাম। হাত-মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হলাম। ম্যাডাম আমার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করে রেখেছেন। সেগুলো টেবিলে চলে এল। স্যার আমাকে নিয়ে বসলেন। এবার কথাবার্তা আর খাওয়া দুটোই শুরু হলো। স্যার বললেন- শুনলাম বাঙালীরা মিস্টি খুব পছন্দ করে, তাই তোমার জন্য বেশির ভাগ মিস্টি আইটেম তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেকটা আইটেম বেশ মজাদার। খেয়ে বেশ তৃপ্ত হলাম। স্যার সুরেশ নামের তার এক ছাত্রকে ডাকলেন এবং আমাকে বললেন- সুরেশ আসছে। তুমি সুরেশের সাথে হোস্টেলে চলে যাও। সেখানে তোমার জন্য একটা রুম রাখা আছে। তুমি রুমে উঠে যাও। বিশ্রাম নাও, ঘুমাও। আজ আর তোমাকে ডিপার্টমেন্টে আসতে হবে না। আর শুন, তোমার কথা আমি হোস্টেলের ওয়ার্ডেন প্রফেসর দৌলতাবাদকে বলে রেখেছি। তোমার কোন কথা থাকলে তুমি প্রফেসর দৌলতাবাদকে নিঃসংকোচে বলবে। তিনি ক্যামিস্ট্রির প্রফেসর এবং খুবই ভালো একজন মানুষ।